জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।
ব্যস্ততার কারণে ইদানীং দিন তারিখ মনে থাকে না। বাইরে থেকে এসে একটা ঘুম দিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে কম্পিউটারের টাস্কবারে চব্বিশ তারিখ দেখে কিছু একটা মনে করতে চাচ্ছিলাম। আজকে কি কোন বিশেষ দিবস? না, চব্বিশে মার্চে তো কোন বিশেষ দিবস নেই।
কোন বন্ধুর জন্মদিন হবে হয়ত। একটা সময়ে বন্ধুদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতাম। এখন এসব মনে রাখতে পারি না। তাই ডায়েরীটা খুলে দেখলাম কারো জন্মদিন কিনা। কারো জন্মদিন পেলাম না।
তাহলে?
তারপর পুরোনো কালো ডায়েরীটা নিয়ে বসলাম। কালো ডায়েরী বলাতে কেউ শোকাবহ দিন মনে করছেন না তো? যাইহোক, এক এক করে পৃষ্টা উল্টাতে উল্টাতে একটা পৃষ্টায় চোখ আটকে গেল।
হুমম......।
২০০৫ সালের চব্বিশে মার্চ। জীবনের প্রথম কাউকে ভালো লাগার কথা বলেছিলাম।
যাকে বলেছিলাম সে আমার সবচে ভালো বন্ধু(ছিল)। ওর সাথে পরিচয়ের দুবছর পরে তাকে ভালো লাগার কথা বলেছিলাম। ওহ, কিভাবে পরিচয় সেটা তো বলাই হলো না।
তার সাথে ইন্টারনেটে পরিচয় হয়েছিল। অনেকদিন নিশা নামেই তাকে জানতাম।
পরে জানতে পারি তার আসল নাম মিথুন। যাই হোক, ওর সাথে পরিচয়ের পর থেকে সময়টা ভালোই কেটে যাচ্ছিল। তুমি থেকে কবে সে তুই হয়ে গেল। ওর সাথে প্রতিদিনই ফোনালাপ হত। অনেক সময় তাকে দিনে দুবারও কল দিতাম।
২০০৪ সাল। জুনের সামার ভ্যাকেশনে প্রথমবারের মত দু'মাসের জন্য দেশে বেড়াতে গেলাম। সে এয়ারপোর্টে থাকবে বলেছিল। সেবার আমরা চার বন্ধু একসাথে দেশে গিয়েছিলাম। এমিরেটসের দীর্ঘ বারো ঘন্টার জার্নি শেষে সকাল দশটায় অবতরন করলাম।
প্লেনের ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে যখন আমার দেশের মানচিত্রটা আস্তে আস্তে করে দেখা যাচ্ছিল তখন যে কি ভালো লেগেছিল সেটা একজন পরবাসী'ই বুঝতে পারবে। মাতাল হয়ে ভালো লাগা।
তারপর চেক আউটের দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষা, অতপর পাসপোর্টের পাতায় সিল মারামারির পর্বও একসময় শেষ হল। কিন্তু তাকে কোথাও দেখছি না কেন? ওর মোবাইল নাম্বার আমার মুখস্থ ছিল। তাই এয়ারপোর্টের ভিতরের একটা দোকান থেকে ওর নাম্বারে ডায়াল করলাম।
অপারেটর সমানে বলে যাচ্ছে ' দুঃখিত, এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, পরে আবার চেষ্টা করুন। ' এখন কি করবো? ঐ দিকে আমার বন্ধুরা চট্টগ্রাম যাওয়ার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকেও যেতে হবে। মিথুনের সাথে ওর এক বন্ধু আসার কথা ছিল। ওর বন্ধুর নাম্বারটা আমার মোবাইলে সেভ করা আছে।
মোবাইল বের করে দেখি মোবাইল অফ। অন করি কিন্তু অন হচ্ছে না। মোবাইলের চার্জ নেই। এখন কি করব? তারপর পুরা এয়ারপোর্টে ঘুরে একটা জায়গায় চার্জ দেয়ার মত প্লাগ পাওয়া গেল। বলাবাহুল্য পুরা এয়ারপোর্টে একটা 'ত্রি পিন' প্লাগ পাওয়া যায় নি।
তারপরও কিভাবে যেন প্লাগ ইন করে নাম্বারটা কোন মতে নিতে পেরেছিলাম। সে নাম্বারে ডায়াল করলাম। অতপর কানেকশন পাওয়া গেল।
: দোস্ত তুই কোথায়?
: আমি অভ্যন্তরীণে আছি, তুই কই?
তারপর শুরু হল আমাদের দৌড়াদোড়ি। সে একদিকে দৌড়ায় যায় আমি যায় আরেকদিক।
সমস্যা হল এর আগে কেউ কারো চেহারা মোবারক দেখি নাই। এই পর্বের একটা সময়ে একজন আরেকজনরে ক্রস করে চলে গেছিলাম (হিন্দী সিনেমার মত)। চিনবার পারি নাই আমি কি করুম? ভাগ্যিস, আমার তিন বন্ধুর কথা আগে থেকেই বলেছিলাম। একটা জায়গায় সে তিনজনকে বসে থাকতে দেখে আমার বন্ধু কিনা জিগ্গেস করল। বন্ধুরা বলে ও তো তোমাকে খোঁজতাছে।
অপর পাশে ওর দেখা না পেয়ে আমি বন্ধুদের কাছে আসছিলাম। দেখি বন্ধুরা একজন মেয়ে মানুষের সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখে তৌফিক হাতের ইশারা করে তাকে দেখায়। অবশেষে আমরা সামনা সামনি হলাম।
চারজনের চট্টগ্রাম যাওয়ার টিকেট করতে হবে।
কিন্তু অত টাকা পকেটে ছিল না। অবশ্য পাউন্ড ছিল। তাকে বলতে না বলতেই সে আমাকে টেনে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। আমি কই কিরে দিনে দুপুরে কি করতে চাস?
: তোর না টাকা লাগবে স্টুপিড?
: হুমম...
: তো চল সামনের ক্যাশ মেশিনে....
ওদের গাড়ীতে করে চললাম HSBC'র একটা ক্যাশ মেশিনে। সে দশ হাজার টাকা তুলে হাতে দিল।
সে টাকা আমি তাকে অনেকদিন পরে শোধ করেছিলাম।
সেদিনের মত বিদায় দিয়ে চলে গেলাম চট্টগ্রাম। দেশে থাকাকালীন প্রত্যেক দিনই সে আমার খোঁজখবর নিত।
যাই হোক, দু'সপ্তাহ পরে ঢাকা গেলাম। তারপর তিন-চার দিন সে আর আমি অনেক ঘুরাঘুরি করলাম।
ওদের বাসায়ও গিয়েছিলাম। চলে আসার আগে ওর সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল।
তারপর লন্ডনে (বেদনাদায়ক জীবনে) ফিরে আসলাম। দেশ থেকে ঘুরে আসার পরে আমি অনেকদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমার কিছুই ভাল লাগত না।
সারাদিন শুয়ে থাকতাম। ভালো রাঁধুনি হিসেবে সবার কাছে একটা পরিচিতি ছিল (এখনো আছে)। সেই আমিই কিনা রান্না করতে গিয়ে লবণ দিতে ভুলে যেতাম। খাওয়ার সময় বন্ধুরা অবাক। কি ব্যাপার তুই দেশে গিয়ে রান্না করা ভুলে গেছিস নাকি? উত্তর জানা ছিল না।
এভাবে অনেকদিন কেটে যায়। সব বন্ধুদের ধারণা আমি প্রেমে পড়েছি। সবাইকে বলতাম আরে দূর, আমার কাছে প্রেম ট্রেমের বেইল নাই। তারপরও ওরা ছিল নাছোড়বান্দা, বলত প্রথম প্রথম সবাই এমনি বলে।
আমি আসলেই ওর জন্য একটা টান অনুভব করতাম।
ধীরে ধীরে সেই টান ভীষণ দূর্বলতায় পরিনত হয়। এভাবে ওকে ভালবাসতে শুরু করি। সে ভালবাসা আমাকে পাগল করে দিবে সেটা তখন জানা ছিল না। বন্ধুদের পরামর্শে একদিন মেইলের মারফতে তাকে ভালো লাগার কথা বললাম। প্রথম ভালবাসার মানুষকে ভাললাগার কথা জানালাম।
ওহ, আরো বলেছিলাম উত্তর যায়ই হোক (ইয়েস/নো) আমরা বন্ধু আছি, বন্ধুই থাকব।
সন্ধ্যার দিকে ওর মেইল পেয়েছি।
'' কি পাইছিস তুই, ফ্রেন্ড আছিস ফ্রেন্ড থাকা যায় না? তুই যখন থেকে এরকম শুরু করেছিস বিশ্বাস কর, বন্ধু হিসেবে তোর উপর থেকে আমার রেসপেক্ট হারিয়ে যাচ্ছে। ওহ, আরেকটা কথা আমার বাসার নাম্বারে ফোন করিস না, এতে আমার সমস্যা হয়। And I think u understand my problem, আর তুই হয়ত বলতে পারিস আমি সেলফোনে কেন তোর কল রিসিভ করি না, এই ধরণের সিচুয়েশন তুমিই ক্রিয়েট করেছ।
বাই। ''
পরে অনেকবার ওকে কল দিয়েছি কিন্তু সে রিসিভ করত না, করলেও কথা বলত না। এরপরের সময়গুলো মনে করতে চাচ্ছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি সেটা আমার জীবনের সবচে খারাপ একটা অধ্যায় ছিল। গজল শুনে ঘুমহীন কত রাত কেটেছে তার কোন হিসেব নেই।
ইউনিভার্সটিতে সেমিষ্টারের পরীক্ষা পর্যন্ত দেওয়া হয় নি। আজকের আমি হয়ত অন্ধকার জীবনে তলিয়ে যেতাম। কিন্তু আমার কিছু বন্ধুদের সহায়তায় সেটা হয় নি।
আমি মোটেও ভালবাসার প্রতিদান চাইনি। আমি তাকে ভালবেসেছি।
কিন্তু সেও আমাকে ভালবাসতে হবে এমনটা আশা করিনি। সে আমাকে না বললেও আমি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম। কারণ ওর মত বন্ধুকে হারাতে চাইনি। তারপরও হারাতে হয়েছে।
সে সময়টাতে কষ্টমিশ্রিত অনেক কবিতা লিখেছি।
'স্বপ্নহীন পথিক' নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম।
আমি ছিলাম স্বপ্নহীন এক পথিক,
জানা ছিল না স্বপ্ন কি...
হঠাৎ সবকিছুর পরিবর্তন,
ফিরে পেলাম নিজেকে উদ্দেশ্যহীন।
সে এসেছিল বন্ধু হয়ে
জানাতে স্বপ্ন কি....
পাব না জেনেও অবুঝ মন
ভালবাসার স্বপ্ন দেখত
ভরা বর্ষার নির্দয়ের মত।
কিন্তু, কেন এমন হল?
সব কিছুর ওলট পালট,
চোখে এখন শুধুই অন্ধকার,
জানি, কখনো সে আসবে না
চলে গেছে সে বহু দুরে।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,
কান্নার ফোটা বৃষ্টির পানিতে
মিশে যায় নিঃশব্দে।
তারপরও কেন জানি
বহুদুরের মৃদু আলো
অজানা আশা দেয়।
এখনো বসে ভাবি
হয়ত সে একদিন ফিরে আসবে
পৃথিবীর সকল বাধা তুচ্ছ করে
এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা হাতে।
আমার হয়ত ভালবাসা পাওয়া হয়নি। তাতে আমার কোন দুঃখ নেই। কেননা, ভালবেসে আমি কোন অপরাধ করিনি।
কেননা, ভালবেসে আমি হারিনি। যারা ভালবাসতে জানে তারা কখনো হারে না।
ঠিক, ভালবাসাহীন জীবন। তাতে কি? আর স্বপ্নহীন নই। স্বপ্নের মাঝেই বেঁচে আছি।
এইতো বেশ আছি, ভালো আছি।
ইমন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।