.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)
রীমা বাচ্চাদের মত চিৎকার করে বললো, শাহেদ, ওরাতো অনেক এগিয়ে যাচ্ছে? আরো স্পিড বাড়াও।
শাহেদ স্পিড মিটারে চোখ বুলিয়ে নিল। গাড়ির গতি ঘন্টায় একশ বিশ কিলোমিটার ছুঁইছুঁই করছে। সামনেই আকাশের গাড়ি যেটা প্রতি সেকেন্ডেই একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। শাহেদ বুঝতে পারলো আকাশের স্পিড একশ বিশের উপরে নিঃসন্দেহে।
এক্সিলেটরে রাখা ডান পায়ের উপর থেকে চাপটা কমিয়ে আনলো শাহেদ। মূহুর্তে স্পিড কমে একশ এর কাছাকাছি চলে আসলো। রীমা আবার চিৎকার করে উঠলো, কি হলো? স্পিড কমাচ্ছো কেন? আমরাতো হেরে যাবো?
শাহেদ কিছু বললো না, শুধু হাসলো।
আজ রীমাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। পনি-টেইল করে চুল বাঁধা।
ফর্সা মুখে কেবল চোখদুটোকে সজিয়েছে। সে চোখে চোখ পড়লে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয় শাহেদের। যেন অথৈ সমুদ্রে প্রতি মূহুর্তে হারিয়ে যায় সে। মাঝে মাঝে শাহেদ ভাবে, রীমাকে ছাড়া এক মূহুর্ত অন্য কিছু কি সে কল্পনা করতে পারে? নিজের মাঝেই উত্তর খুঁজে পায়, কল্পনা করার কথাও যেন সে কল্পনা করতে পারে না।
আজ রীমার জন্মদিন অথচ কোন পার্টি নেই, হৈচৈ নেই।
রীমার বাবা সরকারী কর্মকর্তা। অফিসের কাজে দেশের বাহিরে আছেন। রীমার মাও সাথে। এমন সময় রীমাই চায়নি কোন গেটটুগেদার হোক। মা-বাবা ফিরে আসলে তার পর করা যাবে, বন্ধুদের বলেছিল।
কিন্তু আজকের এই শুক্রবারে দুপুর গড়ানোর পর দেখলো সত্যিই জঘন্য একঘেয়ে লাগছে সময়টা। যেন করার কিছুই নেই ওর। শাহেদকে ফোন করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পায়নি। ফোন বন্ধ। একটু অবাক হয়েছিল বটে, তবে এটাও ঠিক মাঝে মাঝে শাহেদ শুক্রবার কি সব বিতর্কের কাজে আতলামী করতে নটরডেম ভিকারুন্নেসায় যায়।
হয়তো ওরকম কোথাও আছে, ভেবেছিল রীমা।
রীমা ঘুনাক্ষরেও এটা ভাবেনি যে ওর এই একঘেয়ে জন্মদিনটাকে বৈচিত্রময় করে তোলার একটা মাস্টার প্ল্যান তৈরী করছিল তখন শাহেদ ওর বন্ধু আকাশকে নিয়ে। আকাশ শাহেদের খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। বলা যেতে পারে শাহেদের ভালো বন্ধু কেবল আকাশই। মাস্টার প্ল্যানের মূল বুদ্ধিটা আকাশেরই।
ওরা ঠিক করলো শাহেদ রীমাকে এবং আকাশ ওর বান্ধবী নীলাকে নিয়ে গুলশান দুই নাম্বারে এক হবে। তার পর ওরা যাবে আশুলিয়ার পথ ধরে অজানার দিকে। কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। টুকটাক স্ন্যাকস্ আর বনানীর সুমিজ হটকেক থেকে একটা ‘ব্ল্যাক ফরেস্ট’ কিনে নিয়েছিল শাহেদ। পথে কোথাও থেমে আড্ডা দেয়া যাবে, এই প্রধানত পরিকল্পনা।
উত্তরা পার হয়ে যখন আশুলিয়ার রাস্তায় পড়লো ওরা, তখন থেকেই আকাশ গাড়ির স্পিড বাড়াতে শুরু করেছে। শাহেদও কিছুক্ষন পাল্লা দিয়ে চালিয়েছে তবে একশ বিশ ছুয়ে ফেলার পর ধীরেধীরে স্পিডটা কমিয়ে দিল।
খানিক পরেই রাস্তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় আকাশ গাড়ী থামালো। শাহেদও পেছনে এসে থামলো। তারপর জিনিসপত্র বের করে মেয়েরা ঘাষের উপর চাদর বিছিয়ে খাবারগুলো এনে রাখলো।
গোল হয়ে বসতে বসতে আকাশ শাহেদকে জিজ্ঞেস করলো গাড়িতে কোন সমস্যা হয়েছিল কি না। শাহেদ প্রথমে বোঝেনি। তার পর যখন বুঝলো স্পিড কমানোর ব্যাপারটা, তখন হেসে বলল খাওয়া শুরু কর, খেতে খেতে বলছি।
পিজার টুকরায় ছোট একটা কামড় দিয়ে শাহেদ সবাইকে বলল, একটা গল্প শোনো। সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে শাহেদের দিকে তাকালো।
শাহেদ বলতে লাগলো, তখন আমি নটরডেমে পড়ি। কলেজের ছাত্র, নুতন পাখনা গজিয়েছে। জীবনকে ইচ্ছে মত উপভোগ করছি। উপভোগের একটা প্রধান ধরন ছিল জোরে গাড়ি চালানো। কতভাবে ব্রেক করা যায় সেটা নিয়ে চলতো রীতিমত গবেষনা।
স্কিড করার শব্দে আমাদের এ্যাপার্টমেন্টের সবাই বুঝতো শাহেদ এসেছে! এয়ারপোর্ট রোড, উত্তরা পেরিয়ে আশুলিয়ার রাস্তা; সবই চষে বেড়াতাম। গাড়ির গতি যেন আমার রক্তে এক অদ্ভুত নেশার সৃষ্টি করতো। আমি যখন গাড়ির এক্সিলেটরে চাপ দিতে থাকতাম, আমার মনে হতো আমি যেন এক্সিলেটরে না, একটু একটু করে কোন মাদক আমার ধমনীতে ঢুকিয়ে দিচ্ছি।
এভাবে চলছিল দিন। এক সময় আমার মনে হলো ঢাকার ব্যাস্ত রাস্তায় কত গতি তোলা সম্ভব সেটা পরীক্ষা করা দরকার।
গুলশান হয়ে নিকেতনের পাশ দিয়ে বের হয়ে তেজগাঁ দিয়ে সরাসরি সোনার গাঁ পর্যন্ত চেষ্টা করলাম কিছু দিন। তেমন সুবিধা করতে পারলাম না। রিক্সা বা গাড়ি সামনে এসেই যায়। তবুও হাল ছাড়িনি। মনেমনে ভাবতাম একদিন ঢাকা শহরের বুকে একশ চল্লিশে গাড়ী চালাবোই।
এক ঈদের দিনে আমার সেই মনের ইচ্ছা পূরন করার অবস্থা আসলো। ঢাকা তখন যেনো ভাঙ্গা হাট। জনমানব নেই। চারদিক ফাকা। বিজয় স্মরনী থেকে সংসদ ভবনের রাস্তা ধরে মিরপুরের দিকে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ মনে হলো একটা চেষ্টা করলে মন্দ হয় না। জিয়া উদ্যানের এক প্রান্ত থেকে স্পিড তুলতে শুরু করলাম, একটু একটু করে স্পিড বাড়ছে, একশ ছাড়িয়ে গিয়েছে বেশ আগেই। একশ বিশও ছাড়িয়ে গিয়েছে। একশ ত্রিশ ছাড়ানোর পর একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ঢাকার বুকে আমি একশ ত্রিশে গাড়ি চালাচ্ছি, ভাবতেই অন্যরকম লাগছিল।
একশ চল্লিশ তখনও ছুঁতে পারিনি, এর মধ্যে একটা ছোট বাচ্চা হঠাৎ রাস্তার আড়াআড়ি বরাবর দৌড় দিল। প্রথমে একটু অবাক হলাম। এই বাচ্চাকেতো আমি দৌড় দেয়ার আগে এক মূহুর্তের জন্যও দেখিনি। আসলো কোথা থেকে বাচ্চাটা? গাড়ির যে গতি, ব্রেক করার মতও অবস্থা নেই। কি করবো ভেবে পেলাম না।
ততক্ষনে রাস্তাও শেষ হয়ে এসেছে। সামনে সিগনালের লাল বাতি দেখা যাচ্ছে। দ্রুত স্বীদ্ধান্ত নিতে হবে। মনেমনে ভাবলাম যা আছে কপালে, ব্রেক করার দরকার নাই। কিভাবে বাচ্চাটা আমার গাড়ির ধাক্কা এড়িয়েছিল সেটা আজও ভাবলে অবাক হই।
সিগনালের লাল বাতিকে উপেক্ষা করে আমি যখন মিরপুর রোডে উঠলাম তখন আমার মনে প্রথম যে অনুভতিটা হয়েছিল সেটা কোন অনুশোচনা নয়; একটা মানুষকে আমি প্রায় হত্যা করে ফেলেছিলাম, সে ভাবনাও আমাকে ঘিরে ধরেনি। আমি শুধু ভেবেছিলাম, ইশ! একশ চল্লিশটা ছোঁয়া হলো না।
গল্পের এ পর্যায়ে শাহেদ লক্ষ্য করলো সবাই ওর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে। রীমার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে গ্লাসে কোক ঢেলে এক ঢোক গলায় চালান করে শাহেদ আবার বলতে শুরু করলো, এর পর কেটে যায় বেশ কিছু দিন। নটরডেমের কুইজ পরীক্ষার চাপ শুরু হয়েছে পুরোদমে।
নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পাচ্ছি না। ফলে স্পিড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমায়িক ভাবে বন্ধ থাকলো।
দেখতে দেখতে কোরবানীর ঈদ চলে আসলো। সবাই মিলে ঠিক করলাম গ্রামেরবাড়ী ঈদ করতে যাবো। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যেন রক্তে আগের সেই উন্মাদনা ফিরিয়ে আনলো।
গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার ভাই। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল, এত আস্তে কেউ গাড়ি চালায়! সাই সাই করে বাসগুলোকে পাশকাটিয়ে এগিয়ে যাবে; তা না, কচ্ছপের মত গাড়ি চলছে।
হঠাৎ দেখলাম একটা জায়গায় লোকের জটলা। একটু আগেই একটা কার এক্সিডেন্ট করেছে। এক ঝলক কারটাকে দেখেছিলাম, ওটা যে কার সেটা বোঝার কোন উপায় ছিল না।
দুমড়েমুচড়ে একটা গোলাকার কিছু হয়ে গিয়েছে। কাউকে যে বের করে আনবে, সে উপায়ও নাই। হতভাগা কোন যাত্রী যদি বেঁচেও থাকে, এভাবেই তাকে একটু একটু করে মৃত্তুকে মেনে নিতে হবে।
আমরা ঠিকঠাক মত গ্রামে পৌছালাম, ঈদ করলাম। ঈদের কয়েকদিন পর পত্রিকা প্রকাশিত হলো।
সেখানে রাস্তায় দেখে আসা এক্সিডেন্টের ছবিসহ সংবাদ আসলো। বন্ধুদের এক দল ঈদ করতে যাচ্ছিল। পথে এই দুর্ঘটনা। পাঁচজন আরোহির সবাই মারা যায়। গাড়ির টিন কেটে লাশ বের করতে হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শিরা জানিয়েছে খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল তারা। যে বাসের সাথে মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়, সেই বাসের আসলে দোষ ছিল না। অন্য একটা বাসকে পাশকাটাতে গিয়ে বাসের সামনে চলে আসে গাড়িটা, ফলে বাস ড্রইভারের কিছুই করার ছিলনা।
পরদিন আমরা ফিরে আসছিলাম ঢাকায়। এক্সিডেন্টের জায়গাটার পাশ দিয়ে আসার সময় দেখতে পেলাম চারপাশ নিরব।
দূরে পড়ে আছে দুমড়ে থাকা গাড়িটা। একটা অদ্ভুত অনুভুতি হলো ভেতরে। ওরা আমাদেরই মত ঈদ করতে যাচ্ছিল। হয়তো আজ আমাদের মত ওরাও ফিরে যেতো নিজ নিজ বাসায়। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের একটা ভুল সব কিছু এলোমেলো করে দিল।
সাথেসাথেই ভাবলাম, আসলেই কি একে ভুল বলা যায়? প্রতিক্ষনেইতো এ কাজ আমি করে চলেছি। আমার মত আরো অনেক ছেলে করে চলেছে। গতির ঝড় তুলছি গাড়ির চাকা এবং আমাদের রক্তে। একবারও কি আমরা ভেবে দেখছি যেকোন মুহুর্তে এর পরিনাম কত ভয়ঙ্কর হতে পারে?
আমার রক্তে মিশে থাকা সে গতির ঝড় সেদিন হঠাৎ করেই থেমে গেল। আমি অনুভব করলাম এ পৃথিবীতে জোরে গাড়ি চালানোর থেকেও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ আমাদের করার আছে।
তারপর শাহেদ একটু থেমে রীমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এ দুচোখে যে ভালোবাসা আছে, এক জীবন তাকিয়ে থেকেও আমি তার সবটুকু নিতে পারবো না। আমি চাইনা সেই একটা জীবনও অনেক ছোট হয়ে যাক।
শাহেদ যখন থামলো তখন সন্ধা নেমে এসেছে। অস্তগামী সূর্যের শেষ রেখাটুকুও মিলিয়ে যাবে অল্প পরেই। দ্রুত কেক কেটে, রীমাকে উইশ করে ওরা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে যখন গাড়িতে উঠলো তখন চার দিকে অদ্ভুত নিরবতা।
সেই নিরব আশুলিয়ার রাস্তা ধরে সেদিন দু্টো গাড়ি শহরের দিকে ফিরে আসছিল। রাস্তা ফাকাই ছিল, তবু কারো গতিই আশির উপরে ছিল না। ওরা জানতো এই পৃথিবীতে দ্রুত গাড়ি চালানোর থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ রয়েছে; দেশের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুদের জন্য, পাশে বসা ভালোবাসার মানুষের জন্য।
৭ জুলাই ২০০৮
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।