মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না- অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না ! কৈশোরবয়সে একখানা বই আমাকে বড্ড টানিত। বইখানার পরিচয় একশত মহামনিষী, আর সেইটা লিখিয়াছিলেন আমেরিকার জনৈক জ্যোতির্বিজ্ঞানী জনাব মাইকেল এইচ হার্ট। বইটা নিয়া আমার সীমাহীন স্মৃতি উপস্মৃতির সংখ্যা প্রায় π এর মতই অমূলদ। কইলে বেক্কল ঠাউরাইবেন তাও বলি, বইটারে আমি আমার বাপের মতই শ্রদ্ধা করতাম। আমার সদাসতর্ক কমান্ডো দৃষ্টি ভেদ করিয়া বইয়ে কোন ভাঁজ কিংবা দাগ পরা কোনকালেই সম্ভব ছিলনা।
তারপরও মলাটে এতটুকুও দাগ পরিলে মস্তিস্কে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন বহিয়া যাইত।
সেই যাই হইক।
বইখানা থেইকা আমি আত্মস্থ করিলাম যে, গ্রীকেরা একখান সাংঘাতিক জাতি আছিল। দুনিয়ার সব বসই ঐ মুলুগে পয়দা অইসে। ইউক্লিড, সক্রেটিস, প্লেটো, বীর বাহাদুর আলেকজান্ডার, আর্কিমিডিসের জীবনী পড়িতে পড়িতে মুখস্থ করিয়া ফেলিলাম।
গ্রীক ভাষা ও জাতির উপর আমার কৌতূহল ও শ্রদ্ধা উভয়ই চক্রবৃদ্ধির হারে বাড়িতে লাগিল। বাপজানকে আড়ালে ডাকিয়া একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াই লইলাম আমাদের চৌদ্দপুরুষের কোন পয়দা গ্রিসের বাসিন্দা ছিলেন কিনা। বাপে আমার হাসিতে জানেনা, তত্যাবধি মুখমণ্ডলের পেশিকে একদফা সঙ্কোচন-প্রসারণ করাইয়া হাসির মত ভঙ্গি করিলেন। এবং প্রশ্নের জবাবের বদলে আমার গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার মোহাম্মদ মসনদে আলীর আধ্যাত্মিক জীবনচরিত ও তাহার সুফিবাদি জীবনধারার সংক্ষিপ্ত ভাবমন্ত্র ব্যাখ্যা করিলেন।
ইউক্লিড, আর্কিমিডিস ও সক্রেটিস - মূলত তিনজন মনিষী আমার চিন্তাধারাই চেঞ্জ করিয়া দিল।
তাহাদের গুরু মানিয়া একনিষ্ঠ ফ্যান হইয়া গেলাম। সিদ্ধান্ত নিয়া লইলাম মসনদে আলীর নয়, এনাদের জীবনাদর্শন ফলো করিয়া বাকি জীবনটা কাটাইয়া দিব। এবং জীবনের শেষবয়সে এথেন্স নগরীর কোন এক সড়কের ফুটপাতে বসিয়া সূর্যোদয় উপভোগ করিব। পুরোদস্তুর গ্রীক মনিষী হইবার জন্য কোমরে গামছা বাইন্ধা ময়দানে নামলাম। অতঃপর ভবিষ্যৎ জীবনের ছক কাটা শুরু করলাম।
তত্ত্বজ্ঞানে কোনকালেই আমি দুর্বল ছিলাম না। একজন উচ্চমাপের গ্রীক মনিষী হইবার জন্য আমাকে যে শুধুমাত্র দুইটা যোগ্যতা অর্জন করিতে হবে তা আমি সহজেই বুঝিয়া গেলাম।
প্রথমত, আমাকে গ্রীক হইতে হবে।
এইজন্য গ্রীক ভাষা, সাহিত্য, ব্যাকরণ, সাইকোলজিসহ সচিত্র মিথলজিতে উস্তাদ হইতে হবে। রেসিপি দেখে গ্রীক খাবার পাক করে তা গ্রীক কায়দায় ভক্ষণ করিতে হইবে।
এতে করে আমার এই দেশীয় পরিপাকতন্ত্রকে অচিরেই গ্রীক পরিপাকতন্ত্রে উন্নীত করা সম্ভব হইবে। দুই একখানা গ্রীক ব্লগে লেখালেখি করে নিজের অবস্থানের জানান দিতে হইবে। পাশাপাশি নিজের জন্য সুন্দর একটা গ্রীক নাম এবং অনলাইনে কিছু ইয়ারদোস্ত পাতাইয়া নিতে হইবে। সবশেষে, পাসপোর্ট ভিসার কাজ সারিয়া উড়োজাহাজে উড়িয়া সোজা পিরামিডের দেশে।
দ্বিতীয়ত, আমাকে মনিষী হইতে হবে।
একজন সফল মনিষী হইবার জন্য আমি পূর্বের সেই মনিষীদের জীবনীর কিছু অংশ ফলো এবং কিছু অংশ ব্যান করতে হবে। যেমন, ইউক্লিডের জীবনী থেকে বুঝলাম যে জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, বলবিদ্যা করিয়া করিয়া কর্ণফুলী পেপার মিলসের বেচাবিক্রি বাড়াইয়া দিতে হইবে। কিন্তু মাষকলাইয়ের জীবন রক্ষার জন্য অযথা নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়া চলবে না। শত্রুপক্ষকে ক্ল অফ আর্কিমিডিসের হেল্প নিয়া সাগরের তলে পাঠাইয়া দিতে হবে। মাষকলাইয়ের জন্য কিংবা শত্রুর হাতে কোনভাবেই প্রাণ খোয়াবার রিস্ক নিয়া যাইবেনা।
জীবনে চলার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নন্দলালের পণের কথা স্মরন রাখিতে হইবে। তাছাড়া, কোপার্নিকাসের মত বই ছাপানোর জন্য প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে না ঘুরে ব্লগে পোস্ট করে দিতে হবে। চিন্দাভাবনা চলাফেরায় সেক্যুলার হইতে হইবে। আচ্ছামত চুল বড় করিয়া জট বাধিতে হইবে। কোনক্রমেই কোন প্রসাধনী ব্যাবহার করা চলবে না।
অয়াশরুমে চৌবাচ্চার বন্দোবস্ত করিতে হইবে এবং জামাকাপড় পরিধান করিয়াই স্নানে যাওয়া উত্তম। অন্তত ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষা দেয়।
এদিকে হতচ্ছাড়া জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা নিকটে আসিয়া আমার দর্শন, মনিষীয়ানায় বিশ্রী রকমের ব্যাঘাত ঘটাইতে লাগিল। আমার জীবনের সকল বোর্ড পরীক্ষা আমি গার্লস স্কুল বা কলেজে গিয়া দিয়াছি। সো গার্লস স্কুলে দেয়া পরীক্ষা আমার ফার্স্টক্লাস হইল।
মেয়েলি ক্লাসরুম ও মেয়েলি ক্যাম্পাস জীবনে কোন কিশোরীর অনুপস্থিতি সম্বন্ধে সতর্ক করিয়া দিল।
কেলাস নাইনে উইঠাই মাস্টারপ্ল্যানে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আনলাম। উপলব্ধি হইল যে আমার কাছে তিনটা অপশন খোলা আছে। তিন নাম্বার অপশন বাদ দিয়া মা বাপের আত্মতৃপ্তির জন্য দুইটা অপশন খোলা রাখলাম।
এক, ইউক্লিডের লাইনে যাওয়ার জন্য ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়া
গণিত বিভাগে এডমিশন।
তারপর গ্রিসে গিয়া পিএইচডি। (অট্টহাসির ইমো হইবে)
দুই, আর্কিমিডিসের লাইনে যাওয়ার জন্য কোন ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। অসাধারণ সব উদ্ভাবন কইরা নোবেল পুরস্কার ছিনাইয়া নেওয়া...।
সাত বছর পর আমি এখন বাসায়। আম কাঁঠালের ছুটি শেষ, ক্যাম্পাস আগে থেকেই খোলা।
হরতালের উপলক্ষে কয়েকদিন বেশি থেকে গেলাম। পরশু রওয়ানা হচ্ছি রাজশাহীর দিকে। হয়ত গ্রীস নয়, রাজশাহীই ছিল গন্তব্যে। চিন্তাভাবনা এখন সাধারণ, স্বার্থবাদী ও অর্থনৈতিক। উড়ালচণ্ডী মার্কা ভাবগুলার বিশ্রী অভাব এখন।
ছোটবেলার আবেগ-স্বপ্ন সব কই যেন হারাইয়া গেল! শুকনো কাঠের মত এ কোন জীবন! বয়স বাড়ছে, হিসাব বাড়ছে। কিন্তু বছর শেষে হিসাবের খাতায় কোন হিসাবই তো আর মিলেনা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।