আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাক বাহিনী ও রাজাকাররা কিভাবে মানুষ মেরেছে আসুন সেটাই জানি-৩

রাজনীতি ও অর্থনীতি এই দুই সাপ পরস্পর পরস্পরকে লেজের দিক থেকে অনবরত খেয়ে যাচ্ছে

কাজটি মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্রের। তারা বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মুক্তিযোদ্ধারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা এর নাম দিয়ে কথ্য ইতিহাস। এসব সাক্ষাৎকার পড়লে যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুভব করা যায়। আসুন জানি সেই সব ইতিহাস।

(এখানে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। এটি কোনো মৌলিক লেখাও না। আমি শুধু সাক্ষাৎকারটি তুলে দিয়েছি মাত্র। ) নাম : তুনদুরন বেওয়া স্বামী : তাহের উদ্দীন (১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিহত) গ্রাম : প্রাণকৃষ্ণপুর, ডাক : পুটিমারা, ইউনিয়ন : পুটিমারা থানা : নবাবগঞ্জ, জেলা : দিনাজপুর শিক্ষাগত যোগ্যতা : চতুর্থ শ্রেণী ১৯৭১ সালে বয়স : ৩০ ১৯৭১ সালে পেশা : গৃহবধূ, বর্তমান পেশা : গৃহিনী প্র: ১৯৭০-৭১ সালের কথা কি আপনার মনে পড়ে ? যুদ্ধের কথা ? উ: তহন একটা ভোটাভুটি হইছিলো। মোরা নৌকাত ভোট দিছি।

তারপর দেশের মধ্যে যুদ্ধ নাগি গেলো। খানরা মানুষ মারি ফেলালো। মেয়ে মানুষক নির্যাতন করিলো। প্র: আপনাদের গ্রামে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করেছিলো কি ? উ: হ, আক্রমণ কয়েকবার করিছে। পরে একদিন রাইতের বেলা গ্রামটা খানরা আবার ঘেরাও করছিলো।

কেউ জানবার পারে নাই। ভোররাতে সবাই জাগি উঠলো। জাইগা দেখে চারপাকে খানরা ঘিরি আছে। যেই পাকে মানুষ যায় সেই পাকেই খান। কোনো পাকেই খালি নাই।

সব পাকেই ওরা। কেউ বারাইতে পারে নাই। এতোগুলাই আসছিলো ওরা। প্র: তারপরে ? উ: ভোর হইলো। তখন ওরা বাড়ি বাড়ি ঢুকলো।

অর্ধেকগুলা ঘেরাও দিয়া থাকলো আর বাকিগুলান বাড়ি বাড়ি ঢুকলো। ঢুকে পুরুষ মানুষক ডাকি ডাকি নিয়া গেছে। তাদের নিয়া এক জায়গায় জমা করি মারিছে। পুরুষ মানুষক সব নিয়া গেলো। মোরা বাড়িত তো শানি পাচ্ছি না।

সে সময়ে মনে করেন যে, হামার কিয়ামত আইছিলো। কিয়ামতের লাকান। যা দুঃখ হইছে বাবা সেগুলি বইলি আর কি হবি। পুরুষ মানুষক ধইরা নিয়া গেলো। মেয়ে ছেলের উপর নির্যাতন করিলো।

নির্যাতন করে টরে হ্যারা গেছে। মোরা বিলত (বিল) নাইমে আছি, কেউ সুল্লিত (দুই বাড়ির মাঝখানের অপ্রশস্ত জায়গা) সাইন্দে আছি, কেউ পানিত নাইমে আছিলাম। ওত (ওখান) থাকি ভরভরি শব্দ খালি শুনি। আমরা জানি না যে মাইরে ফেলাইছে। অতো লোক সবাক মারি ফেলাইবে কোনো দিনও ভাবি নাই।

একটা লোক আইসে মোক আর কয়জনাক খবর দিলো যে, গ্রামের সব লোকরে ওই জায়গায় খানেরা মাইরে ফেলাইছে। তার আগে লুকাইয়া একবার মুই ওইহানে গেছিলাম। যায়ে দেখি যে খালি লাইন করিছে, মুক দেখি খানরা রাইফেল তুলিছে, মুই ফির আবার দৌড়াইছি। প্র: দৌড়ে কোথায় গেছিলেন ? উ: গাওত। এ বাড়িত থাকি ও বাড়িত যাচ্ছি, ওডি যাচ্ছি, ওডিও দেখি খান।

কোনো পাকেই আর রেহাই পাই না। খানরা মোকও ধরছিলো। প্র: আপনাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন ধাওয়া করছিলো তখন কি তারা গুলি করছিলো ? উ: মোক গুলি করে নাই। অন্য দুইজন মেয়ে মানুষক গুলি করছিলো। ওই দুইজনের নাম সয়না, আর ছালু।

খুব অত্যাচার কইরেছে মেয়েছেলের উপরে। খুব অত্যাচার। প্র: কখন অত্যাচার করছিলো ? উ: গ্রাম থাকি পুরুষ মানুষ সব ধইরে নিয়ে গেলো। একগুলা খালি পুরুষ মানুষক ধইরে নিয়ে গেলো, আরেকগুলা খালি বাড়িত সান্ধায়। এখানে ওখানে সান্ধায়।

সান্ধায়া মেয়েছেলেক ধরিছে। ধরে নিয়া হেরা মেয়েছেলের উপর খুবই অত্যাচার করিছে। প্র: পাকিস্তানি সৈন্যরা মেয়েদের উপর কি খুবই অত্যাচার করেছে ? আর কি করেছে ? উ: হ। হেরা খুবই অত্যাচার টত্যাচার করে চলি গেছে। তারপর মোরা আবার এখানে ওখানে লুকায়ে ছিনু।

লুকায়ে থাকতেই ভরভরি আওয়াজ পাইনু। অনেকক্ষণ পর এক লোক আইছে। তহন শুনলুম সবাই মারা গেছে। খবর পাইয়া মোরা সব ওইহানে গেছি। মোরা কান্দাকাটি করছি।

ফির তো আবার খবর আইছে, খানরা নাকি আবার আইতেছে, ফির মোরা দৌড় দিছি। । হামার কিয়ামত গেছে বাবা। সেইলা দুঃখের কতা আর এহন তোরা শুইনে কি কইরবেন। প্র: তারপরে ? উ: তারপরে ওইদিন বাইরের আত্মীয়-স্বজন আইসে সবাক মাটি চাপা দিছে।

নাই গুসুল (গোসল), নাই ওজু, নাই কাপড়। কোনো রকমে সবাক মাটি চাপা দিছে। নেপের ওয়ার, মুশুরি (মশারি), ওইলে দিয়ে মাটি চাপা দেছে। গোরস্তান নিয়া গেছে সময় খানরা উল্টে ফির আয়েছে। মাটি দিবার লোকে ফির আবার দৌড়াইছে।

এই রকম করে কোনোরকমে সবাক মাটি চাপা দিছে। প্র: পাকিস্তানি সৈন্যরা সে দিন মোট কতজনকে হত্যা করেছে ? উ: ম্যালা, শ’য়ের উপর গেছে বোধ হয়। মোর এহন খেয়াল নাই। কেউ মোর ভাই হয়, কেউ ভাতিজা হয়, কেউ চাচা হয়, কেউ খুড়া হয়। খালি স্বামী বুইলে নয়।

সবাই গ্রামের আত্মীয়। তহনকার জন্যে চিন্তা করি। সে যে কি দিন গেছে মোদের। প্র: খান সেনারা লোকজনকে হত্যা করে কোথায় গেলো ? উ: চলে গেল এক্কেরে ঐ বলাহারের দিকে। প্র: বলাহার থাকতো ওরা ? উ: হ।

ওরা পাল শুইদ্ধে দল ধরে গেলো। প্র: তারপর আপনি বাড়িতেই ছিলেন ? উ: বাড়িতেই ছিনু। ওরা ফির আয়েছে, ফির দৌড়াদৌড়ি করিছি। ফির বাড়িত আইছি। সবাই যে দিকে যায় মুইও সে দিক গেছি।

মোর বাড়িত তো লোক নাই। মোর একটা ছোট বাচ্চা। সবাই যি দিক যায় মুইও ঐ ছেলেক নিয়া সিটি যাই। ছেলে তো কেবল সাড়ে তিন বছর বয়েস। এই ছেলেক নিয়া আমি আর কোথায় যাবার পারি না।

খান সেনারা বাড়িঘর সব পুইড়ে দিছে, ভাঙি দিছে। কি করে দিছে! আহারে ! আমার বাপ নাই, মাও নাই, আমার ভাই নাই, একটা ভাই, তাকও মারি ফেলালো। আমার ছোটকালে বাপ মারা গেছে, মাও নাই। মোক যে কেউ উপকার কইরবে সে লোক মোর নাই। প্র: আপনার পরিবারের কয়জনকে হত্যা করেছিলো খানেরা ? উ: সে দিন মারিছে গ্রামের সব লোকগুলাক।

আমার স্বামীক মাইরছে। ভাইওক মারিছে। আর সবাই তো আত্মীয় স্বজন। প্র: আপনার ভাইকে কখন মারছে ? উ: ভাইকেও ওই একই দিনে মারিছে। প্র: আপনার ভাইয়ের নাম কি ? উ: মফিজ।

একই দিনে সব মারিছে। তহন না ভায়ের তনে (জন্য) কান্দি, না স্বামীর তনে কান্দি, না ভাতিজার তনে পস্তাই- এইরকম অবস্হা আর কি। প্র: খানরা আপনার ভাতিজাকেও মারছিলো। উ: হ, ভাতিজাও মারা গেছে। প্র: আপনার ভাতিজার নাম কি ? উ: আইজর মিয়া।

ভাসুরের ব্যাটা, ভাতিজা। প্র: যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী আসছিলো এদিকে ? উ: মুক্তি ? মুক্তি তো পরে আইছিলো। প্র: আসছিলো এখানে ? উ: হ। খানরা রাস্তা দিয়ে যায় আর কয় ব্যাটারা সব মুক্তি পকেটে রাখিছে। এইলা কথা কয়।

মুক্তি তো তহন ইন্ডিয়াত গেছিলো। পরে আইছিলো। মুক্তিরা আইসে আর কি কইরবে। খানরা তো সব সাফ করে দিছে। মুক্তিরা আইসে আর কি কইরবে ? দুঃখ প্রকাশ কইরে কি হবি আর ? তহন আমার ছেলে ছিলো খুবই ছোট্ট।

ফির তাক কতো কষ্ট দুঃখ কইরে মানুষ করনু, কতো কষ্ট দুঃখ কইরে শিক্ষা দিনু। হে এহন বড় হইছে। চাকরি করে। ওর আয়ে মুই কোনো মতে সংসার চালাই। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : নভেম্বর ০৫, ১৯৯৬


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।