সত্যবাদী
একজন গল্পকারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তার রচিত চরিত্র গুলো প্রাণ পায়; স্বাধীনতা পায় না। পাণ্ডুলিপিতে আটকা পড়া আমার প্রিয় মানুষেরা, ফেলুদা, কিশোর, কাকাবাবু, হিমু, টিনটিন, মিসির আলী, শার্লক হোমস; যাদের স্রস্টারা তাদের মুক্তি দিয়ে যাননি। স্তূপ করা প্রিয় বইগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। প্রতিটি ঘটনা আমার জানা, মুখস্ত করেছি বারবার পড়ে। জটায়ু তার প্রখর রুদ্রের গল্পের প্লট খুজতে বের হবেন না কখনও নতুন কোন অভিযানে।
কেমন যেন একঘেয়ে লাগে আজকাল। হাউন্ড অভ বাস্কারভিল প্রথম যখন পড়েছিলাম, কি রোমাঞ্চ; আর এখন; অমনিবাস টা সাথেই আছে, খুলতে ইচ্ছে করেনি বিগত দশ মাসে। আমি কখনই খুব একটা কাব্য প্রেমী ছিলাম না। তবে এইবার অনেকটা বিরক্ত হয়েই মুখ ফেরালাম সেইদিকে। প্রথম প্রথম অর্থহীন প্রলাপ মনে হত; চোখের পর্দা পেরিয়ে মস্তিষ্কে কোন আলোড়ন উঠতোনা।
তবে একদিন এর ব্যতিক্রম ঘটলো। আমার সাক্ষাৎ জীবনানন্দ দাসের সাথে হল। সাক্ষাৎ বলছি এই কারণে, এর আগে তার কিছু সৃষ্টির সাথে পরিচয় ছিল, আত্মীয়তা ছিল না। এইবার অফুরন্ত সময় থাকায় কিছু লেখা আমার মস্তিষ্কের গভীরে চলে গেল। এই ভদ্রলোকের অসীম কল্পনা শক্তি অনুভব করলাম।
একজন গল্পকার আর একজন কবির মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারলাম আবছা ভাবে। একজন কবি চাইলে তার পাঠককে স্বাধীন করে দিতে পারেন। আমার মত ভোতা একজনের মাথায় উনি ঢুকিয়ে দিলেন "যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের.। । " আরে তাইতো, এই একটি বাক্যের মধ্যে কত হাজার গল্প লুকিয়ে আছে! অনেকটা যেন, বিশাল এক অমনিবাস খুলে ধরলেন তিনি আমার সামনে।
যাপিত জীবন থেকেই গল্প খুজে পেলাম, একটি আবেগঘন উপন্যাস শেষ করবার আনন্দ পেলাম। আবার আমার কাব্য বোদ্ধা আরেক বন্ধু এইটার অন্য মানে খুজে পেলেন, সেটাও কোন অমনিবাসের চেয়ে কম নয়! মহা উৎসাহে এইবার আমি কাব্যানুসন্ধানে লেগে গেলাম। কিন্তু সমস্যা হল, বেশির ভাগ ভাব বোধ আমার মাথার অনেক উপর দিয়ে যায়। হয়ত কোন গোপন কোডেড ম্যসেজ; মাসুদ রানা টাইপ ব্যপার! অথবা নিতান্তই কবির মনের মহাজাগতিক অলিগলির ছিটেফোটা! তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কাব্য নিজের মত করে বুঝতে পেরে বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করতাম, ঠিক প্রথমবার পড়া ফেলুদার বইয়ের মত। তবে সবচেয়ে যেটা আমাকে বিমোহিত করতে লাগল, সেটা হচ্ছে আমি প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে তার স্রস্টার অনুভুতি খুজে পেতাম।
খুশির দিনের কাব্য এক রকম, বিরক্তির দিনেরটা আরেক রকম। সব চেয়ে কষ্টদায়ক ছিল, আরোপিত কাব্য গুলো। হয়ত লিখতে হয় বলেই লেখা টাইপ কাব্য (যেমন এখন আমি এই হাবি জাবি লিখছি!) জীবন বাবু নিজেকে সন্তুষ্ট করতে লিখতেন, অন্তত তার জীবনী পড়ে তাই মনে হল। যদিও আমি সেটা তার লেখা পরবার সময় উপলব্ধি করেছি। জীবনের চরম সত্য হচ্ছে আমরা সব সময় যা ভালবাসি, তা করিনা।
অথবা যা ভালবাসি, তাকে পন্য করে বেচতে চাই। অন্তত কিছু কবির কবিতা (যেগুলো আমি বুঝতে পেরেছি!!) আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
এই পর্যায়ে এসে আমার উপলব্ধি হল, আসলে আমার লেখাকে স্বাধীন করতে হলে, প্রাণ দিতে হলে, আমার নিজেকে প্রথমে স্বাধীন হতে হবে। এবং কবিতা বা গল্প মানেই দুর্বোধ্য কিছু নিয়ম মানা শব্দের সাজানো গোছানও সারী নয়। বরং লেখকের মনের শুদ্ধতার প্রকাশ শুধু।
সব কিছুর উর্ধে মনের শুদ্ধতা, তার পড়ে বাকি সব। সৃষ্টিশীলতার মুলে এই শুদ্ধতা, যেটা না থাকলে আমার মত ভোতা পাঠকের কাছেও ধরা খেয়ে যাবে সেটা একসময়।
আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন বড় হয়ে যাই হও না কেন, ভাল মানুষ হওয়াটা সবচেয়ে জরুরী। আসলেই তাই মনে হয়। যা কিছু শুদ্ধ মনে করা হয়, তা মন ছুয়ে যায়।
আমরা সারাদিন কত হাবি জাবি কাজে নিজেদের ব্যাস্ত রাখি। একটু সময় নিয়ে ভবে দেখা উচিৎ, আসলে আমরা এই কাজগুলো কেন করছি। আমার এই হাবিজাবি লেখাটা কি উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল তা বলতে পারবনা এখন! তবে শেষটা এসে আবার সেই উপদেশ হয়ে গেল। তবে একজনও যদি এই পর্যন্ত পড়ে শেষ করে কাল থেকে মনের শুদ্ধতার দিকে নজর দেয়, তাহলে আমার লেখার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি সার্থক। না হলেও কোনও ক্ষতি নাই।
সবাই ভাল থাকুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।