কত অজানারে!
মেয়েটার নাম কাজল। একদম ধব ধবে ফর্সা! তার পরও তার দাদী এই নাম রাখছে। কাজল যখন প্রথম বুঝতে শিখে, তখন দাদীকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “দাদী আমার নাম কাজল রাখলা ক্যান? ওইডাতো কালো মাইয়াগো নাম”। দাদি তখন তার ফোকলা দাতে মিচকি মিচকি হাসছিল আর বেশ রঙ করে বলেছিল, “আরে এইডা নিয়া মন ব্যাজারের কি হইলো? তুই তো দ্যাখতে চান্দের লাহান! তর বিয়ার পর শশুর বাড়ি তর নাম হইবো রাঙাবউ”। কাজল সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল।
দাদীখান যে কি!! এখন সে বুঝতে শিখেছেনা?!
কাজলের ভাই কাজলের চেয়ে দুই বছরের বড়। কাজলের ভাই কে যেদিন স্কুলে নিয়ে গেল তার বাপ সেদিন কাজল কেও নিয়ে গেছিল সাথে। এটা মজার কাজ করেছিল সেদিন ওর বাবা। ভর্তির সময় মেয়ের বয়স তিন বছর বেশি আর ছেলের বয়স দুই বছর কমিয়ে দিয়েছিল! দাদির “রাঙা বৌ” এর ব্যপারটা বুঝতে শিখলেও তার বাবার এই সুক্ষ কারচুপির কারণটা সে বুঝেনি সেদিন। তবে মজার একটা ব্যপার ছিল সেটা! এর পর থেকে কাজল তার ভাই এর সামনে গলাটা একটু মোটা করে কথা বলতো।
আর বড় বোনের মত হুকুম দারি করার চেষ্টা করত। এখন তো সে ই বড়!! তাইনা?
কাজলের ভাইটাও খুব ভাল। স্কুলে যাওয়ার সময় চেয়ারম্যান চাচার বাগান থেকে আম পেড়ে নিয়ে আসতো সে। কখনো বা পেয়ারা অথবা জামরুল। এসব অবশ্য বেশ আগের কথা।
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল তারা এক সাথে। এর পর কাজল মেয়েদের স্কুলে চলে যায়। পড়াশুনাও তাই আর তেমন ভালোলাগেনি পরে।
কাজলের বাপ ধানি-পানি গেরস্থ। তবে অবস্থা খুব একটা ভাল না।
আর দশটা সাধারণ কৃষকের মতই। মেয়েকে পড়িয়েছে কারণ উপবৃত্তি। শেষমেষ তো বিয়েই দিতে হবে। সেটা যাতে তাড়াতাড়ি করা যায় সেই ব্যবস্থাও সে করে রেখেছে কাজলকে স্কুলে ভর্তি করার সময়ই। কাজলও ব্যপারটা জানে।
এখন সে আরো বেশি বুঝতে শিখেছে।
একদম সাধারন পল্লী গ্রাম। দিন গুলোও সাধারণ ভাবেই কেটে যায় সবার। উঠানের মাঝে যে কচা গাছের খুটিটা পুতেছিল তার বাবা, গরু ঘুরিয়ে ধান মাড়াই এর জন্য। সেটাতে পাতা গজায়, ডাল গজায়, একসময় বড় একটা গাছই হয়ে যায় সেটা।
প্রতিবারই ধানমাড়াই এর সময় সেই গাছের ডালপালা কেটে আবার খুটি বানিয়ে ফেলা হয়। পাখি বসে যাতে ধান না খেয়ে ফেলে। পাখিরা তবুও ধান খায়। ঢেকী ঘরের ঢেকীতে ধান কাটতে থাকে, শব্দ হয় ধপ্ ধপ্ ধপ্ ধপ্...
সেই সাথে কাটতে থাকে সময়।
এক সময় কাজল বড় হয়।
আসলে বড় হয়না। গ্রামের আর সব মহিলাদের ভাষায়। ‘সেয়ানা’ হয়ে যায়। এই মহিলারা নিজেরাও একই ভাবে ‘সেয়ানা’ হয়ে গিয়েছিল বহুকাল আগে কোন এক দিন। সেয়ানা মেয়েকে বিয়ে দিতে হয়।
কাজলের বাপ দৌড়া দৌড়ি শুরু করে। একসময় পাত্রও পেয়ে যায়। পাত্র শিক্ষিত। শহরে থাকে। ছোট খাটো একটা চাকরি করে ঢাকায়।
বিয়ের পর মেয়েকেও ঢাকায় নিয়ে যাবে। এত ভাল পাত্র পাওয়া তার মত গেরস্থের মেয়ের জন্য সহজ ব্যপার না।
কাজল তখন আরো অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। বিয়ের ব্যপারে আর দশটা মেয়ের মতই লজ্জা মিশ্রিত এক ধরনের জল্পনা-কল্পনা তার মধ্যেও ছিল। তবে পাশের বাড়ির কেয়ার কাছ থেকে বিয়ের কিছু ভিতিকর ডিটেইলও শুনেছে সে।
এসবের জন্য সে প্রস্তুত না। তারপর একদিন হুঠ করে কাজলের বিয়ে হয়ে যায়। নিজেদের বাড়িতেই।
তারপর যথারীতি সেই রাতটা আসে। টিম টিমে একটা কুপি বাতি আর চৌদ্দ পনের বছরের একটা মেয়ে খাট আলো করে বসে থাকে।
কিছু রঙীন কাগজ আর গাদা ফুল দিয়ে সাজানো ছোট্ট একটা ঘরে। কুপি বাতির আলোটা মাঝে মাঝে কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে। সেই সাথে কেঁপে কেঁপে ওঠে মেয়েটা নিজেও। তার জামাইটাকে একবার দেখেছিল সে। দোজো বর।
আগেও নাকি একবার বিয়ে হয়েছিল। ছয়মাসের মাথায় বউটা মারা যায়। পাত্রী দেখার সময় কাজলের দিকে তাকায়ও নি তেমন। দ্বিতীয় বিয়ে তো। তাই পুলক একটু কম।
ধুমসো কালো। বয়সও অনেক বেশী মনে হয়। তাও বত্রিশ হবে! চেহারাও ভয়ঙ্কর। ডাকাইত যেন একটা! ভাবলেই ভয় হয়।
জামাই বাইরে বাতাস খাচ্ছে।
সারাদিন ধক্কল গেছে খুব। ফ্যানের বাতাস খাওয়া লোক। এই গাও গ্রামে এসে গরম সহ্য হচ্ছেনা। বিড়ি টিড়িও খাচ্ছে মনে হয়। কখন রুমে ঢুকে পড়ে কে জানে! এক ধরণের আতঙ্ক গ্রাস করতে থাকে কাজলকে।
এরকম হওয়ার কথা ছিলনা। মোটেই না। এই দিনটা নিয়ে অনেক যত্নে লালিত কিছু স্বপ্ন ছিল তার। নিজের হাটুর উপর মাথাটা কাত করে রেখে দরজার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে সে।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়।
তার পর মৃদু ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে যায় দরজাটা। ঘরে উকি দেয় কাল একটা মুখ। বাইরের অন্ধকারের চেয়েও কাল। তারপর সেই মুখটাতে একে একে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্ঙ্গ যুক্ত হয়। একটা মৃদু শব্দ হয় হুড়কো লাগানোর।
নিজের হাটুর কাঁপন বুঝতে পারে মেয়েটা। বুঝতে পারে দুরু দুরু বুকের কাঁপনও। কালো পশুটা এগিয়ে আসতে আসতেই গায়ের পাঞ্জাবী খুলে ফেলে। স্যান্ডো গেঞ্জী পাশ দিয়ে উকি দেয় কালো কালো লোমের জঙ্গল। আর মৃদু ভুড়ি।
আতংকিত চোখ দুট আরো বড় হয়েযায় কাজলের। তারপর হুঠ করে তেল ফুরিয়ে যাওয়ায়, কুপিবাতিটাও বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সাথে...
***
কিছুক্ষন অন্ধকার থাকার পর। একটা মৃদু নীলচে আলো দেখা যায় ঘরটাতে। পশুটা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে। সেই আলোয় তার ভয়ঙ্কর মুখটা আরো বিভৎস হয়ে যায়।
মোবাইলের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে আরো কিছুটা এগিয়ে আসে সেই মুখ। তারপর কাজলকে অবাক করে দিয়ে। অসাধারণ মিষ্টি একটা ভরাট কন্ঠে বলে উঠে, “গান শুনবে? আজকে শুনবো বলে কিছু গান নিয়ে এসেছি”। কাজলের আতংকিত চোখে এবার ভর করে অবিশ্বাস!! ভেজা চোখে নীলচে আলোয় সেই কালো মুখটাই কেমন যেন অসাধারণ হয়ে উঠতে থাকে। পশুটা তখন একটা ইয়ারপিস্ গুজে দেয় কাজলের বাম কানে।
এর পরে তেমন কিছু মনে নেই কাজলের। শুধু টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম আর ইয়ারপিস্টা কানে দেওয়ার সময় বামকানে স্পর্শানুভুতির সেই অজানা শিহরনটা ছাড়া।
সেদিন নীলচে আলোয় চেহারাটা অসাধারণ হয়ে উঠলেও পশু লোক টা পশুই থেকে যায়। তাই এই আজও মিরপুরের ছোট্ট একটা বাসায় যদি খুব ভোরে কান পাতেন আপনি। ঘুম জড়ানো কন্ঠে একটা মেয়েকে বলতে শুনবেন, “ধ্যেত!! তুমি একটা পশু!!”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।