বিস্মৃতি ও বিষাদটিলা
এক রকমের অনির্দিষ্ট, আকাক্সক্ষাচূর্ণের বহুবর্ণিল অভিঘাতে তৈরী পথের মধ্য দিয়ে আমরা এখনকার কবিতার একটি ধারাকে যেতে দেখি, যা মূলত কবিতাকে তার গতিপথ বদলাতে, সামান্য হলেও বাধ্য করেছে। এই ধারার কবিতা যুক্তির শৃংঙ্খল মানতে চায়না, তার ঘাড়ে চাপিয়ে নিতে চায়না কোনো দায়িত্ব , এমনকী কোথাও কোথাও নিজেকে অস্বীকার করে নিজেই নিজেকে পূণর্মূল্যায়ন করে নিতে চায়। যিনি কবি, তিনি এর সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেন, তাও নয়, তাঁর কাজ শুধু নতুন কবিতা লেখা হলেও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়েই তাকে কবিতা লিখতে হয়। নতুন পথ এতে সৃষ্টি হয় না, এই ধরনের দবি করা পরোক্ষে বাতুলতার শামিল, বরং একটি যৌথ অভিজ্ঞানের মধ্যে থেকেও একজন কবি অন্যান্য কবিদের চেয়ে কতোটা আলাদা হতে পারেন। পাখি ও প্রিজম তেমনই এক গ্রন্থ।
যে কোনো ভালো কাব্যগ্রন্থেরই একটি জগৎ থাকে, থাকে কবির দৃষ্টিভঙ্গির বিশিষ্ট নমুনা। কবির স্বকীয়তা ও চারুদক্ষতা কবিকে যেমন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তুলতে সাহায্য করে , তেমনি স্বতশ্চলভাবেই গড়ে ওঠে তাঁর জগৎ। রাশেদুজ্জামানের এই গ্রন্থটিকে পাঠ করতে গিয়ে দ্বিতীয় কবিতাটিতেই লক্ষ্য করি ‘এইখানে/ ফুল নয়, ফুটে আছে ফুলের বিভ্রম’। মনে পড়ে, প্রথম কবিতাতেই পড়েছি ‘পাখি হয়ে ওড়ে ঝরাপাতা/ ঝরাপাতা হয়ে ওড়ে পাখিস্মৃতি’। বুঝতে কষ্ট হয়না, এই দুটি পংক্তিই এই কবির চারিত্র্যধর্মের আভাসদাতা।
ফুল নয়, ফুটে আছে ফুলের বিভ্রম- অংশটুকু পড়ে কি আমরা বুঝে নেব, এই কবির যে টুকু অভিজ্ঞতা ও অনুধাবন, তা তার বিশেষ পর্যবেক্ষন-লব্ধ; কবিতা এখানে বাস্তব/অবাস্তব,যুক্তি/ যুক্তিহীনতা- কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না, কবিতা শুধু কবির নিজস্ব জগৎ থেকে উৎসরিত হচ্ছে, পৌছে যাচ্ছে এমন এক উচ্চতায়,যেখানে এর নিরেট অর্থ-মূল্যের দিকে পাঠক তাকিয়ে থাকতে পারেন না। এখন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, এই প্রগাঢ়তা খোদ কবিকে কতটা জারিত করেছে। ঐ সিরিজের পরবর্তী কবিতাতেই যখন কবি লিখছেন,‘আমার গল্পের মধ্য থেকে আমি ছড়িয়ে পড়ছি.../অন্য গল্পে, গল্পহীনতায়’ তখন রাশেদুজ্জামানের কবি-ব্যাক্তিত্বের মূখ্য দিকগুলোর একটা ইশারা আমরা পেয়ে যাই এবং পুরো গ্রন্থ পড়ে শেষ করলে দেখতে পাবো, এই ইশারা ক্রমশই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে।
এর মধ্য দিয়েই চলতে থাকে স্বাদ গ্রহনের পালা, বলা যেতে পারে, সেটা বেশ বিচিত্র ও বৈভবে সমৃদ্ধ। পড়তে পড়তে হাওয়া আর জল কবিতাটিতে, ‘তবু আজ জেনে নিতে চাই, কার মুখ/ কার মূর্তি জেগে আছে, জলের ভেতরে কার কণ্ঠস্বর?’এবং ঠিক তার পরের পংক্তি, ‘পড়ে আছি আমিÑ কোনো স্থাপত্যের ভুল,অসংলগ্ন বাহু!’ তখন বুঝি প্রচল নস্টালজিয়ার আঙ্গিনাকেও নিজ কবিকৃতীর বলেই কবি একটা নতুন রুপ দিতে পারেন, এক্ষেত্রে তা যে তার জন্য খুব আয়াস-সাধ্য , তাও নয়।
মানে, একটা সহজাতভাবের ছোয়া আছে তার এই জাতীয় কবিতাগুলোর মধ্যে। আরেকটি কবিতার কথা (জলে ভাসিয়েছে ফুল) বিশেষভাবে বলা যায়, যেখানে পুষ্পস্রোত সুর হয়ে আসে,একটি লক্ষ্যচ্যুত মাছ কোঁচবিদ্ধ হয়ে উঠে আসে একটি কুসুম। এভাবেই সৌন্দর্যের, অযৌক্তিক কবিতাবিশ্বের একট গাঢ় পরম্পরায় আমরা রাশেদুজ্জামানের যাত্রা পথের সাক্ষী হয়ে উঠতে থাকি। কবিতার নানান বৈচিত্র্যে তিনি আমাদের প্রবেশ করান, কোথাও আমরা আনন্দ পাই, কোথাও পেয়ে উঠি না। বইটির মধ্যখানে এমন অনেক কবিতাই আছে, যেখানে ছন্দকে ব্যবহার করা অযৌক্তিক মনে হয়েছে।
অযৌক্তিক কারণ, কবিতা ছন্দকে নিয়ন্ত্রন করবে, ছন্দ কবিতাকে নয়। ছন্দ কবিতাকে নিয়›ত্রন করার ফলে, ‘শিরোপা জয়ের স্মৃতি’ থেকে শুরু করে ‘বকুল বকুল’ পর্যন্ত কবিতাগুলো প্রগাঢ় কবিতার কোনো মূর্তি পায়নি বলেই মনে হয়(অথচ সেসবের অধিকাংশের আকাক্সক্ষা প্রগাঢ় কবিতার দিকেই)। এর কারণ বোধহয় এটা যে,কবিতাগুলোর যে ভাববস্তু, তাতে পয়ার বা অন্যান্য ছন্দতে তারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারেনি, মূল কবিতাটার চাইতে ছন্দের শরীরটাই বেশি বোঝা গেছে এবং সন্দেহ নেই, ছন্দের সেই শরীর কবিতাগুলোকে কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রন করেছে। এটি কবির জন্য তো বটেই, পাঠকের জন্যও বেশ হতাশার। অনেক উদ্ধৃতিযোগ্য পংক্তি আছে ঐ কবিতাগুলোর মধ্যে কিন্তু তার সাথে সাথে এও সত্য যে, কবির যে সাবলীলতার ইংগিত আমি একটু আগে করেছিলাম, তাও বেশ ক্ষুন্ন হয়েছে।
ছন্দের সাথে কবিতার ভাববস্তুর সম্পূর্ণ ঐক্যতান না ঘটলে যে অভিজ্ঞতা হয় পাঠকের, এই কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সেরকমেরই ।
বইয়ের শেষদিকে গদ্যকবিতাগুলোর দিকে তাকালে এই সত্য আরো প্রকট হয়ে ধরা দেয়। গদ্যকতিাগুলোতে আবার রাশেদুজ্জামানকে এতোটাই সাবলীলভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে দেখি, যেখানে অভিজ্ঞতা থেকে অনুধাবন, কল্পনা থেকে প্রজ্ঞায় পৌঁছাতে তাকে খুব বেশি কসরৎ করতে হয় না। বরং এই কবিতাগুলো যেন এই কবির নিয়তি, এর ভাষা আমাদের এরকমই বলে দেয়। ‘রূপসী হরিণরি ছদ্মবেশে মৃত্যু এসেছিলো’ কবিতায় তিনি যখন বলে ওঠেন, ‘চিরকাল শুন্যপ্রবাহের মুখোমুখি হওয়ার নাম স্নান’ তখন তাঁর কবিতার যে জগতের মধ্যে আমরা বসবাস করছি, তা যেন আরো স্পষ্ট ভাবে আমাদের কাছে প্রতিভাত হতে শুরু করে।
গদ্য কবিতাগুলোতে কবির এই যাত্রা এরা গাঢ়তর বোধের দিকে আমদের পৌছে দেয় যখন আমরা এর ভাষার দিকটাকে একটু বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। দেখা যায়, কী এক আশ্চর্য যাদুবলে ভাষা তৈরী হচ্ছে, নিরবতা যেন তার রক্ষাকবচ। ‘আমার স্মৃতির ভেতর তোমার হিমডানা আমি টের পাই , মেঘ’(মেঘ)--মুহূর্তেই তৈরী হয় ভাষা, এক আশ্চর্য টানে পুরো কবিতাটাই আমাদের পড়িয়ে নেয় এবং পাঠ যখন শেষ হয়, ‘যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর এমন বৃষ্টি নেমেছিরো, মনে পড়ে’ এই পংক্তিটি দিয়ে, তখন, এই ‘মনে পড়ে’ শব্দদুটির কাছে এসে আমরা যেন আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। এক আশ্চর্য মুহূর্ত তৈরী হয় তখন, সে মুহূর্তটি আমাদের অন্যতর স্নানে সিক্ত করে। খুব উল্লেখযোগ্য ঘোড়া কবিতাটি, যার সুর , চারুদক্ষতা মনে রাখার মতো।
রাশেদুজ্জামানের ক্ষমতার মূল দিক বোধের প্রগাঢ়ত্বে,বহুরৈখিকতায়, সুর সৃষ্টিতে এবং চারুদক্ষতায়। কবিতার সব আয়ুধই তিনি বহন করবেন, এ তার কষ্টকল্পনা। সেসব ছাড়াও যে একদম নতুনভাবে ভেবে নিয়ে কবিতা লেখা যায়, এবং তা যে গ্রহনযোগ্য ও হয়ে ওঠে-- এই গ্রন্থ সেটারই প্রমাণ। কবি হিশেবে এই সত্যটুকু মনে রাখা, বোধকরি,তার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
পাখি ও প্রিজম।
। রাশেদুজ্জামান। । প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান। ।
প্রকাশক: র্যামন পাবলিশার্স। । মূল্য: ৮০ টাকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।