আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অথবা একফোঁটা জল

mostafizripon@gmail.com

আমেরিকা যৌথবাহিনীর তকমায় একদল ঠ্যাঙ্গারে রাষ্ট্র নিয়ে ইরাক আক্রমন করলে, যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরই আলী নামে এক ইরাকী কিশোর বোমার আঘাতে তার দুটি পা-ই হারায় এবং রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে পশ্চিমা দুনিয়ায়। সংবাদপত্র আর টিভিতে আলী হয়ে ওঠে 'ব্রেভ আলী', সাদ্দাম হোসেনের দুঃশাসন থেকে মুক্তির প্রতীক। তাকে চিকিৎসার জন্য বিটেনে আনা হয়; আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনাচারের শিকার কিশোর আলীর কৃত্রিম পা উপহার জোটে। ইদানিং আলীর কোন সংবাদ নেই কোথাও। খুব সম্ভবত ইরাক যুদ্ধ ফেরত আঠাশ হাজার মার্কিন যুদ্ধাহত আলীদের ভীড়ে কিশোর আলী হারিয়ে গেছে।

ইরাক যুদ্ধের বিষয়ে আমেরিকা কবে বলবে, 'অনেক হয়েছে, আর না; এবার থামা যাক!' গড়ে দৈনিক বারো হাজার মিলিয়ন ডলার খরচ করে, গত পাঁচ বছরে আমেরিকা পেয়েছে চার হাজার মার্কিন সেনার মৃতদেহ; আর এর সাতগুন যুদ্ধাহত সৈন্য। কতজন ইরাকী মারাগেলে যুদ্ধরত একজন যৌথবাহিনীর সেনা সদস্য নিহত হয়? মার্কিন হিসেব অনুযায়ী পঁচিশজন। কিন্তু বাস্তবতা আরো ভয়ংকর, বীভৎস। আমেরিকা পরিচালিত যৌথ বাহিনীর সদস্য অনেক দেশই এখন ইরাক যুদ্ধের আবর্জনা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে; তৈরী করছে 'এক্সিট স্ট্রাট্রেজি'। কিন্তু আমেরিকা কি সহসাই ফিরছে ইরাক থেকে? এমন কোন আলামত আপাতত চোখে পড়ছেনা।

আমেরিকার জন্য ইরাকযুদ্ধ এখন আত্মমর্যাদার লড়াই। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের কলঙ্ক মোচনের চেষ্টা দৃশ্যমান এখানে। তা নাহলে আরেকটি পরাজয়ের সার্টিফিকেট যে তারা লাভ করে! কিন্তু আদৌ কি আমেরিকার জয়ী হওয়া সম্ভব ইরাক যুদ্ধে? যদি ইরাকি সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে আমেরিকা কথিত আল-কায়েদা বাহিনীকে পরাস্তও করে তাতে ইরাক মূলতঃ শিয়া, সুন্নী আর কুর্দীদের দ্বারা আলাদাভাবে গঠিত ত্রিভঙ্গ রাষ্ট্রে পরিনত হবে; তবুও মার্কিন বিজয় সম্ভব হবেনা। সুন্নী উপজাতি আর মিলিশিয়ারা যারা এ মূহুর্তে আমেরিকাকে সাহায্য করছে তারা যে কোন সময় ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার, আর আমেরিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, যার পূর্বাভাস ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। আর শিয়া রাজনৈতিক দলগুলো যারা এরমধ্যেই পরস্পরের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, যা থেকে আমেরিকা নয় ইরানই বেশী সুবিধা লাভ করবে।

মানবিক বিপর্যয় বাদ দিলে কোরিয়ার সাথে যুদ্ধে প্রায় চারশ তিরিশ বিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে এখনকার হিসেবে প্রায় ছয়শ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল আমেরিকা। আর ইরাক যুদ্ধের ব্যয় ধারনা করা হচ্ছে সাতশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা বিগত ষাট বছরের মধ্যে আমেরিকার সর্বোচ্চ যুদ্ধ ব্যয়। এ প্রসঙ্গে সাবেক এক সিআইএ কর্মকতা মন্তব্য করেছেন, 'Osama (bin Laden) doesn't have to win; he will just bleed us to death.' কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমেরিকাকে পৃথিবী সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আর যখন থেকে ভর্তুকি ব্যয়ে ইরাক যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে তখন থেকেই দেশটির অধিবাসীদের ওপর নেমে এসেছে অতিরিক্ত করের বোঝা। বিশেষজ্ঞরা এখন বলাবলি করছেন, হোয়াইট হাউজ দেশটির বাস্তব পরিস্থিতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।

শুধুমাত্র গত ফেব্রুয়ারী ২০০৮-এর যুদ্ধ ব্যয় দেখে অনেকেই শিউরে উঠেছেন। মার্কিন বাজেট বিশেষজ্ঞরা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, 'It's dangerously irresponsible.' আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ টমাস ডোনেলি অবশ্য আমেরিকার এই যুদ্ধব্যয়কে নগন্যই মনে করেন। তার ভাষায়, ইরাক যুদ্ধকে টাকা দিয়ে বিচার করা যাবেনা। তারপরেও যদি কেউ তা করেন, তাহলে আমি বলব, আমেরিকার সামগ্রিক অর্থনীতির তুলনায় ইরাক যুদ্ধের ব্যয় বড় একটা বালতিতে একফোঁটা পানির সমতুল্য। এই ব্যয় মার্কিন জিডিপি'র মাত্র দুই শতাংশ।

২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক সাক্ষাৎকারে হোয়াইট হাউজের অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শদাতা লরেন্স লিন্ডসে যখন ইরাকে সম্ভাব্য যুদ্ধব্যয়ের একটি সাধারন ধারনা দিয়েছিলেন একশ থেকে দুইশ বিলিয়ন ডলার তখনই সবাই আৎকে উঠেছিলেন। আর জনাব লিন্ডসে সকলকে প্রবোধ দিয়েছিলেন এই বলে, 'এ তো মামুলি খরচ; ইরাকযুদ্ধ জয় আমেরিকার অর্থনীতিতে সুফল আনবে'। তিনমাস পার না হতেই মার্কিন সমরবিদেরা বুঝেছিলেন, চেনা শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা যায়, যুদ্ধব্যয় নির্ধারন করা যায়; কিন্তু কাউকে শত্রু বানিয়ে তার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অনেকটা ডন কুইক্সোটের লড়াইয়ের মতোই। তখন তারা মাথা চুলকে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বলেছিলেন, এই হলো বলে! অথচ গত পাঁচ বছরেও যার ধারেকাছে আমেরিকা পৌঁছাতে পারেনি; বরং দিন দিন পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন, ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার ব্যয় ২০০৮-এর মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অথচ যুদ্ধের শুরুতে রামসফেল্ড এর জন্য মাত্র পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলারের বাজেট পেশ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বুশের নিজের দলের মধ্যে এখন অনেকেই জোরেশোরে প্রশ্ন তুলেছেন, এই ব্যাপক অর্থ ব্যয় আর প্রাণহানির কাছে ইরাকযুদ্ধ কতখানি সুফল আনবে আমেরিকায়? বুশ দলের মধ্যেই সমালোচিত হচ্ছেন; কিন্তু সেই একচোখা দানবের মতো তিনি সব যুক্তি উপেক্ষা করে যাচ্ছেন। আর আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার দলের প্রার্থী জন ম্যাককেইন বুশের গলায় সুর তুলেছেন ইরাকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার। অবশ্য জাতীয়তাবাদী চেতনায় আল-কায়দা নামক জুজুর ভয় না দেখালে নির্বাচনে সুবিধা করা যাবেনা একথা রিপাবলিকানরা ভালোই বুঝে গেছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।