আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল মাহমুদঃ ছায়াহীন বৃক্ষ

mostafizripon@gmail.com

এক তিনি মিটিমিটি হাসছেন, চোখ দু'টো বুজে আছে সে হাসির রেনু ছড়িয়ে দিতে শশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডলে। তিনি বাংলা কবিতার এসময়ের মহীরূহ- আল মাহমুদ। তাঁর সাহিত্যের দিপ্তী কবিতার গেরস্থালি পেরিয়ে গল্পে-উপন্যাসে সুগভীর শেকড় বিস্তার করেছে- তাও অনেক দিন। ছোটখাট সমসাময়িক কড়চার অর্কিড শোভা বাড়িয়েছে তাঁর লেখালেখির বাগানবাড়ীর। যদিও বয়সের ভার, স্মৃতি কাতরতা, দৃষ্টিক্ষীণতা, স্বজনের প্রতারনা, অনুমান নির্ভর ইতিহাসচারন- সেই বাহারী গুল্মের কীটদষ্ট পাতার মতো কখনো কখনো।

'প্রধান কবি'র গালভারা শব্দটি আল মাহমুদের ভাগ্যে জোটেনি। কবি ভ্রুকুটি করেন এ তকমা; আবার ভুলেও থাকতে পারেন না। নিজের আর্থিক দীনদশার কাহিনীর পাশে এই না-পাওয়াটিরও একটা দীর্ঘশ্বাস বাজারের ফর্দের মতো দশ দিগন্তের এক কোণে পড়ে থাকে। রাজনীতির নেকাবও দুলে ওঠে দশ দিগন্তের ঈশান-অগ্নী কোণে। নেকাবের আড়ালে যে মুখটি, সে অনুযোগ করে অন্যের নামে- লোকে তাঁকে মৌলবাদী বলেন।

আবার প্রতিপক্ষকে মোক্ষম জবাবও দেয় সে মুখোশ- আমিতো মৌলবাদী! 'বাংলাদেশ থাকলে আপনিও থাকবেন'- আল মাহমুদ জানিয়েছেন আমাদের। আমরা মায়ের সোনার নোলক হারিয়েছি একদিন, এবার বুঝি মা'কেই হারানোর ভয় পাচ্ছেন কবি। কারা ভাবেন বাংলাদেশ না থাকলেও তারা থাকবেন? আল মাহমুদ জানান, 'তথাকথিত নাস্তিক আর প্রগতিবাদীরাই এ ধরনের চিন্তা করে চলেছে'। কবির 'সেই সত্য রচিবে যা তুমি'- কলামিস্টের বাণী হয়ে গেলে অন্য রকম শোনায়। কবির পক্ষ থাকে, পক্ষপাতও থাকে- প্রতিপক্ষ থাকেনা।

কখনোই না। দশ দিগন্তে উড়ালের অধিকার কবিরই জন্য, কলামিস্ট সেখানে বড়ই বেমানান। 'কোন নাস্তিক্যবাদী আদর্শই বাংলাদেশের অস্তিত্বের গ্যারাণ্টি নয়। বাংলাদেশ টিকতে পারে শুধু ইসলামী আদর্শের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়েই'- আল মাহমুদ যখন একথা বলেন, আমি সেখানে কবিতা খুঁজে পাইনা- কেবল এক অ-কবির আস্ফালন দেখি। বাংলাদেশের অস্তিত্বের গ্যারাণ্টি হিসেবে 'নাস্তিক্যবাদ' কে উপহার দিয়েছে? কেউ দেয়নি।

তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের যারা স্বপ্ন দেখেন তারা কি নাস্তিক? আল মাহমুদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতাই কি নাস্তিক্যবাদ? তিনি আরো বলেছেন, 'এ দেশের ওইসব কুচক্রী শয়তানকে হজম করে ফেলার শক্তি যে বাংলাদেশের আছে, তা একবার দেখিয়ে দিলে মন্দ হয়না। ' আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাওয়া শীতল এক অনুভূতি টের পাই। একজন কবি বলছেন এ কথা! আমি অবাক হই, হতাশাও আমার করোটির মধ্যে পেরেক ঠুকে দেয়না- আল মাহমুদ তরবারী হাতে সেখানে যে বসে! আল মাহমুদের এই গোষ্ঠীটি শক্তি যে একেবারে প্রদর্শন করছে না তাতো আর নয়! ছায়ানটের বর্ষবরণে হামলা হয়েছে- হত্যা করা হয়েছে উৎসব দেখতে আসা কয়েকজন সাধারন মানুষকে, আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছে- খুন করা হয়েছে তেইশজনকে, ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা হয়েছে, সিপিবি'র মিটিং-এ বোমা হামলা হয়েছে, উদিচি'র অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছে, আদালতে কর্মরত বিচারকে হত্যা করা হয়েছে, সারাদেশে একসাথে বোমা ফাটিয়ে আতংক তৈরী করা হয়েছে- আল মাহমুদ এতেও তুষ্ট নন! ২০০৮-এ প্রস্তাবিত নারী নীতির বিপক্ষে মরিয়া প্রতিক্রিয়াশীল যে গোষ্ঠীটি তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে সারা দেশে তাতেও কি আল মাহমুদ নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, তাঁর 'নাস্তিকেরা' যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছেন উদিয়মান এই যমদূতদের সম্পর্কে? আল মাহমুদের ভাষায়, 'বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। এখানকার ধর্ম আর ভাষা এক। আশা-আকাঙ্ক্ষাও এর অনুকূলেই থাকতে হবে।

তা না হলে এর অস্তিত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়বে'। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের বক্তব্যটি এত নিখুঁতভাবে আল মাহমুদ কবে রপ্ত করলেন? ধর্মের দোহাই দিয়ে কীটের মত যে গোষ্ঠীটি টিকে আছে বাংলাদেশে, তাদের অনুরনন এতোটাই অবিকৃতভাবে তিনি করছেন যে, কখনো কখনো মনে হয় যুদ্ধাপরাধীর কোন প্রেতাত্মার কথা শুনছি। ভাবতেও অবাক লাগে আল মাহমুদ একদিন এদেরই বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আল মাহমুদ শারীরিক দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতার সাথে সাথে নিজের নৈতিক শক্তির অবলোপ ঘটিয়েছেন। বার্লিন প্রাচির ভেঙ্গেছে আর সাথে সাথে এককালের বামপন্থী অনেকের মতই তিনিও চরম ডানপন্থীতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

এ যেন এক তামাশাপূর্ণ ডিগবাজী প্রতিযোগিতা- সার্কাসের সঙরাই যা এককালে দেখাতো। দুই ছেলেবালায়- যে বয়সে মানুষ সুতোছেঁড়া ঘুড়ির পেছনে দৌঁড়ায়, পুষবে বলে পাখি ধরে আনে জঙ্গল থেকে- সে বয়সে আমি আর আমার বয়সী অনেকে- গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এমন এক মানুষের লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম লাশটি তখনও গাছে ঝুলে আছে। ভয় পেয়েছিলাম বাড়ী ফেরার পথে, অনেক বয়সেও আত্মঘাতী সেই মানুষটিকে আমি দুঃস্বপ্নে দেখতাম। যে গাছে মানুষটি নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল কোন এক ঝিম ধরা দুপুরে- সে গাছটিকে পুরোপুরি কেউ কেটে ফেলেনি; শুধু একটি ডাল কেটে দিয়েছিল- যেখানে সে ঝুলে ছিল পরের দিন পুলিশ আশা অব্দি।

অন্ধকার মতো সেই ভূতেধরা জংলা জায়গাটিকে আমরা এড়িয়ে যেতাম; তবু সে আমাদের পিছু নিত প্রতিটি নির্জন দুপুরে, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় আর প্রতিটি দুঃস্বপ্নের রাতে। আল মাহমুদের সৃজনশীলতা কি আমার ছেলেবেলার 'শুধু একটি ডাল কেটে নেয়া' সেই বৃক্ষের মতো? আমি জানি না। দশ দিগন্তে উড়াল দিয়ে আল মাহমুদ কোন পালক ফেলে রেখে যাচ্ছেন আমাদের জন্য?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।