সবকিছুতেই নির্মোক থাকছি, সবকিছুই ইদানীং অর্থহীন মনে হয়; নিজের এই নেতিবাচক প্রবণতায় নিজেই লজ্জিত ।:(
গত নভেম্বর এর শেষদিকে| প্রচুর কাজের চাপ,একঘেয়ে দিনযাপন আর অকারন মানসিক অবসাদ- সব মিলিয়ে সবকিছু গুমোট লাগছিলো|
রানা, শুধু তার না সবকিছু ছিড়া বলে আমাদের মাঝে যার খ্যাতি সর্বাধিক (আমাদের অসাধারন অন্যরকম ক্লাসের সবারই কিছু না কিছু মাত্রায় তারছিড়া)- হঠাৎ প্রস্তাব দিলো, চল সিলেট ঘুরে আসি| সঙ্গে পেলাম আসিফকে , আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষসাথী|দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তিনজনই তখন একটি যোগাযোগপ্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের একই বিভাগে কাজ করি| সুতরাং ছুটি? নৈবচ নৈবচ ;
তাই সিদ্বান্ত হলো বৃহঃস্পতিবার রাতে গিয়ে আবার শনিবার রাতে আমরা ফিরে আসবো| এত দ্রুত যাবার সিদ্বান্ত, তাই কোথায় কোথায় যাবো বা কিভাবে এইসব কিছুই ঠিকঠাক না করে বৃহঃস্পতিবার বিকালে অফিস হতেই সরাসরি যাত্রা শুরু হলো|সিলেটে উঠবো আমাদের আরেক সহপাঠী মিলন এর ডেরায় (সেও আমাদের মত আরেক কামলা) |
সিলেট যাবার রাস্তাটা বেশ ভালো, আমরা তিনজনও জমিয়ে আড্ডা দেওয়া শুরু করলাম (অফিসে পাশাপাশি সিট হলেও আমাদের কাজের ধরনের জন্যই খুব বেশি কথাবার্তা হতো না,সিটগুলোই পাশাপাশি থাকে- আমরা না| )| কিন্তু হায়, আমরা যাই বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে| এর মাঝেই রানা‘র ‘ইমার্জেন্সি’ কল – সম্ভবত তার দ্বায়িত্বের কোনো একটা মুঠোবার্তার সিস্টেমে বিঘ্ন ঘটা শুরু হয়েছে| আর কি, আড্ডার দফারফা,মুঠোফোনে প্যাঁচাল পাড়ো ঘন্টাখানিক|
রাতের দেড়টায় পৌছেও ঘন্টাখানিক আড্ডা,তারপর ঠিক হলো সকালে ট্রেনে যাওয়া হবে শ্রীমঙ্গল,আর কিছু দেখা হোক বা না হোক- চা বাগানতো অন্ততঃ দেখা হবে!আমাদের এক সহপাঠী ছিলো শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত, কী আর বলবো, শেষ পর্যন্ত গাধাটার বাড়ী আসলেই সিলেট কিনা সন্দেহ প্রকাশ করেই ফেললাম| কিচ্ছু চিনে না,উফফফ| এইদিকে আসিফ তো ইনিয়েবিনিয়ে সবকিছুর ব্যাখা দেওয়া শুরু করেছে- ওর ভবিষ্য শ্বশুরবাড়ী আবার সিলেট এলাকায় কিনা!
মনের মাঝে টিকটিক করছিলো বহুদিন আগে কোথাও পড়া লাউয়াছড়ার কথা,সেটা তো মনে হয় এইখানে? লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হওয়া গেলো,হ্যাঁ – কমলগঞ্জের রাস্তাতেই পড়বে সেই লাউয়াছড়া| সাথে সাথেই আমার ঘোষনা, কই যাব না যাব পরে , লাউয়াছড়া আগে| কমপক্ষে হলেও জুলভার্নের ‘রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটিন ডেইজ’ এর চিত্ররুপের রানী আউদা’কে (নিশ্চিত নই...) উদ্ধার এর কাহিনির চিত্রায়ন লাউয়াছড়ার যে রেললাইনে হয়েছিলো, তা তো অন্তঃত দেখে আসতে তো হবে|
লাউয়াছড়ায় পৌছুতে পৌছুতে ছায়াময় হয়ে এলো চারপাশ| দুপাশে ঘন বন, প্রচন্ড নিস্তব্দতার মাঝে পোকামাকড়ের ডাকটাও শোনা যাচ্ছে,কি অসাধারণ! সিফ তো বলেই বসলো, ইস অফিসটা যদি এখানে হতো তাহলে দরকার হলে না হয় চব্বিশ ঘন্টাই অফিস করতাম...|বন আমার বরাবরই প্রিয়,
আর এই বনটাকে কেমন জানি অভিজাত গম্ভীর লাগছে, আবার প্রশান্তিময়|
লাউয়াছড়া রিজার্ভ বনে ঢোকার পরে একটা সাইনবোর্ডে বেশকিছু ট্রেইলের নির্দেশনা দেওয়া আছে, কোনোটা এক ঘন্টার, কোনোটা দেড় ঘন্টার এইরকম আর কি| ট্রেইলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দেওয়া আছে| কিন্তু ওইসব মানার বান্দা কি আমরা? চেনা উপায় সর্বদা ব্রাত্য আমাদের কাছে, তার উপর আছে রানার মতো ‘...’ ছিরা, ‘...’ ঢিলে বান্দা! ওই মানচিত্র নিয়ে মিনিট চল্লিশ গরু খোজার (গো-এষণা) পর ঠিক করলাম, আমরা ‘আমাদের’ ট্রেইলে যাবো| ‘আমাদেরটা’ হলো রেললাইন
ধরে কিলোমিটারখানেক যাবার পরে আমরা বামদিকে মোড় নিয়ে হাঁটতে থাকবো, তখন একটা ছড়া পড়বে,সেটা ধরে আধা কিলোমিটার যাবার পরে দুই নাম্বার
ট্রেইল পেলে সেটা অনুসরন করে আবার সোজা বনের ডানদিকের অপেক্ষাকৃত পাতলা অংশে ঘুরে আসবো|
সেই রেললাইন ধরে উদাসমনে চুপচাপ হাটা শুরু করলাম,কথা বলার মতো অবস্থা ছিলো না কারন দুইপাশের বন থেকে টুই টুই...পিটি পিটি...ক্ররররররর... নানা বিচিত্র ডাক ভেসে আসছে| আর কি অসাধারন সৌভাগ্য, মুঠোফোনের কোনো প্রবেশাধিকার নেই| আহা| মনে হচ্ছে ভেসে ভেসে যাচ্ছি, উড়ে উড়ে যাচ্ছি|
আসিফ দুএকবার বলার চেস্টা করছিলো যে, রেললাইনে দুইপাতে দুইজন হাতে হাত রেখে চোখমুঁদে হাঁটতে নাকি একেবারেই অন্যরকম লাগবে , কিন্তু আমরা বাকি দুজন সজোর ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলাম, আমাদের যে ‘দুইজন’ হবার (সৌ/দু)ভাগ্য নেই!
এই নিশ্চুপ হাঁটাহাঁটিতে রানা’র মন মনে হয় আর সায় দিচ্ছিলো না , কারণ কোনো কিছুতেই ওর মন বেশিক্ষন সায় দেয় না , হটাৎ করেই সে ঢুকে পড়লো
বামপাশের এক ঝোঁপে, তারপর ঝোঁপজঙ্গল দিয়ে সটান হাঁটা| গাড়ঁলের মতো আমরাও কোনো কিছু বলা কওয়া ছাড়াই ওর পিছু নিলাম| প্রথমে একটা বাশঁঝাড়, তারপর সামান্য খালি জায়গা পেরিয়ে রানা’র একটা ছোটোখাটো পাহাড়ে উঠার পাঁয়তারা দেখে আমি ক্ষীণকন্ঠে বলার চেস্টা করলাম ‘আমাদের ট্রেইল?’। কিন্তু ওর দার্শনিক বোধ অনেক প্রখর, এককথায় থামিয়ে দিলো এই বলে ‘দুইন্যাটারে একটু দেইখা লই...’| আর কি , ‘দুইন্যাটারে’ আমারও একটু দেখা দরকার এই চিন্তা করে ওর অনুবর্তী হলাম|
কাউ কাউ শুরু করলো আসিফ, কারন খেয়েদেয়ে ও একেবারে ধর্মের ষাঁড় বনে গেছে| রানা’র টিংটিঙ্গে আকার আর আমি এদ্দুর জীবনের প্রায় পুরো জীবনটাই কাটিয়েছি প্রিয় চট্টগ্রামে, ছোট্টবেলায় আমি পাহাড়ে দৌড়ে উঠানামা করতে পারতাম (এইটা আসলেই সত্যি,চাপা না)| হাঁচড়ে পাচড়ে, গোটাকয়েক গাছ মূলশুদ্ধু উপড়ে ফেলে আধাডজন আছাড় খেয়ে যখন আসিফ উপরে উঠলো, চেহারাটা দেখার মতো ছিলো| আহারে রঘুনন্দন! চুক চুক! আমার অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল তা না, বুঝলাম আল্লার দান বলে পেটের ভূড়িটাতে হাত বুলিয়ে ভাব নেয়া আর উচিত হবে না- এইবার দৌড়ঝাপ শুরু করে দেওয়াই ভালো|
তারপর ‘ঘটনা শুরু হইলো’| ওই পাহাড় থেকে গড়িয়ে মড়িয়ে নিচে পড়ে, বাঁশের মোথায় গা ঘষে লাল করে সরু এক নালা পার হয়ে পৌছনোর পর মনে এলো ‘ এ আমি কোথায় আসিয়াছি?’
বিশাল এক গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে, কাঁটাঝোপের আস্তানা , তিনপাশে পাহাড় আর সাথে বোনাস হিসাবে শ্রীমঙ্গল এর বিখ্যাত বৃস্টি... | কোনো মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই
( এইবার মনে হচ্ছে অভিশাপ!) কম্পাস নাই, তিনজনই দিক ভুলে বসে আছি,কাঁটাঝোপ আর জ়োঁকের দল ‘অ-তিথি’ পেয়ে ভালোই সৎকার শুরু করলো|ওই জ়োঁকের বাচ্চাদের আদর আমার গায়ে পরের সপ্তাহ পর্যন্ত ছিলো| আর সম্ভব অসম্ভব জায়গায় জ়োঁক কল্পনা করে কতবার যে লাফাচ্ছিলাম আল্লা মাবুদ|বিশেষ কিছু জায়গায় জ়োঁকের অনুপ্রবেশের কাহিনি (অবশ্যই বানানো) বয়ান করে আসিফের দুহাতকে বিশেষ দুজায়গায় ব্যস্ত রাখার ব্যাবস্থা করে যা একটু শান্তি পাওয়া|
গালি কী রানাকে দেবো না নিজেকে এই চিন্তা করতে করতে আরেকটু এগুলাম, আসিফ এর মাঝে মা বাবা সবাইকে ডেকে ফেলেছে (ওর ইয়েকে ডাকাটাই বাকি রেখেছে...),দুটো ডাল ভেঙ্গে নিয়ে ঝোঁপ সাফ করতে করতে এগুচ্ছি আর এই বৃস্টির মাঝেও দরদর করে ঘামছি| হঠাৎ আসিফের প্রশ্ন ‘এই বনে কি কি থাকে রে?’
যদ্দুর জানি লাউয়াছড়ার বিখ্যাত প্রানী হলো উল্লুক, খুব একটা ভাব নিয়ে উল্লুক এর সাথে সজারু, আজগর (চাপা!), বিশাল ভাল্লুক (চাপা!),মেছোবাঘ(চাপা!) যোগ করে দিলাম| বুদ্ধিজীবি হিসাবে আমার পরিচিতি ভালই তাছাড়া এখানে গুগল সার্চও নাই যে সার্চ দিবে,সুতরাং তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় ঘন ঘন আছাড় খাওয়া আর কাঁদো কাঁদো গলায় শাপ`শাপান্ত শুরু হলো| রানা ইতিমধ্যে আরেকটা বিতিকিচ্ছিরি (আমার তখনকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া) পাহাড়ে চড়ে ( তালপাতার সেপাই শরীরটা নিয়ে যেভাবে বান্দরের মতো উঠে গেলো তাতে তাই মনে হয়) আরেকটা নির্লিপ্ত দার্শনিক ঘোষনা দিল ‘দুইন্যাতে বিস্টি আর জঙ্গল ছাড়া আর কিচ্ছু নাই!’
সঙ্গে সঙ্গে প্রতি ঘোষনা আসিফের ‘শালারে নামাইয়া কাঁটার জঙ্গলে ফেল্|’
সারাজীবনের যতো অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর রোমাঞ্চ , সব দর দর ঘাম দিয়ে বেরোচ্ছে,মনে হচ্ছে তিন গোয়েন্দা এখানে আসলে এতোক্ষনে সবার চৌদ্দগুস্টির নাম জপত |
যাই হোক , একটা শুকনো ছড়া খুজে পেয়ে ওইটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে কিমাঃ অবাকমঃ!! রেললাইন দেখা যায়!!! খুশির চোটে তিনজন তিনজনের গলা ধরে ঝুলতে থাকি...এতোক্ষনের ভয়-উদ্বেগ সব সরে গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব আসতে থাকে,মনে হয় ‘কি জানি কি কইরা ফালাইছি!!’
দুর্ভোগের কি শেষ আছে? রেললাইনে উঠে আবার বেকুব বনে যাই সবাই, যাবো কোনদিকে? একদিকে গেলে লাউয়াছড়ার প্রবেশমুখ, আরেকদিকে আবার বন......,অবশেষে আরোহ অবরোহ অনুরোহ-উৎরোহ (যদি থাকে) সব পদ্ধতির ঘোল খেয়ে এক ভাঙ্গা বাঁশের সৌজন্যে আমরা তিনজন পিচের সভ্যতায় ফিরে আসি |
বৃস্টিভেজা গর্বিত মাথাউচুঁ গাছগুলোকে পেছনে ফিরে বলি , ‘আবার আসবো সময় নিয়ে , আবারো পথ হারানোর জন্য|’
পুনশ্চঃ
ছোট্টবেলা হতে পাহাড় আর বনের সাথে গলাগলি
করে বড় হয়েও অন্যরা যা পারেনি লাউয়াছড়া তা পেরেছে,কেনো জানি না এক অদ্ভুত মুগ্ধতা তার প্রতি| লাউয়াছড়ায় চলছে এখন তেল-গ্যাসের জন্য ধংসপ্রবন জরিপ| উন্নয়নের বিরোধী আমি নই, কিন্তু তার জন্য সর্বোচ্য কতটুকু মূল্য আমরা দেব তা আমাদের তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হবে|
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।