একটি চমৎকার লেখা। শেয়ার করার লক্ষ্যেই এখানে সংযোজন করে দিলাম ।
----------------------------------------------------------------------------------
কবি ও সমাজ পরিপ্রেক্ষিত
হায়াৎ সাইফ
====================================
আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষের ইতিহাসে আমাদের সাহিত্যের বিশেষত কবিতার সম্পৃক্ততা নিশ্চিতভাবে লক্ষ্য করা যায়। জাতিসত্তার উন্মেষের সঙ্গে কয়েকটি সামাজিক বাস্তবতা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
আমরা জানি যে, আমাদের জাতিসত্তার উন্মেষের মূল উৎসটি ভাষাগত। অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতির চর্চা ও বহিঃপ্রকাশের মূল বাহন ভাষা। যার সবচেয়ে পরিশীলিত অংশ কবিতার আঙ্গিকের ভেতর দিয়েই রূপ পরিগ্রহ করে। আমাদের যে মৃত্তিকালগ্নতা, যে মাটিতে শেকড় চারিয়ে আমাদের কায়িক অস্তিত্ব সেই মাটির রসেই আমাদের মানসিক জীবনও সিঞ্চিত হয়ে ওঠে। এই নিসর্গ, এই ভুবন ও তার ইতিহাস আমাদের জাতিসত্তার নির্মিতির প্রধান উপাদান।
অনেকে একধরনের যুক্তি খাড়া করেন এরকম যে, বাংলাদেশ হতো না যদি পাকিস্তান না হতো অর্থাৎ ভারত বিভক্ত না হতো। এ ধরনের অদ্ভুত যুক্তি যদি অনবরত প্রয়োগ করা যায় তাহলে আমাদের গিয়ে ঠেকতে হবে এমন একটা যুক্তিতে যে, আদম-হাওয়ার সৃষ্টি না হলে আমরা হতাম না, পৃথিবী হতো না, সভ্যতা হতো না ইত্যাদি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পৃথিবীতে মানব জাতির সৃষ্টি হয়েছে এবং সমাজ সংগঠিত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে সভ্যতার উদ্ভব হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষুদ্র গ্রহের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী তাদের প্রতিভা অনুযায়ী নানা বিচিত্র সমাজ গড়ে তুলেছে এবং বিশিষ্ট সভ্যতার জন্ম দিয়েছে।
এই উপমহাদেশেও তেমনি স্বতন্ত্র সভ্যতা ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে।
সমাজ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কর্মের মধ্যে বিশিষ্ট চৈতন্যের উদয় হয়েছে। আমরা যারা বর্তমান বাংলাদেশে বসবাস করি তাদেরও তেমনি বিশিষ্ট সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের অস্তিত্ব পৃথিবীর অন্যান্য সমাজের যে সমান্তরাল অস্তিত্ব তার মধ্যেই বিদ্যমান অর্থাৎ কোন সমাজই বা কোন মানবগোষ্ঠীই বিচ্ছিন্নভাবে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না। সভ্যতার ইতিহাসে এমন এক পর্যায় ছিল যখন পৃথিবীর এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ছিল কম বা একেবারেই ছিল না। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে অন্তত এটুকু স্পষ্ট যে, বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগের প্রবণতা অনেক প্রাচীন, সাম্প্রতিককালের নয়।
অনেক সময় জীবিকার প্রয়োজনে, অনেক সময় অস্তিত্বের প্রয়োজনে মানুষ দূর-দূরান্তরে পাড়ি দিয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ সমাজ উদ্ভবের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। আজকের দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমূহ উন্নয়নে আমরা বিশ্ব পল্লী বা গ্লোবাল ভিলেজের কথা বলি। কিন্তু তার পরও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জীবনযাপনের উপকরণে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। ভালোমন্দের বিচার না করেও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রকৃতিগত পার্থক্য ও বৈচিত্র্য রয়েছে তা মানুষের বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
মানব সমাজের এই দিকটিকেই একের মধ্যে বহু এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে সাদৃশ্যের বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে। মানুষের কায়িক জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গে বা তার সমান্তরালে প্রবাহিত থাকে তার মানসিক জীবনের স্রোত, তার চিন্তা-চেতনার জগৎ। এই কায়িক জীবন ও মানসিক জীবন পরস্পর সম্পর্কিত বলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সৃষ্টিশীলতা বিভিন্নতা পায়। আমাদের একটি নিজস্ব মননভূমি আছে। যেমন আছে অনান্য জাতিসত্তার।
সেই মননভূমির সঙ্গে অন্য অনেক সমাজের সাদৃশ্য যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বৈসাদৃশ্য। এ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কায়িক ও মানসিক অস্তিত্বে মোটা দাগে যেমন অনেক সাদৃশ্য রয়েছে তেমনি অনেক বিষয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও প্রবল। উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি তাদের মধ্যেও বহু বিচিত্র সাংস্কৃতিক প্রভাব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছে। সেসব কিছু মিলেই আমরা বাংলাভাষী, বাঙালি ও বাংলাদেশী। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণ তার অধিকাংশ মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিশিষ্টতা।
ভাষার দিক থেকে, চিন্তার দিক থেকে, খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে ভারতীয় বাঙালি ও বাংলাদেশের বাঙালির মধ্যে যেমন বিরাট সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি ছোট ছোট বৈসাদৃশ্যেরও অভাব নেই। যদি কবিতার কথাই ধরা যায় তাহলেও দেখা যাবে যে, একই উত্তরাধিকার থেকে বেরিয়ে উভয় বাংলার কবিতার বিষয়বস্তু ও তার বহিঃপ্রকাশে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে কলকাতাকেন্দ্রিক যে মধ্যবিত্তের বিকাশ হয়েছিল এবং তৎকালীন পূর্ববাংলা ও বর্তমান বাংলাদেশে বিশেষত ১৯৪৭-পরবর্তীকালে অল্প সময়ের মধ্যে যে মধ্যবিত্তের উত্থান ঘটেছিল, তাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে সেটা স্পষ্ট বলেই কলকাতার বাজারে বাংলাদেশীদের সেখানকার বণিকরা খুব সহজে শনাক্ত করতে পারেন। ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও পশ্চিমবঙ্গের কেউ এলে তাদের বাচনে ও আচরণে যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাও সহজে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। কবিতার ক্ষেত্রে বেশ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কলকাতাকেন্দ্রিক সমাজে কবিতার চর্চা অনেক বেশি বিস্তৃত ও গভীর।
এটা তো নিঃসন্দেহে বলা যায়, সেখানে কবিতার পাঠক সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় আকারে অনেক বড় এবং সোজা কথায় বলতে গেলে সেখানে কবির কদর ও কবিতার চর্চা আমাদের চেয়ে বেশি। কলকাতার অনেক আবৃত্তিকারের কণ্ঠে অপেক্ষাকৃত অজানা বা কমজানা অনেক কবির রচনা রণিত হয়। আমাদের এখানে কবিতার চর্চা সে অর্থে গভীর ও ব্যাপক নয়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় আমরা ‘পদাবলী’ বলে কিছুসংখ্যক কবির একটি ফোরাম তৈরি করেছিলাম এবং বেশ ক’বছর ধরে কবির স্বকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান করা হয়েছে। তখনকার অভিজ্ঞতা ছিল এই যে, পাঠক ও শ্রোতা তৈরির বিষয়ে আমরা অনেকখানি সফল হয়েছিলাম।
কেননা পরবর্তীকালে কবিতা আবৃত্তির প্রসার লক্ষ্য করা যায়। অনেক আবৃত্তি গোষ্ঠীর কথা আজকাল শুনি এবং তারা বিভিন্ন সময়ে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও করে থাকেন। কিন্তু তাতে প্রকৃত অর্থে কবিতার চর্চা এবং কবিতা শোনার কান ও মন কতখানি তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তার নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই। কেউ উদ্যোগ নিলে হয়তো কিছু পরিসংখ্যান পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আপাতত বিভিন্ন কাব্যপাঠের অনুষ্ঠানে যা দেখি তাতে মনে হয়, শ্রোতার সংখ্যা যেমন সীমিত তেমনি কবিতার মর্মে প্রবেশ করার প্রবণতাও যথেষ্ট নয়।
পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে কিন্তু ছবিটা সেরকম নয়। এর কারণ যাই হোক আমরা সাধারণভাবে দেখতে পাই যে, আমাদের সমাজে কবি অবমূল্যায়িত। আমাদের মিডিয়া জগতে তাদের উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষীণ। অন্যদিকে আমাদের বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে মিডিয়ায় বিশেষত দৃশ্যমান মিডিয়ায় যেসব আলাপ-আলোচনা দেখি সেখানে সাংবাদিক থাকেন, অধ্যাপক থাকেন, রাজনীতিবিদ থাকেন এবং সাধারণভাবে যাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয় তারা থাকেন কিন্তু কবি একেবারেই অনুপস্থিত। অথচ উদ্দীপনার সময়, দুঃখের সময়ে কবি ও গীতিকারের যে সামাজিক প্রয়োজন তা অস্পষ্ট থাকে না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কবিতা ও গান আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। অথচ সমাজজীবনের নানা বাস্তবতা ও সমস্যার বিষয়ে আমরা কোন সময় লেখক বা কবিকে পাই না। আমাদের সমাজে কি কবি অবমূল্যায়িত? অথচ আমাদের ভাষার যে অন্তর্নিহিত শক্তি তাকে আবিষ্কার করেছেন কবিরাই। তাহলে কি সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমরা নিস্পৃহ হয়ে পড়ছি নাকি এক ধরনের বিশ্বায়নের আগ্রাসন আমাদের ধীরে ধীরে অধিকার করছে? এর ফলে আমাদের সাংস্কৃতিক ভবিষ্যৎ কি হবে সে সম্পর্কে কিছু বলা দুষ্কর। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নিজের ভাষা ও নিজের সুরের ভেতর দিয়েই কেবল একটি জাতির আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটে।
আমরা বাংলাদেশে আমাদের অস্তিত্বের শুরুতে বিপুল আশা ও ভবিষ্যতের বিশাল স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। একাত্তরের সেই শুভ লগ্নে আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটেছিল কিন্তু তার পরে কি কারণে বারবার আমাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে তা ভেবে দেখা দরকার। আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা কি আমাদের মধ্যে তেমন কোন পুরুষার্থ রচনা করতে পারেনি যা আমাদের সমাজকে সাংস্কৃতিকভাবে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেবে? এই উন্নয়ন কেবল পারিপার্শ্বিক উন্নয়ন নয়, মূল্যবোধের ও পুরুষার্থের উদ্বোধনের সঙ্গে আদ্যোপান্ত সম্পর্কিত। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আমরা ভেবেছি এবার হয়তো শুভদিনের সূচনা হবে। কিন্তু তা হয়নি।
আমাদের সমাজ থেকে এমন নেতৃত্বের উদ্ভব কেন ঘটছে না যে নেতৃত্ব সম্পূর্ণ সমাজকে সুষ্ঠু সুন্দর জীবনের দিকে আমাদের পরিচালিত করতে পারবে?
আশা ও উদ্দীপনার বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সমাজে কবির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা উদ্দীপনার গান ও কবিতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছি। যিনি ওই সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপনীত হতে পারেননি তিনি বন্দিশিবিরে থেকেও তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন এবং তার নিজের মতো করে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন স্বাধীনতার স্বপ্নে। কবির যে মন তা তার ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এক বিরাট প্রেক্ষাপটে ঘটকের ভূমিকায় কাজ করে। প্রকৃতি ও মানুষের যে মিথষ্ক্রিয়া এবং সে কারণেই সমাজ বাস্তবতার যে নান্দনিক অস্তিত্ব কবির মনে সৃষ্ট হয় তা থেকেই বেরিয়ে আসে কোন এক অনন্য মুহূর্তে তার অভূতপূর্ব উচ্চারণ।
এই উচ্চারণ একটি পরিপূর্ণ সামাজিকতার ভেতর থেকেই উৎসারিত। এ কারণেই কবি সমাজবিচ্ছিন্ন নন। তার মূল কাজটি একাকীত্বে সংঘটিত হলেও তার মানস ধারণ করে তার সমাজের সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষা ও আনন্দ-বেদনার সম্পূর্ণতা। কথাটা কবি, লেখক ও সৃষ্টিশীল বিশেষত নান্দনিক সৃষ্টিশীলতার বিভিন্ন প্রকাশ মাধ্যমে যিনি কাজ করেন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাহলে কবির বৈশিষ্ট্যটি কোথায়? বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজ পরিপ্রেক্ষিতে ও সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে কবির মন ও কাব্যকলা সম্পর্কে নানা সংজ্ঞা উপস্থাপিত হয়েছে; এবং কবি সম্পর্কে সমাজের ক্ষমতাবানদের দৃষ্টিভঙ্গিও সেই বিশেষ কালের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
একজন প্রাচীন দার্শনিক তার রাষ্ট্রে কবির উপস্থিতি নিরাপদ মনে করেননি। কারণটা অস্পষ্ট নয়। কবি নিত্যদিনের ঘটনাপ্রবাহ ও দৃশ্যপটের মধ্যে হঠাৎ করে চিন্তায় নতুন পরিপ্রেক্ষিত, নতুন আলোর ঝলকানি নিয়ে আসেন। তার বিশিষ্ট দৃষ্টিতে যে সত্য উদঘাটিত হয় জীবন ও জগতের, তাকেই তিনি উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা-প্রতীক-কল্পচিত্রের মাধ্যমে একটি বিশিষ্ট ব্যঞ্জনাময় ভাষায় প্রকাশ করে ফেলেন। যে সত্যটি প্রকাশিত হয়ে পড়ে তা যদি ক্ষমতাধরের জন্য নিরাপদ না হয় তখনই প্রয়োজন হয় তার কণ্ঠরোধ করার এবং রাষ্ট্র থেকে নির্বাসন দেয়ার।
বিভিন্নœ কালে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে এমনটা ঘটতে দেখা গেছে। এর অনেক কেতূুহলোদ্দীপক উদাহরণ দেয়া চলে। এই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত নৈতিকতার দোহাই দিয়ে বোদলেয়ারের কিছু রচনা প্রকাশ নিষিদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ ভারতে নজরুলের কথা সবার জানাই; আমাদের দেশেও অল্পকাল আগেও এমনটা ঘটেছিল।
প্রাচীনকালে যখন প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের বিপুল বিস্ময় ও অপরিসীম ভীতি বিদ্যমান ছিল তখন অনেক সময় অলৌকিক জাদুকরী ক্ষমতা কবির ওপর আরোপিতও হয়েছে।
বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে আজকের দিনে ওইসব ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর দুর্মর বাণিজ্যিক সভ্যতার চাপে কবি অনেক সময় হয়তো অবমূল্যায়িত হয়েছেন কিন্তু তার পরও কবিতার অগ্রগতি কিন্তু ব্যাহত হয়নি। প্রতিটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি জনগোষ্ঠীতে কবির উচ্চারণে সরল জাগতিক উপকার প্রত্যক্ষ না হলেও তাতে যে জীবনদর্শন প্রতিবিম্বিত তার স্পষ্ট প্রভাব মানুষের ধারণায় মিশে যায়। এ কারণেই একজন কবির উচ্চারণ সবার হয়ে উঠতে পারে এবং যখন তা সবার হয়ে ওঠে সেখানেই তার শিল্পের সার্থকতা। কাজেই মানব সভ্যতার বর্তমান যে স্তর তাতেও স্পষ্টতই দেখা যায় কবির সামাজিক প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে শেষ হয়ে যায়নি। কোন এক জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক শিক্ষা এবং তার ফলে যে মানসিক বিকাশ ও পরিণত মনন তাই সেই মানবগোষ্ঠীর কবিতার ধরন ও মানকে নির্দিষ্ট করে।
বাংলাদেশে সৌভাগ্যবশত চর্যাপদ থেকে শুরু করে আমাদের কাব্যকলায় বিপুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত উত্তরাধিকার রয়েছে। এই উত্তরাধিকার উভয় বাংলার জন্য একই উৎস থেকে আহরিত। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক কারণে উভয় বাংলার কাব্যিক উচ্চারণের মধ্যে বিপুল সাদৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বৈসাদৃশ্য থাকবে এবং সেগুলোই নির্দিষ্ট কালিক বিন্দুতে তাদের পারম্পরিক বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ নির্মাণ করবে। সভ্যতার দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কবিতার নির্মাণ এবং তার পাঠক ও শ্রোতা আরও দীর্ঘকাল মানব সভ্যতার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হিসেবে সচল থাকবে। বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তির কারণেই তার কবিতার উদ্বর্তন নানাভাবে হতে থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কবিতার সত্যিকারের উপভোগ হয়তো আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের বর্তমান বাস্তবতার কারণে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।
---------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক যুগান্তর । সাময়িকী । ১১ জুলাই ২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।