''আমি যখন বাড়িতে পৌছুলাম তখন দুপুর
চর্তুদিকে চিকচিক করছে রোদ্দুর ....... শনশন করছে হাওয়া .... .. ...''
আমি যে ঘরটাতে থাকি তার জানালা দিয়ে কখনো শনশনে হাওয়ার শব্দ শুনিনি। সেখানে কখনো চিকচিকে রোদ ওঠেনা।
দীর্ঘ ছয়মাস হলো ঘর ছেড়েছি। ছোটবেলায় আমার সেজোফুপু পায়ের পাতায় তিল দেখে বলেছিলো --- '' বড় হলে তুই অনেক দেশ ঘুরবি। অনেক রংবেরং এর মানুষ দেখবি .... ...''।
শুনে আমার চোখ বড়বড় হয়ে যেত। ফুপুকে জিজ্ঞাসা করতাম, ...... অনেক দেশ মানে কয়টা দেশ? সেখানে যেতে হলে কী উড়োজাহাজে চড়ে যেতে হয়? এতো উপরে উড়োজাহাজে চড়তে ঠিক কয়টা মই লাগবে?''
আমার প্রশ্ন শুনে ফুপু হাসতো। কিন্ত আমি হাসতাম না। দাদুর লাইব্রেরীর 'তারা পরিচিতি' খুলে আমি সেই কালপুরুষ আর মৃগশিরা নক্ষত্রের দেশের গল্প পড়তাম। তখন আমার সেই কালপুরুষের দেশে যেতে মন চাইতো।
আবার পড়ার বই খুলে যখন নীশিথ সূর্যের দেশ , শাদা হাতির দেশ আর সূর্যোদয়ের দেশের গল্প পড়তাম , তখন আমার সূর্যোদয়ের দেশে গিয়ে সেই সূর্য ধরতে ইচ্ছে করতো।
রাতে বিছানায় শুয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করতাম.....'' মা, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠলে কী আমি এই এত্তে্া বড় হয়ে যাব.......? .... ঠিক ঐ ছোটকাকার সমান? ''
মা জিজ্ঞেস করতো , ''কেন , বড় হতে চাস কেন?বড় হলে অনেক কষ্ট, কেউ আদর করে না। '' তখন আমি বলতাম.... ''কিন্তু সেজোফুপু যে বলেছে, বড় হলে নাকি আমি অনেক দেশ ঘুরবো। অনেক রং বেরং এর মানুষ দেখবো.......................। তাই বড় হতে চাই ।
''
তারপর লালবল, মার্বেল , ডাংগুলি, চড়ুইয়ের বাসা আর গোল্লাছুটের মাঠ ছেড়ে একদিন আমি কীভাবে কীভাবে যেন একছুটে বড় হয়ে গেলাম।
এবং সেজোফুপুর কথা অনুযায়ী একদিন সত্যি সত্যি বিদেশের ডাক পেলাম। তখন যেন আমার নিজেকেই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো।
যাহোক, স্বাভাবিক নিয়মে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মোবাইল সেটটা ছোটবোনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এবং ওকে বারবার আমার ছোট্ট লাইব্রেরীর বইগুলোকে দেখেশুনে রাখার কথা বলে প্লেনে চড়লাম। প্রথমবার প্লেনে চড়ার অনুভূতি যে কেমন অসাধারন ছিল তা আর লিখে বোঝানো যাবে না।
যাহোক ,এখানে এসে প্রথম দু'সপ্তাহ আমার কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। এরপর ধীরে ধীরে আমার ঘোর কাটতে শুরু করলো। আমি উপলব্ধি করলাম , এই দেশ আসলে আমার জন্য নয়। এদেশের বৃষ্টি, পূর্ণিমা, কৃত্রিম সভ্য মানুষ আর আসদার স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের চেয়ে আমার দেশের শ্রাবনের সন্ধ্যেবেলার ঝুম বৃষ্টি, লোডশেডিং এর রাতে নাগরিক পূর্ণিমা আর শীতের রাতে বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে খোলা উনুনে বানানো ধূলিমাখা ভাপাপিঠার স্বাদ অনেক বেশি অন্যরকম...................। ''
ভাল্লাগেনা............. আমার কিচ্ছু ভাল্লাগেনা....................।
একটু অবসর পেলে মায়ের মুখটি মনে করার চেষ্টা করি । তখন কেমন যেন ঝাপসা লাগে।
চৌরাস্তার মোড়ের সেই জনাকীর্ন ব্যস্ততা আমি এই হাজার মাইল দূর থেকে অনুভব করি, মাইক্রোস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে বসে মুখর আড্ডায় পার করে দেয়া বিকেলগুলোকে এখানকার ধোঁয়াটে বিকেলগুলোর সাথে যেন কোনভাবেই মেলানো যায়না। ফার্মগেটের ওভারব্রীজের নীচের সেই একটাকা দামের ঝালপুরিগুলোকে আমার কাছে যেন অনেক বেশি দামী বলে মনে হয়।
সেইসব ফেলে আসা দিনগুলিকে আমার কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়.....।
তাই সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে রুমে এসে একটু নিশ্বাস ফেলি। তখন অনেককাল আগে ফেলে আসা সেই ছোটবেলার স্বপ্ন আবার আমার দুচোখে ভর করে। আর আমি অনেক দেশের কথা ভুলে কেবলমাত্র একটি দেশের কথা ভাবি। তখন হঠাৎ করে আমার নির্মলেন্দু গুনের ''হুলিয়া'' কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। আর নিজেকে মনে হয় কবিতার সেই পালিয়ে বেড়ানো যুবক।
যেকিনা পাঁচ বছর পর নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পথে দুপুরের চকচকে রোদ দেখে বলেছিল.......
''আমি যখন বাড়িতে পৌছুঁলাম তখন দুপুর......
চর্তুদিকে চিকচিক করছে রোদ্দুর ........ শনশন করছে হাওয়া.....''
সত্যি , আমি বহুদিন চিকচিকে রোদ দেখিনা, মায়ের হাতের স্পর্শ পাইনা,ছোটবোনটির সাথে ঝগড়া করিনা, পূর্ণিমার রাতে এই এত্তো বড় চাঁদ উঠলে মোনায়েম ভাইয়াকে ফোন করে বলিনা.... ''ভাইয়া, আজকের রাতের চাদঁটা দেখছেন? আজ কিন্তু সারারাত নৌকায় করে ঘুরবো.....। ''
ভালো থেক বাংলাদেশ। তোমাকে উপলব্ধির জন্য এই নির্বাসনের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল.......। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।