অনুভুতিহীন জীবনের অপেক্ষায়... http://www.raatmojur.com/
অ-জানি দেশের না-জানি কী : পর্ব ০১
রাত হতেই রাজকুমারী মারিয়া খুলে বসল তার যাদুর বই। পড়ে পড়ে তারপর বই ফেলে মাথায়হাত দিয়ে বসল : রাজামশাইয়ের কাজটার কথা বইয়ে কিছুই লেখা নেই। তখন রাজকুমারী মারিয়া অলিন্দে গিয়ে রুমাল বের করে নাড়তে লাগল। অমনি উড়ে এল যত পাখি, ছুটে এল যত পশু।
রাজকুমারী মারিয়া বলল:
"বনের পশু, আকাশের পাখি বলো তো! পশু - তোমরে সব জায়গায় চরে বেড়াও, পাখি - তোমরা সব জায়গায় উড়ে বেড়াও।
শোননি কখনো কী করে অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী আনা যায়?"
পশুপাখির দল বলল:
"না রাজকুমারী, আমরা সে কথা শুনিনি। "
আবার রুমাল নাড়ল রাজকুমারী মারিয়া। পশুপাখির দল নিমেষের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। রাজকুমারী তৃতীয়বার রুমাল নাড়তেই এসে দাঁড়াল দুই দৈত্য।
"কী আজ্ঞা, কী হুকুম?"
"বিশ্বাসী দাসেরা আমার, নিয়ে চলো আমায় মহা সমুদ্রের মাঝখানে।
"
দৈত্যদুটো রাজকুমারী মারিয়াকে ধরে মহাসমুদ্রের ঠিক মাঝখানে নিয়ে গেল গভীর জলের ওপর। রাজকুমারী মারিয়া একবার রুমাল নাড়তেই সমুদ্রের যত মাছ, যত প্রানী সব এসে হাজির।
"সমুদ্দুরের মাছ, সমুদ্দুরের প্রানী, তোমারা সবখানে সাঁতরে বেড়াও, সব দ্বীপে যাও, শোননি কখোনো কী করে অ-জানি দেশে গিয়ে না-জানি কী আনা যায়?"
"না রাজকুমারী, আমরা সে কথা শুনিনি। "
মুষড়ে পড়ল রাজকুমারী মারিয়া। দৈত্য দুটোকে বলল বাড়ী নিয়ে যেতে।
দৈত্য দুটো তাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে নালিয়ে দিল বাড়ীর অলিন্দে।
পরদিন সকালে আন্দ্রেইকে বিদায় দেবার জন্য রাজকুমারী মারিয়া তাড়াতাড়ি ঘুম ছেড়ে উঠল। তারপর আন্দ্রেইকে এক সুতোর গোলা আর একটা নক্সাকাটা গামছা দিয়ে বলল:
"সামনে এই সুতোর গোলা গড়িয়ে দেবে। ওটা যে দিকে গড়াবে সে দিকে যেও। আর যেখানেই থাকো হাতমুখ ধোবার সময় পরের গামছায় মুছোনা, আমার গামছায় মুছো।
"
আন্দ্রেই রাজকুমারী মারিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চারিদিকে নমস্কার করে সহরের ফটক পার হলো। তারপর সুতোর গোলা গড়িয়ে দিল সামনে। সুতোর গোলা গড়ায়, আন্দ্রেইও পিছন পিছন যায়।
বলতে এতটুকু কিন্তু করতে এতখানি। চলতে চলতে আন্দ্রেই কত রাজ্য, কত আজব দেশ পেরিয়ে গেল।
সুতোর গোলা গড়াতে গড়াতে ছোট হয়ে ক্রমে একেবারে মুরগীর ডিমের মতো হয়ে গেল। তারপর এতো ছোট হয়ে গেল যে আর চোখেই পড়েনা... আন্দ্রেই তখন একটা বনের কাছে এসে দেখে মুরগীর পায়ের উপর একটা ছোট কুঁড়েঘর।
আন্দ্রেই বলল, "কুঁড়েঘর, ও কুঁড়েঘর, বনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াও তো!"
কুঁড়েঘর ঘুরে গেল। আন্দ্রেই ঘরে ঢুকে দেখে, এক পাকাচুলো বুড়ী ডাইনী বেন্ঞিতে বসে হবে টাকু ঘোরাচ্ছে।
"হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ, রুশীর গন্ধ পাঁউ! কখনো চোখে দেখিনি যারে, সে দেখি এল আমার দ্বারে।
জ্যান্ত তোকে ভেজে খাব, হাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াব। "
আন্দ্রেই বলল:
"হয়েছে, হয়েছে বুড়ী বাবা-ইয়াগা। হঠাৎ ভবঘুরেকে খাওয়ার শখ কেন? ভবঘুরেরতো কেবল হাড্ডি-চামড়াই সার। আগে চানের জল গরম করো, ধোয়াও, চান করাও, তারপর খেও। "
বাবা-ইয়াগা তো চানের আগুন জ্বেলে জল গরম করলো।
আর আন্দ্রেই গা ধুয়ে বেরিয়ে এল বৌয়ের দেওয়া গামছায় গা মুছতে মুছতে।
বাবা-ইয়াগা জিজ্ঞেস করল:
"এ গামছা তুমি পেলে কি করে? এ যে দেখি আমার মেয়ের হাতের নক্সা তোলা!"
"তোমার মেয়েই যে আমার বৌ। সেই আমাকে গামছাটা দিয়েছে। "
"ও তাই নাকি বাছা! এসো এসো, তুমি যে আমার কত আদরের জামাই!"
বাবা-ইয়াগা তাড়াতাড়ি ব্যাস্ত হয়ে কত রকম খাবার, কত রকম পানীয়, কত রকমের সব ভালো ভালো জিনিষ টেবিলের উপর সাজিয়ে দিল। আন্দ্রেই কোন ভণিতা না করেই খাবার কাজে লেগে গেল।
বাবা-ইয়াগা পাশে বসে বসে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কী করে আন্দ্রেই রাজকুমারী মারিয়াকে বিয়ে করল, তারা বেশ সুখেস্বচ্ছন্দে আছে কিনা। আন্দ্রেই সব কথা তাকে জানাল। তারপর রাজা যে তাকে অ-জানি দেশের না-জানি কী আনতে পাঠিয়েছে সে কথাও বলল।
আন্দ্রেই বলল, "তুমি যদি আমায় একটু সাহায্য করতে বুড়ী। "
"কী আর বলব বাছা, হায় হায়, এমন তাজ্জবের তাজ্জব, আমিও কখনো শুনিনি।
ও কথা জানে কেবল এক বুড়ী ব্যাঙ। সে আগ তিনশ বছর হলো জলায় বাস করছে... যাকগে, কিছু ভেবনা, শুতে যাও, রাতপোয়ালে বুদ্ধি খোলে। "
আন্দ্রেই শুয়ে পড়ল আর বাবা-ইয়াগা দুটো বার্চ গাছের ঝাঁটা নিয়ে উড়ে চলে গেল সেই জলার কাছে। সেখানে গিয়র ডেকে বলল:
"ঘাঙর-ঘাঙ, বুড়ী ব্যাঙ, বেঁচে আছো?"
"আছি। "
"বেরিয়ে এসো জলা থেকে।
"
জলার ভতর থেকে বেরিয়ে এলো বুড়ী ব্যাঙ। বাবা-ইয়াগা বলল:
"না-জানি কী কোথায় জানো কি?"
"জানি। "
"তাহলে দয়া করে বলে দাও কোথায়? আমার জামাইকে রাজা অ-জানি দেশ থেকে না-জানি কী আনতে পাঠিয়েছেন। "
বুড়ী ব্যাঙ বলল:
"আমি নিজেই তাকে নিয়ে যেতুম, কিন্তু ব্ডড বুড়ো হয়ে পড়েছি। অতটা লাফের সাধ্যি নেই।
তোমার জামাইকে বলো আমায় এক ভাঁড় টাটকা দুধের মধ্যে করে নিয়ে যাক জ্বলন্ত নদীতে। তখন বলবো। "
বাবা-ইয়াগা ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ বুড়ী ব্যাঙকর নিয়ে উড়ে এল বাড়ী। আক ভাঁড় টাটকা দুধ দুইয়ে বুড়ী ব্যাঙকে তার মধ্যে রাখল। পরদিন খুব ভোরে আন্দ্রেইকে তুলে দিয়ে বলল:
"তা, জামাই তৈরী হয়ে নাও, টাটকা দুধের ভাঁড়টা ধরো,এতে বুড়ী ব্যাঙ আছে।
আমার ঘোড়ায় চড়ে চলে যাও জ্বলন্ত নদীতে। সেখানে ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে বুড়ী ব্যাঙকে ভাঁড় থেকে বের কোরো। বুড়ী ব্যাঙ তোমায় সব বলে দেবে। "
আন্দ্রেই তৈরী হয়ে ভাঁড়টা হাতে নিল, তারপর বাবা-ইয়াগার ঘোড়ায় চড়ে রওনা দিল। অনেক দিন, নাকি অল্প দিন, শেষ পর্যন্ত জ্বলন্ত নদীর কাছে পৌঁছলো আন্দ্রেই।
সে নদী লাফিয়ে পেরবে এমন জন্তু নেই, উড়ে যাবে এমন পাখি নেই।
আন্দ্রেই ঘোড়া থেকে নামতে বুড়ী ব্যাঙ বলল:
"এবার বাছা, আমায় ভাঁড় থেকে বের করে নাও। নদী পেরতে হবে। "
আন্দ্রেই বুড়ী ব্যাঙকে ভাঁড় থেকে বের করে মাটিতে রাখলো।
"এবার সুজন, আমার পিঠে চড়ে বসো।
"
"সেকি দিদিমা! তুমি যে এতটুকু! আমার চাপে পিষে যাবে। "
"ভয় নেই, কিছু হবে না, ভালো করে ধরে থেকো। "
বুড়ী ব্যাঙের পিঠে চেপে বসল আন্দ্রেই। ব্যাঙ অমনি নিজেকে ফোলাতে শুরু করল। ফুলতে ফুলতে একটা বিচালির আঁটির মতো বড় হয়ে উঠল ব্যাঙ।
"চেপে ধরেছো তো শক্ত করে?"
"হ্যাঁ দিদিমা, ধরেছি। "
আবার ফুলতে শুরু করলো ব্যাঙ। ফুলতে ফুলটে বড়ো হয়ে গেল একটা বিচালির গাদার মতো।
"চেপে ধরেছো তো শক্ত করে?"
"হ্যাঁ দিদিমা, ধরেছি। "
আবার ফুলতে শুরু করলো ব্যাঙ।
ফুলতে ফুলতে এবার সে ঘন বনের চেয়েও উঁচু হয়ে গেল।
তারপর এক লাফে একেবারে জ্বলন্ত নদীর ওপারে। ওপারে গিয়ে আন্দ্রেইকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়ে সে আবার আগে মতো ছোটটি হয়ে গেল।
"চলে যাও সুজন, এই পায়ে হাঁটা পথ ধরে, দেখবে এক কোঠা বাড়ী - অথচ কোঠা নয়, কুঁড়েঘর - অথচ কুঁড়ে নয়, চালা - অথচ চালা নয়। গিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে চুল্লীর পিছনে দাঁড়িয়ে থেকো।
সেখানেই পাবে না-জানি কী। "
পথ ধরে চলল আন্দ্রেই, দেখে এক পুরোনো কুঁড়েঘর - কিন্তু কুঁড়ে নয়। জানালা নেই, অলিন্দ নেই, বেড়া দিয়ে ঘেরা। আন্দ্রেই ভিতরে ঢুকে চুল্লীর পিছনে লুকিয়ে রইল।
একটু পরেই বনের মধ্যে হুড়মুড় ঘড়ঘড় শব্দ।
ঘরে এসে ঢুকল এক বুড়ো আঙ্গুলে দাদা, তার দাড়ি সাদা সাদা। ঢুকেই চীৎকার করে উঠল:
"ওহে নাউম বেয়াই, খেতে দাও!"
মুখ থেকে কথা খসতে না খসতেই শূন্যি থেকে একটা টেবিল এসে হাজির। টেবিলের ওপর এক পিপে বিয়র আর আকটা রোষ্ট করা ধারো ছুরি বেঁধানো আস্ত ষাঁড়। দাড়ি শাদা-শাদা বুড়ো আঙ্গুলে দাদা, ষাঁড়টার সামনে বসে ধারালো ছুরিটা বের করে মাংস কাটে, রসুন ঘষে, খায় দায়, তারিফ করে।
ষাঁড়টার আপাদমস্তক শেষ করল সে, বিয়রের পিপে খালি করে দিল।
বলল:
"ওহে নাউম বেয়াই, এঁটো পরিষ্কার করে নাও। "
অমনি সঙ্গে সঙ্গে হাড়গোড়, বিয়রের পিপে শুদ্ধ কোথায় মিলিয়ে গেল টেবিলটা... বুড়ো আঙ্গুলে দাদা কতক্ষনে বেরিয়ে যায় আন্দ্রেই সেই অপেক্ষায় রইল। তারপর বেরিয়ে যেতেই চুল্লীর পিছন থেকে বেরিয়ে এসে ভরসা করে ডেকেই ফেলল:
"নাউম বেয়াই, আমায় কিছু খেতে দাও..."
কথাটা মুখ থেকে বেরতেই না বেরতেই কোত্থেকে যেন একটা টেবিল এসে গেল। আর তার উপর কত রকম খাবার দাবার, মধু মদ।
আন্দ্রেই টেবলে বসে বললে:
"নাউম বেয়াই, তুমিও বস, একসাথে খাওয়া যাক।
"
কাউকে দেখা গেল না, কিন্তু উত্তর এল:
"ধন্যবাদ তোমায়, সুজন! কত বছর ধরে এখানে কাজ করছি, কিন্তু কেউ কোন দিন আমায় একটুকরো পোড়া রুটিও খেতে দেয়নি। আর তুমি আমাকে টেবিলে খেতে ডাকলে!"
আন্দ্রেই তো হতবাক! কাউকে দেখা যাচ্ছে না অথচ খাবার গুলো যেন ঝেঁটিয়ে সাফ হচ্ছে। আপনা থেকেই মদ আর মধুতে গেলাশ ভরে উঠছে। আপনা থেকেই খুটখুট করছে গেলাশ।
আন্দ্রেই বলল:
"নাউম বেয়াই, একবার দেখা দাও না!"
"না, আমাকে তো দেখা যায় না।
আমি হলাম না-জানি কী। "
"নাউম বেয়াই, তুমি আমার কাছে কাজ করবে?"
"করব না কেন? দেখছি, লোকটা তুমি ভালো। "
খাওয়া শেষ হলে আন্দ্রেই বলল:
"টেবিলটা পরিষ্কার করে চলো আমার সঙ্গে। "
কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে আন্দ্রেই আশেপাশে তাকাল।
"নাউম বেয়াই, আছোতো এখানে?"
"হ্যঁ, আছি, ভয় নেই।
তোমায় আমি ছেড়ে যাব না। "
হাঁটতে হাঁটতে আন্দ্রেই এসে পৌঁছুল জ্বলন্ত নদীর পাড়ে। সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল ব্যাঙ।
(শেষ পর কাল...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।