বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা কার হবে? এ রকম একটি প্রশ্ন প্রায়ই মাথায় ঘুরপাক খায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত তারা কেন এই কাজটি করছে- সে প্রশ্ন মাথায় আসাটা স্বাভাবিক। ’৭১-এ যারা বাংলাদেশ চায়নি এবং যারা তারপরও স্বাধীন বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি তাদের জন্য বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াটা বিছুটি পাতার মতো জ্বলুনিদায়ক, সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যার মানুষ তৈরি হয়েছে যারা বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখার পক্ষপাতী এবং সে জন্য তারা বাংলাদেশে নানারকম অঘটনা ঘটিয়ে এখানে বিশৃঙ্খলা বজায় রেখেই নিজেদের আখের গোছাতে চায়। এই শ্রেণীটির কথাই আমি ভাবি, আসলে কোথায় তাদের স্বার্থ?
এ রকমই একটি প্রশ্নের খুব সহজ উত্তর দিয়েছেন এক বন্ধু সেদিন এক চায়ের আড্ডায়।
বন্ধুর মতে, বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয়ে ওঠে তাহলে যারা দারিদ্র্যহার বাড়িয়ে বিদেশীদের কাছ থেকে অর্থ আনতে চায় তাদের ব্যবসায় টান পড়ে। আবার বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে একদল লোক চায় বিদেশের খবরদারিতে অনির্বাচিত একটি কর্তৃপক্ষকে সরকারী ক্ষমতায় রাখতে, তাই তারা কথায় কথায় বলতে থাকেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ধ্বংসের রাজনীতি; এখানে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই। যাঁরা এ রকমটি বলেন তাঁরা নিজেরাও এদেশেরই নাগরিক এবং বোদ্ধা শ্রেণীভুক্ত, কোনদিন তাঁরা রাস্তায় নামেননি; তাঁদের খাওয়াদাওয়া, বসন-ভূষণ সব নিশ্চিত, তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেউই এদেশে লেখাপড়া করে না- সাধারণ জনগণকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য হাজির করাই তাদের স্বভাব। এর বাইরে আরেকটি শ্রেণী আছে যারা চায় বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমা উদার গণতান্ত্রিক রীতি-বলয়ের বাইরে থাকুক, বাংলাদেশ হোক একটি ধর্মরাষ্ট্র এবং সে জন্য তারা বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াকে থামিয়ে দিতে প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে নিয়ে জান দিতেও প্রস্তুত। মাঝে মাঝেই এরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং দেশের একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী এদের ভরসা করে ভোটের রাজনীতিতে টিকে থাকতে চায় এবং প্রকারান্তরে এই রাজনৈতিক শিবিরটিও চায় না বাংলাদেশের অগ্রগতি।
এর বাইরে আরেকটি গ্রুপ এখনও পড়ে আছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সেøাগানে, কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশের জন্য খুব একটা ক্ষতিকারক নন, বরং তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা অপরাধ; শুধু তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তববোধের বাইরে নিজেদের এখনও আবদ্ধ রেখেছেন বলে একটু দুঃখ করা যেতে পারে। বন্ধুর এই বিশ্লেষণ পুরোটা মেনে না নিলেও আংশিকভাবে মেনে না নিয়ে উপায় নেই। কারণ চোখের সামনে এই পক্ষগুলোর কাজকারবার দেখছি এবং বন্ধুর কথার অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই এদের কর্মকা-ের সঙ্গে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়ানোর কথা ছিল না। কিন্তু ’৭১-এর আগে বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির যে বিশাল উত্থান পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোকে অস্তিত্ব দিয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের ভেতর দিয়ে সেই শ্রেণীটি পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই এই রাষ্ট্রকাঠামো ক্রমাগত নিম্নমুখী গতি লাভ করেছে।
কোন সূচকেই পাকিস্তান এরপর আর উর্ধমুখী হয়নি। বিশ্বাস না হলে পাকিস্তান সম্পর্কিত তথ্যকোষ ঘেঁটে দেখতে পারেন। এই বাঙালী মধ্যবিত্তই পাকিস্তানকে মোটামুটি স্থিতিশীল রেখেছিল কিন্তু এরপর থেকে পাকিস্তানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি আর দাঁড়াতেই পারেনি। পাকিস্তানী শাসককুল এটাই চেয়েছিল; এবং তারা এরপর একচ্ছত্র শাসন কায়েম করে নিজেদের বিপুল বিত্ত-সম্পদের মালিক করলেও পাকিস্তানকে ফতুর করেছে ক্রমাগত। পাকিস্তানে এমনও এলাকা আছে যেখানে আজও স্কুল করতে দেয়া হয়নি; আজও সেখানকার মানুষ স্থানীয় জোতদারের ভূমিদাস যেমনটি ছিল সেই এলাকার মানুষের পূর্ববর্তী প্রজন্ম।
আগামীতেও যাতে এর ব্যত্যয় না হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে জোতদার শ্রেণীটি। শিক্ষাবঞ্চিত রেখে ধর্মভিত্তিক উন্মাদনা দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদার গণতন্ত্রের সুফল সম্পর্কে অজ্ঞাত রাখার নিট ফলাফল হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণীর সুবিধা নিশ্চিত করা এবং এর ফলে পাকিস্তানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা। আজকে পাকিস্তানে যে ধর্মোন্মাদনা ও সেনাবাহিনীর যে জোশ তা আসলে আর কিছুই নয়, দেশটিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও অর্থনীতির অনুপস্থিতি। হয়ত বিষয়টির খুব সরলীকরণ করা হলো, কিন্তু এটাই মোদ্দা কথা। বাংলাদেশেও এই প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, বিশেষ করে ’৭৫-এর পর থেকে।
আমরা লক্ষ্য করেছি কি-না জানি না জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও তারপর বেগম জিয়ার আমলে বেছে বেছে এমন কিছু মানুষকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে সমাজে/রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল যারা আসলে পাকিস্তানের ওই ফিউডাল লর্ডদের (সামন্তপ্রভু) মতো মানসিকতারই অধিকারী। হিসেব কষলে দেখা যাবে যে, এই তিন আমলে বাংলাদেশে অন্তত কয়েক লাখ মানুষ বিত্তপতি (যাদের সম্পদের আসলে কোন মা-বাপ নেই) হয়েছে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে, কিংবা বলা ভাল তাদের বিত্তের বখরা দিয়ে তারা রাজনীতিতে আসন কিনে নিয়েছে। তারা নিজেদের এলাকায় অর্থ, প্রতিপত্তি ব্যবহার করে মানুষের জমি দখল করেছে, উন্নয়নে বাধা দিয়েছে এবং নানা কৌশলে সমাজের এগিয়ে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আরেকটু বাড়িয়ে বললে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না হওয়ার পেছনে এরা বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র আসলে হয়ে পড়েছে ছাঁচের সন্দেশের মতো।
সন্দেশ যেমন ছাঁচের বাইরে গেলে তেড়া-ব্যাঁকা দেখায় তেমনই এদেশের গণতন্ত্রও একটু ছকের বাইরে বেরুলেই তাকে কেমন যেন বেমানান লাগে।
কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট বিচারে পরিস্থিতি বোধ করি খানিকটা বদল হয়েছে। গাছে ঠিকমতো জল-হাওয়া-সার দিলে যেমন গাছ তরতরিয়ে বাড়ে গণতন্ত্রও তেমনই। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানাদিও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সময় লাগে না খুব একটা। আজকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া কিংবা সমাজ-ধর্মের নিগড় ভেঙ্গে লাখ লাখ নারীর বাইরে বেরিয়ে এসে উপার্জন প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়া, আগের চেয়ে শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় নিয়ম-কানুনের প্রতি আগের চেয়ে খানিকটা হলেও শ্রদ্ধাশীল হওয়া ইত্যাদি বিষয় কিন্তু আমাদের ইতিবাচক ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিতবাহী।
কেবল প্রয়োজন এই অগ্রগতির পথকে কেউ যাতে থামিয়ে দিতে না পারে তা নিশ্চিত করা। এখানেই আসে গণতান্ত্রিক দায়িত্ব ও বোধের প্রশ্ন। আমরা কি নিজেদেরকে কখনও প্রশ্ন করে দেখেছি যে, রাষ্ট্রের প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্ববান? আমরা সারাক্ষণই রাষ্ট্র আমাদের কি দেয়নি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত থাকি। আমরা সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে যতটুকু সোচ্চার, ততটুকু কি নিজেদের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে হই? হই না। তার মানে হচ্ছে আমরা নিজের দায়িত্বকে অবহেলা করে অপরে কি করল না করল সেটুকু খুঁজতেই ব্যস্ত থাকি বেশি।
নইলে মিউনিসিপ্যালিটি রাস্তা পরিষ্কার করে কি করেনি তা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে রাস্তা ব্যবহারকারী হিসেবে নিজেরাই রাস্তা যাতে অপরিষ্কার না হয় তা নিশ্চিত করতাম।
আমার বাড়ির পাশেই হাতিরঝিল। ঢাকা শহরের চকচকে চোখের মতো দেখতে। বিকেলবেলা অসংখ্য মানুষকে দেখি হাঁটতে এই চোখের কিনার দিয়ে। অসংখ্য বাচ্চা ছোটাছুটি করছে, তাদের হাতে খাবারের প্যাকেট, শেষ হতে না হতেই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে রাস্তায়।
বাচ্চারা তো বাচ্চা, বড়রাও কাজটি করছেন অবলীলায়। যে ময়লার গর্ত থেকে আজকে হাতিরঝিল অপরূপা হয়েছে তাকে বোধকরি খুব দ্রুত আবার পুরোনো রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সুন্দরকে অসুন্দর করা গণতন্ত্র নয়, বরং সুন্দরকে আরো সুন্দর করাই গণতন্ত্রের নিগূঢ় বার্তা। এটুকু তো সরকার আমাদের শিখিয়ে দিতে পারবে না, যদি না আমরা নিজেরাই শিখি। এটা কেবল একটি উদাহরণ মাত্র।
এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আজ বিদেশী ক্রেতারা প্রশ্ন তুলেছেন দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের নানা অসঙ্গতি নিয়ে। এই পোশাক শিল্পে সরকার যতটুকু সহায়তা দিয়েছে বা দিচ্ছে তা কোনভাবেই কম নয়। এই শিল্প কমবেশি প্রত্যেকটিই ব্যাংকলোন নির্ভর, সরকার বেশ সহজ শর্তেই এই ঋণ প্রদান করেছে। স্বীকার করছি যে, প্রয়োজনের তুলনায় অবকাঠামোগত সহায়তা অনেকটাই কম, কিন্তু সীমিত সম্পদের বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরী।
এই সেক্টরে অনিয়মের কারণে আজকে পুরো শিল্প-কাঠামোই ডুবতে বসেছে; বিদেশী ক্রেতা হারাতে বসেছে এবং এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হবে তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এই সেক্টরের ব্যবসায়ীরা যদি সামান্য সচেষ্ট ও সচেতন হন তাহলেই কিন্তু অনেক নেতিবাচক দিক থেকে বেরিয়ে পুরো পরিস্থিতি বদলে ফেলতে পারেন। এখানে কেবল সরকারকে দোষ না দিয়ে নিজেদের যে করণীয় রয়েছে বা পালনীয় ভূমিকা রয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারলেও কিন্তু আজকের এই দুরবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব। নিজেদের কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিক মারা যাচ্ছে, শ্রমিকের পাওনা বেতন না দিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করা হচ্ছে- সব মিলিয়ে যে অব্যবস্থায় আজকে এই সেক্টর পড়েছে তার দায় কেবল সরকারকে দিলে আমরা ভুল করব, তার সমান দায়ভার তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদেরও। এখানেও সেই দায়িত্ব পালনে অবহেলার কথাই বলব।
আরো মোটা দাগের একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। জনগণ ভোট দিয়ে সংসদ সদস্যদের সংসদে পাঠায় তাদের দাবিকে জাতীয়ভাবে উত্থাপনের জন্য এবং তারা যাতে কিছু পেতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের ‘রীতি’(?) হয়ে গেছে সংসদে না গিয়ে বেতন-ভাতা, গাড়ি-সুবিধা নেয়া আর জনগণের কথা যতটা সম্ভব না বলা। এই ‘রীতি’র বদল হওয়াটা যে জরুরী সেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নিশ্চয়ই আছে। আগামী নির্বাচনে এই বোধটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
নির্বাচনের আগেই প্রার্থীকে নিশ্চিত করতে হবে যে, তার দল হারুক বা জিতুক, সংসদে তাকে যেতেই হবে; জনগণের কথা তাকে বলতেই হবে। কেবল এই নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেই ভোট, নইলে ‘যাও বাপু, অন্য কোথাও’। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা গণতন্ত্রের দায়িত্বটুকু জানি এবং তা অনুসরণ করতে চাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।