দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
মৌসুমী ভৌমিক। বাংলা গানে নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করে শুরুতেই গুণীজনের ভালোবাসা কুড়িয়েছিলেন তিনি এখন পথে পথে গান কুড়ান। এ গানে নাগরিক জীবন ও মধ্যবিত্তের বিলাস নেই। আছে মাটি ও মানুষের টান; মাটি ও মানুষের গল্প। লোকশিল্পের অমৃত ভা-ারের খোজে তিনি এখন পথ চলছেন।
কুড়িয়ে আনছেন মানুষ ও তার গানকে। তাই তার কাছে এ গান আলাদা মর্যাদার। কুড়িয়ে পাওয়া এসব গান আলাদা দ্যোতনাও দেয় তার কণ্ঠে। মধ্যবিত্তের একজন শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক এখন লোক গানের একজন গবেষকও। লোক জ্ঞানের মূল জায়গায় দাড়িয়ে তিনি এর ভেতরকার গল্প ও এর বিরহ পরিক্রমার সঙ্গে দর্শক শ্রোতাদের পরিচিত করে তুলছেন।
মধ্যবিত্তের শিল্পীকে ছাপিয়ে তিনি এখন একজন লোক গবেষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৩ মার্চ রাতে সিলেটের মদনমোহন কলেজের সোলেমান হলে সহকর্মী সুকান্ত মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে দুই বাংলার পথে কুড়িয়ে পাওয়া লোক গানের পথে পাওয়া গান-এর অডিও ভিজুয়াল উপস্থাপন করেছেন।
দুই বাংলার পথে পথে কুড়িয়ে পাওয়া গানের অডিও ও ভিজুয়াল নিয়ে নিজেই উপস্থাপন করলেন এসব গান। সাবলীল উপস্থাপনায় খালি গলায় এসব কুড়ানো গানের একটু-আধটু গাইলেনও। বললেন এর ভেতরকার গল্প।
এসব গল্পে অনেক সংশ্লিষ্ট-অসংশ্লিষ্ট বিষয়কেও তিনি প্রাসঙ্গিক করেছেন। আমাদের লোকগানের বিশাল ভা-ারের অধিকারী শিল্পী ও তাদের নিজের কণ্ঠের গানও শোনালেন অডিওর মাধ্যমে। ভিডিও দেখালেন। স্থানীয় লোকশিল্পীদের খুজে অনেককে দিয়ে গানও গাওয়ালেন। উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের প্রশ্নের জবাবও দিলেন সাবলীলতা ও নিজের অটল বিশ্বাস থেকে।
তবে প্রশ্ন ও উত্তরের বিষয় ছিল পথে কুড়িয়ে পাওয়া লোক গানকেন্দ্রিক। আর এ কারণেই দর্শকদের অনুরোধেও তিনি তার নাগরিক গান পরিবেশন করেননি। পরিবেশন করেছেন রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমের গান। সুর ঠিক রেখে এসব গান তিনি তার নিজস্ব গায়কী ঢংয়ে গেয়ে শোনান।
মৌসুমী আমাদের লোক গানকে উপলব্ধি করেন নিজের ভেতর থেকে এটা তিনি বোঝালেন তার পথে পাওয়া গানের অনুষ্ঠানে।
এ গানের প্রতি তার দরদও অকৃত্রিম। একটু আধটু গান গাইলেন, বললেন এসব গানের গল্প। সমৃদ্ধ লোক গানের বিরহ পরিক্রমার সঙ্গে দর্শক শ্রোতার পরিচয়ও ঘটান তিনি গান ও গল্পে। নাগরিক মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি শিল্পী মৌসুমীর সঙ্গে লোক গবেষক মৌসুমীর কোনো দ্বন্দ্ব নেই এটাও সাবলীলভাবে জানালেন শ্রোতার প্রশ্নের উত্তরে।
সিলেটে এ গানের উপস্থাপন করতে গিয়ে উপস্থিত সবাইকে শোনান তার সিলেট প্রীতির কথা।
বললেন, সিলেটি প্রতিবেশীর সঙ্গে বেড়ে ওঠার কথা। প্রতিবেশী অঞ্চলের স্মৃতির কথা। মৌসুমী বলেন, আমি এ অঞ্চলের ভাষা বুঝি। তিনি বলেন, সিলেট আমার প্রতিবেশী। আমার শিলংয়ের বাড়ির পাশে অনেক প্রতিবেশী রয়েছে সিলেটি।
তাদের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে বড় হয়েছি। হয়তো আমি সিলেটি নই, উত্তর বঙ্গের নই। হয়তো আমি কোথাও নেই। আমি ভাসমান মানুষ।
তাই পথে পথে ঘুরি। তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথম যখন সিলেট আসি তখন অনেক লোক গানের শিল্পীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাদের অনেকেই এখন আর নেই। শাহ আবদুল করিমের প্রয়াত শিষ্য বাউল রুহী ঠাকুরের স্মৃতির উদ্দেশে তিনি তর্পণ করে অনুষ্ঠান শুরু করেন। তার গানও গাইয়ে শোনান।
সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে তিনি তার আসনে আসেন। টানা বলে যান রাত ৯টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত। মৌসুমী আসলেই একজন মাটির মানুষ। অবয়বে গৌরবময় ব্যক্তিত্বকে ধরে বলে গেলেন অবলীলায় গান ও গানের গল্প। আমাদের ভেতরে বোনা এ গান বাউলের মাটির ঘর, ফকিরের মাজার সবখানে তিনি গেছেন এ গান সংগ্রহের জন্য।
লোক গানের সফল ব্যবহার চলচ্চিত্রেও হয়েছে। ঋত্বিক ঘটক লোক গানের অসাধারণ ব্যবহার করেছেন তার মুভিতে। তিনি বলেন ঋত্বিক বাঙালির বিয়ের গানও তার ছবিতে ব্যবহার করতেন। যুক্তি তর্ক গপ্পো মুভিতে তিনি এসব অসাধারণ গান ব্যবহার করেন। একটু গেয়েও শোনান তিনি আমার উঠল উঠিল সইগো এদেশের বসতি...।
তিনি বলেন, লোক তৈরি হয় ভেতর থেকে। গেয়ে ওঠেন আমার দেহতরী দিলাম ছাড়ি ও গুরুর তোমারও নামে... লোক ব্যক্তির সৃষ্টি হলেও তা ব্যক্তিকে ছাপিয়ে কমিউনিটির সমষ্টি হয়ে ওঠে। লোক গানে জীবনের বহমানতা আছে। এখানে মেকি কিছু নেই। সবই মাটির মানুষের।
প্রয়াত রুহী ঠাকুরকে তিনি নিমাইর সঙ্গে তুলনা করে বলেন, আমরা রাবিন্দ্রিক চর্চায় বদ্ধ। মধ্যবিত্ত ও শহুরে হয়েছি। কিন্তু এ সবকে আমি অস্বীকার করি না। তাই এর সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্বও নেই। তবে লোক গান বাংলার গান বাঙালির গান।
কীর্তন, বাউল, জারি, এসব আমাদের নিজস্ব। তাই সুযোগ পেলেই আমি শহুরে মধ্যবিত্তের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসি। এ গানের কাছে আসি। তিনি নগর জীবনের যন্ত্রণা সম্পর্কে বলেন, আমরা যতো নাগরিক হচ্ছি ততো একা হচ্ছি। তিনি পশ্চিম বঙ্গের অমূল বাউলের গানে কণ্ঠ ধরেন...রঙ্গিলা নাইয়ারে হায়...।
এভাবে এক গান থেকে আরেক গানে যান তিনি। দর্শক শ্রোতাদেরও সঙ্গে টেনে নিয়ে যান সুর ও কথার ঐন্দ্রজালিক মায়ায়।
গান ও কথার ফাকে মৌসুমী বলেন, আমি করিম শাহর দেশে এসেছি। শিলচরে করিম শাহর কথা প্রথমে শুনি। তাকে বলা হয় গণকবি।
আমি গানকে রাজনীতি দিয়ে বিচার করি না। তিনি দেওয়ানা বানাইছে গানে কণ্ঠ দিয়ে বলেন, এ গানে অসম্ভব মায়ার টান রয়েছে। এসব গানকে, এসব গানের শিল্পীকে তাই রাজনীতি দিয়ে বিচার করা ঠিক না। করিম শাহর গানে প্রেমের টান মায়ার টান ব্যাপক। এরপর তিনি আগের দিনের গাওয়া কনক দাসের কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্লিপ শোনান।
আগের শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানে লোক গানের আবহ ও রস থাকতো। এখন আর তা নেই। শেষে তিনি বীরভূমের লোক শিল্পী গোলাম শাহ ফকির ও তার সন্তান শিরোনামের ভিডিও পরিবেশনা করেন।
দর্শক শ্রোতার পক্ষ থেকে তার আমি দেখেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে...গাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি আজকের অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই বলে গেয়ে শোনান, মায়ানি রাখবায় মনে রে, প্রাণনাথ দয়ানি রাখিবায় মনে...এ গানটি পুরো গেয়ে শোনান নাগরিক শিল্পী মৌসুমী। যখন এ গান গাচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল এ গানের ভেতরকার বিরহ গরিমা ছুড়ে দিচ্ছেন দর্শক শ্রোতার দিকে।
সবাই লোক গানের বিরহ পরিক্রমায় তার সঙ্গী।
সিলেটের চন্দ্রাবতী বর্মণ, চন্দন মিয়া, রনেশ ঠাকুর ও রেহানা বেগম গান গেয়ে শোনান তাকে। সিলেটের বাউল সংগঠন সহজিয়ারস শিল্পীরাও গান করেন। গান কুড়ানো মেয়ে মৌসুমী ভৌমিকের পথে পাওয়া গান মায়ার জালে বেধেছিল সিলেটের সুধীদের। সবাই নাগরিক জীবন পেছনে ফেলে লোক গবেষক মৌসুমীর নরম হাতটি ধরে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে ছিলেন শিকড়ের দেশে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।