আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বভালবাসা দিবস নয়; স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস .....

একজন তরুন.. ১৪ ফেব্রুয়ারি: স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস; অন্য কিছু নয়! সময়টা ১৯৮৩। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ছাত্র জমায়েত। মজিদ খানের কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দী মুক্তি ও জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে এই জমায়েত। সেটাই পরিণত হল বুট ও বুলেটে-দমিত জনতার এক বিরাট প্রতিরোধে। জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালীসহ সারাদেশে প্রাণ দিল ১০ জন।

সরকারি হিসাবে গ্রেপ্তার হয় ১হাজার ৩১০ জন। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ চেতনার দিন। সে থেকে দিনটি পালিত হচ্ছে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে! লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল ১৯৭১ সালের পর মার্কিন, রুশ ও ভারতের তাঁবেদার এদেশীয় শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন উপদলের মধ্যে ক্ষমতা সংহত করার জন্য অন্তহীন রক্তাক্ত সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের এভাবে ক্ষমতা দখলকে মোকাবিলা করতে সেদিন চূড়ান্ত অক্ষমতা প্রদর্শন করে।

বরং অনেকটা নীরবেই তারা এরশাদের স্বৈরশাসন মেনে নেয়। কিন্তু ছাত্ররা এ সামরিক অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি । তাই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশেষত ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় ছিল আট বছর ২৫৬ দিন।

এ দীর্ঘ নয় বছরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ কারাবরণ করেছে, হত্যা-গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ, কিন্তু থামেনি আন্দোলন। রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করে। ২৪ মার্চ কলাভবনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় ছাত্রনেতা শিবলী কাইয়ুম, হাবিব ও আ. আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাঁদের সাত বছরের কারাদন্ড হয়। সেই থেকে শুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াই।

বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদ বেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী চলে আসে, স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। সরকারি ফরমান ও তৎপরতার কারণে সে সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের দেয়াল লিখন সমানে মুছতে থাকে সামরিক সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। পুলিশ যত দেয়াল সাদা চুন টেনে মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই দেয়াল লিখন চালিয়ে যেতে থাকে।

এভাবেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলছিল দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রাথমিক প্রস্তুতি। এ সময় ছাত্রনেতারা একটি সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করা হয়। সেটাই ছিল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত প্রতিবাদ। মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধে: পাকিস্তান পর্বে পূর্ববাংলার ছাত্রদের প্রধান দাবি ছিল একটি সুলভ, সার্বজনীন, বৈষম্যহীন, বৈজ্ঞানিক, উৎপাদনমূখী, জাতীয় ও গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি।

এ সময় পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশের আপামর জনগণের উদ্দেশে ১১ দফা প্রণয়ন করেছিল। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরপরই তাঁর শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচন-কে ভিত্তি ধরে প্রণীত এ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়। এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলো। শিক্ষানীতিতেও সে প্রতিফলন ঘটে।

এ নীতিতে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই বাংলার সঙ্গে আরবি ও ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এ নীতি ছিল শিক্ষা অর্জনের জন্য মাতৃভাষার গুরুত্ব উপেক্ষা এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের দৃষ্টান্ত। সেই সাথে জাতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থি এবং শিশুদের জন্য নিপীড়নমূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০% বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়- এই শিক্ষানীতিতে। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার পঞ্চাশ ভাগ ব্যয় শিক্ষার্থীর পরিবারকে বহন করতে হতো।

ফলে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো দরিদ্র মানুষ। ছাত্ররা এ নীতির ব্যাপক বিরোধিতা করেন। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা দিবসে এ শিক্ষানীতি বাতিল করার পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলো একমত হয়। ১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে গণসাক্ষরতা অভিযান চলে।

দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়। এ সংগ্রামকে প্রতিরোধ করতে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুককে গ্রেপ্তার করলে ছাত্ররা আরো ফুঁসে ওঠেন। তাঁর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এবার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি হাতে নেয়। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩।

কে জানত বসন্তের আগুনরাঙা রঙের সঙ্গে মিশে যাবে ছাত্রদের রক্ত। কি ঘটে ছিল সেদিন সেদিন মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেনের বর্ণনা মতে, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি আরো সুশৃঙ্খল, আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ছাত্ররা কর্মসূচিতে যোগ দেন। মিছিলের প্রথমে শতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। খুবই শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল, উৎসবের মতো অনেকটা। ব্যারিকেডের সামনে যখন মিছিল যায় হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল-সংলগ্ন এলাকায়, তখন মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন।

নেতারা তারকাঁটার ওপর উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। মিছিলটি ছিল হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। কিন্তু কোনো উসকানি ছাড়াই তারকাঁটার একদিক কিছুটা সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররা তখন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন।

পুলিশ তখন ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। সেদিন জয়নালকে গুলিবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। বেয়নেট ফলা আর জয়নালের শরীর থেকে চুইয়েপড়া রক্ত বাংলার পথ-প্রান্তর ভাসিয়ে দেয়। শুধু জয়নাল নয়, ছাত্রদের ওপর পুলিশি তা-বের সময় শিশু একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়।

তবে দিপালীর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জয়নাল পড়েছিলেন কার্জন হলের মধ্যে। তাঁকে ধরে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে যেসব ছাত্র সকালে মিছিলে আসেননি, তাঁরা বিকেলে জয়নালের জানাজায় বটতলায় উপস্থিত হন। হাজার হাজার সাধারণ মানুষও উপস্থিত হয়।

’ পুলিশ সেদিন শুধু হত্যা করেই স্থির থাকেনি, বিকেলে ক্যাম্পাসে একটি যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করে সেনাবাহিনী। তার সঙ্গে যোগ দেয় বিডিআর-পুলিশ। শাহবাগ, টিএসসি চত্বর, কলাভবনের সামনে, নীলক্ষেত, কাঁটাবনের রাস্তা ধরে পুরো অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলে তারা। অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় বহু ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মেরে হাত-পা ভেঙে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। কলাভবনের ভেতরে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক যাঁকে পেয়েছে তাঁকেই নির্যাতন করেছে। ওখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খ ম জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাত্রনেতা আরও বলেন, ‘আমরা জয়নালের লাশ লুকিয়ে ফেলেছিলাম মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে।

লাশের খোঁজে পুলিশ চারুকলায় ঢুকে ছাত্রদের নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করে। পুলিশ খুঁজে খুঁজে পোশাকে রঙিন গরম পানির চিহ্ন দেখে দেখে গ্রেপ্তার করে। অবশেষে মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে লাশ পাওয়া গেলে অন্যান্য হলে লাশের তল্লাশি বন্ধ করা হয়। কিন্তু গ্রেপ্তার করে দুই সহগ্রাধিক ছাত্র-জনতাকে। সরকারি হিসাবেই এ সংখ্যা এক হাজার ৩৩১ জন।

গ্রেপ্তারকৃতদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। এরপর তাঁদের তুলে দেওয়া হয় আর্মির হাতে। বন্দি ছাত্র-জনতার ওপর প্রথমে পুলিশ ও পরে আর্মি নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায় । মেয়েদেরও গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রবল চাপের কারণে তাঁদের ১৫-১৬ তারিখের মধ্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

১৪ তারিখ শুধু জয়নালের লাশ পাওয়া যায়। জয়নালের বাড়ি ছিল নোয়াখালীর চাটখিল থানার দোলাইপাড়ে। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে আর্র্মি। আরো অনেকে নিখোঁজ হয়। তাদের জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থায়ই পাওয়া যায়নি।

’ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকারী ও অ্যালবামের সংকলক খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন, আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। রাজনৈতিক সংগঠন করি না। কিন্তু রাজনীতিসচেতন। ঢাকার দিপালী সাহা, জয়নালসহ অনেকে মারা যান। স্বৈরাচারবিরোধী এটিই প্রথম ব্যাপকতর বিদ্রোহ।

এর আগে এত বড় বিদ্রোহ আর হয়নি। এর বাঁধভাঙা ঢেউ লাগে চট্টগ্রামেও। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাকে করে চলে আসি শহরে। মেডিক্যাল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা এলে মিছিল করি। মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ ও ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ করে।

এতে শহীদ হন কাঞ্চন। মধুর কেন্টিনের কর্ণধার অরুণ কুমার দে সেদিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৪ তারিখ সকাল ১১টার দিকে কলাভবনের সামনে ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থীর সমাবেশ হয়। এরপর ছাত্ররা মিছিল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে যান। হাইকোর্টের গেটে সংঘর্ষ হয়। বিকেল ৫টার দিকে দরজা ভেঙে পুলিশ মধুতে ঢুকে রান্নাঘরে গিয়ে কর্মচারীদের নির্মমভাবে পেটায়।

ওরা আমাকে পুলিশভ্যানে করে নিয়ে যায় শাহবাগের কন্ট্রোল রুমে। কন্ট্রোল রুমের মাঠে নিয়ে সবাইকে আবার মারে। এরপর গরম লবণ-পানি খেতে দেয়, যাতে আমাদের শরীর ফুলে না যায়। কিছুক্ষণ পর আর্মির লোক এসে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়। ওই রাতেই সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমাদের ধরে নিয়ে যায় আর্র্মি।

সকালে রুটির ট্রাক আসে। আমি বন্দি ছাত্রদের রুটি ভাগ করে দিতে যাই। তাতেও ক্ষিপ্ত হয় সেনারা। তারা আবার আমাকে পেটায়। সন্ধ্যায় একটা গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যায় ট্রানজিট ক্যাম্পে।

সেখানে চলে আবারও নির্যাতন। এ সময় ছাত্রদের মাথা ধরে দেয়ালে আঘাত করে সেনা কর্মকর্তারা। ’ সামরিক আদালতে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাবেক ছাত্রনেতা সদ্য প্রয়াত শিবলী কাউয়ুম সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তখন আমি বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরশাদের প্রথম দিনেই আমরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। এরপর পোস্টারিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হই।

আমাদের তিন জনের সাত বছর করে কারাদ- হয়। আমি জেলে থাকা অবস্থায় মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হয়। এতে শিশু বয়স থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আমি জেলে থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি।

আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘটে চূড়ান্ত বিস্ফোরণ। একাত্তরের পরে এর চেয়ে বড় আন্দোলন আর কোনোটাই নয়। হাজার হাজার ছাত্র এ আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলন দমনে সরকারি বাহিনী যে নির্যাতন করে, তা ভয়াবহ। আমি তখন রংপুর জেলে।

বাইরে মিছিলের স্লোগান শুনতে পাই। কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে আনা হয়। আমার সামনে জেলের মধ্যে দুটি ছেলের মাথায় আঘাত করে মগজ বের করে দেয় পুলিশ। এভাবে অসংখ্য মানুষ প্রাণ দেয় এ আন্দোলনে। তবে আন্দোলনটি সফল হয়।

আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায়। ছাত্রবন্দিদের মুক্তি দাবীতে আমরা তিনজন মুক্তি পাই। সামরিকতন্ত্রের অবসান না হলেও ঘরোয়া রাজনীতির অধিকার দিতে বাধ্য হয় সামরিক জান্তা। ’ আন্দোলনের সামনে সামরিক স্বৈরাচার মাথানত করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছেড়ে দেয় এক হাজার ২১ জনকে এবং আটক রাখে ৩১০ জনকে।

১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে সরকার। সংসদীয় স্বৈরাচার নিপাত যাক, জনগণের গণতন্ত্র মুক্তি পাক মুক্তির জন্য একাত্তরে মানুষ অকাতরে রক্ত দিল। বিনিময়ে পেল এক নতুন ফ্যাসিস্ট শাসন। শাসক শ্রেণীর দল-উপদলগুলোর মধ্যে প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় ক্ষমতার কামড়াকামড়ি। বাকশালী শাসন, সামরিক গণতন্ত্র শেষে এলো সামরিক স্বৈরাচার।

দেশে চলছে এখন পার্লামেন্টারি স্বৈরাচারের কাল। কেবল সামরিক পোশাকটা বদলেছে। স্বৈরাচারী ক্ষমতাটা অটুট রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তখন এরশাদের মিলিটারি ছিল ব্যারাকে। তাই তারা পাড়ায়-মহল্লায়-কর্মস্থলে-শিক্ষাঙ্গণে পূর্ণরাজত্ব কায়েম করতে পারেনি।

এ সুযোগে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্ররা সক্ষম হয়েছে শক্তিশালী সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলতে। আর এ পার্লামেন্টারি দুঃশাসনের কালে শাসকরা ঘরে ঘরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সংগঠন, সমাবেশ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সীমাহীন দুর্নীতি-দলীয়করণ-সন্ত্রাস, সংগঠন-সমাবেশে বাধা, জুলুম-নির্যাতন, ক্রসফায়ার-গুম নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবাসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, তীব্র মজুরি শোষণ, ফসলে লোকসান ও বেকারত্বের কারণে জনগণের আর্থিক দুর্দশা বাড়িয়েছে।

বিচার ব্যবস্থা হয়েছে বিপর্যস্ত। দেশ খুনী ও অপরাধীদের স্বর্গে পরিণত হয়েছে। সাম্রাজ্যাবাদী, সম্প্রসারণাদীদের স্বার্থে দেশকে পাইকারি হারে বিক্রি করেছে। তারা উপনিবেশবাদী শক্তির নির্দেশে সমগ্র রাষ্ট্র ও সমাজের পুনর্বিন্যাসের নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে। সেইসাথে দেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সামরিক প্রতিযোগীতা ও যুদ্ধের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে।

শিক্ষার উপনিবেশিকীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, দলীয়করণ-ফ্যাসিকরণ রুখে দাঁড়ান! এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের পতন হলেও যেমন শাসক শ্রেণীর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেনি, তেমনি জনগণের শিক্ষার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংসদীয় স্বৈরাচারি ব্যবস্থা আজ ছাত্রদের উপর জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষানীতি-২০১০ চাপিয়ে দিয়েছে। এ শিক্ষানীতি হল সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালাল বুর্জোয়াদের স্বার্থে রপ্তানীমূখী আইটি শ্রমিক তৈরীর শিক্ষানীতি। প্রকৃতি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসের মত বিষয়গুলোর জাতীয় বিকাশের জন্য অপরিহার্য হলেও সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বাবধানে তৈরী ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদী উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে এসব বিষয় উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে কেবল বাজারের প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বাজারের খোরাক যোগাবার জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোও চালু করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ নিশ্চিত করেছে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর উপযোগী নৈতিক শিক্ষা। নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে ভারতীয় হাই কমিশন প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। শিক্ষা পদ্ধতিতে সমাজ ও জনবিমূখতা, উৎপাদন ও প্রয়োগ বিচ্ছিন্ন মুখস্তপনা ও তত্ত্বের কচকচি প্রাধান্য বিস্তার করেছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও শিক্ষা শেষে কাজের সাথে কোন সামঞ্জস্য নেই।

এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সুলভ ও সমান শিক্ষার সুযোগের দাবী উঠেছে বারবার। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার সা¤্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী পুনর্গঠনের কারণে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ তরান্বিত হয়েছে। এর প্রতিফলন ঘটছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ টিউশন ফি নির্ধারণ, সান্ধ্যকালীন বাণিজ্যিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা, স্কুলগুলোতে কোচিং ও ভর্তি বাণিজ্য, ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষার ব্যপক প্রচলন ইত্যাদি পদক্ষেপে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সা¤্রাজ্যবাদী বিরাষ্ট্রীয়করণ ও বাজার অর্থনীতির নীতি কার্যকর করার ফলে শিক্ষা জাতীয় স্বার্থের বদলে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবায় সম্পূর্ণ নিয়োজিত হয়ে পড়ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সমানাধিকারের নীতি বর্জিত হয়েছে।

এ অবস্থা দেশি-বিদেশী শিক্ষা ব্যবসায়ীদের দ্বারা মধ্যবিত্তের পকেট কেটে নেয়ার মওকা এনে দিয়েছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যে নির্বাচন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হচ্ছে। উপাচার্য তাই একাডেমির প্রতি নয়, অনুগত থাকছেন প্রধানমন্ত্রীর বরাবর। তিনি নিজেই স্বৈরাচারের ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে উঠছেন। এ কারণেই দেখা যায়, তীব্র আন্দোলনের মুখেও উপাচার্যরা প্রধানমন্ত্রীর ইশারা ছাড়া পদত্যাগ করেন না।

এভাবে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের স্বৈরতন্ত্র কায়েমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতারাও নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা। তারা নিজ প্রতিষ্ঠানে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছেন। শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ ছাত্ররা দূরে থাক, গণতান্ত্রিক সংগঠনের এমন কি শাসক শ্রেণীর বিরোধী দলগুলোরও বাক-স্বাধীনতা নেই, সংগঠন করার স্বাধীনতা নেই। ছাত্রদের মধ্যযুগীয় কায়দায় সরকার দলের সংগঠন করতে বাধ্য করা হয়।

‘গেস্টরুম’কেন্দ্রিক সমান্তরাল প্রশাসন সৃষ্টি করেছে সরকার দলের ছাত্রসংগঠন। এটাকে টর্চার সেল বললেও ভুল হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের কেবল দলীয়রূপই নয়, প্রশাসনিক রূপও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার সাম্রাজ্যবাদী পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদী উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা, অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাঙ্গণে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, ছাত্র সংখ্যা সীমিতকরণ ইত্যাদি সিদ্ধান্ত রয়েছে। ফখরুদ্দিনের সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের আমল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি খবরদারি বৃদ্ধি পেয়েছে।

এসময় থেকে ছাত্র আচরণ বিধি প্রণয়ন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করে শাস্তি প্রদান, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা, খবরদারি ও সুযোগ-সুবিধা হ্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো খর্ব করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের উপর সরকারের খবরদারি করার সুযোগ বৃদ্ধি, বিরাজনীতিকীকরণ, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন ইত্যাদির মাধ্যমে একাডেমিক-প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই নয়, কলেজগুলোতেও বিরাজ করছে একই ধরণের অবস্থা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো হচ্ছে অবহেলিত।

সেখানে লম্বা সেশন জট সৃষ্টি করা হয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসার খাতিরে। আর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনেও দলীয় ও প্রভাবশালীদের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাকুরি ও ভর্তি বাণিজ্যসহ বরাদ্দ আত্মসাতের হরিলুট চলছে শিক্ষাঙ্গণগুলোতে। রক্তের অক্ষরে লেখা শহীদের নাম ভেসে গেছে ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে দেশে যখন জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম দানা বাঁধতে শুরু করেছিল তখন পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী জাতির চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর আগ্রাসনসহ তারা চেয়েছিল আমাদের উপর বিজাতীয় ভাষা উর্দু চাপিয়ে দিতে।

ঠিক তেমনিই পার্লামেন্টারি স্বৈরশাসকদের আমলে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’-এর চেতনাকে ধ্বংস করতে উদ্যত আজকের শাসক শ্রেণী। সামরিক স্বৈরাচারের কয়েক বছর না যেতেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবে পালনের জন্য এ শ্রেণীর অন্যতম মুখপত্র যায়যায়দিন প্রচার শুরু করে। পাকিস্তানিরা ’৫২তে ব্যর্থ হলেও ক্যাবল আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে এবার সফল হয়েছে শাসক শ্রেণী। ‘আমি আর তুমি’র মত চরম স্বার্থপর, সমাজ-বিচ্ছিন্ন চেতনা যুব সমাজের মধ্যে চাপিয়ে দিতে পেরেছে। প্রেম-ভালোবাসার মত স্বাভাবিক সম্পর্ককে অতিপ্রাকৃত বিষয়ে পরিণত করে আফিম নেশার মত বুঁদ করে ফেলেছে।

ভোগবাদ আজ তাদের আদর্শ। এ ব্যক্তিগত ভালোবাসার একপিঠে কাম, আরেক পিঠে কর্পোরেট কালচারের উস্কানি। যৌনতা ও অশ্লিলতার মাদকতায় আসক্তি আজ সর্বব্যাপীরূপ নিয়েছে। বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন শো, লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার, সিনেমা, নাটক, যাত্রা, অশ্লিল নৃত্যের সিডি, ইন্টারনেটে পর্ণগ্রাফির ছড়াছড়ি, এফএম রেডিও-র মধ্যরাতের অশ্লিল অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব মিলিয়ে বিকৃত যৌনতা-অশ্লীলতার চর্চা যেন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে পরিণত হয়েছে। এরই পরিণতিতে আমরা দেখছি, সারা দেশে যৌন নিপীড়ন ও উত্যক্ত করা, ধর্ষণ ও হত্যার মত ঘটনা বেড়েই চলছে।

আর ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপনের সংস্কৃতি ঠিক এ জোয়ারকেই জোরদার করছে। শাসক শ্রেণী এ থেকে লাভ তুলে নিচ্ছে দু’ভাবে; সমাজের সবচেয়ে প্রাণবন্ত লড়াকু অংশ যুব সমাজকে মুক্তির লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন ও নির্জীব করে ফেলে এবং দিনটিকে বাণিজ্যের মহোৎসবে পরিণত করে। সামরিক আদালতে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত সাবেক ছাত্রনেতা শিবলী কাউয়ুম এ প্রসঙ্গে বলেন, “জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় ছাত্রদলের ছাত্ররা নানা অপকর্মের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন করে, তা থেকে ছাত্রসমাজকে মুক্ত করে ১৪ ফেব্রুয়ারির এ ছাত্র আন্দোলন। একটি মহল অনেক কায়দা-কৌশল করে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় এ ইতিহাসকে ঢেকে দেওয়ার জন্য পশ্চিমা সংস্কৃতির ভ্যালেন্টাইনস ডে- কে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিক চেতনাহীন করাই এর মূল অভিপ্রায়।

” স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতা মোস্তাক হোসেন এ বলে আক্ষেপ করেন: আন্দোলনের দুই যুগ পার হতে না-হতেই জনগণের কাছে বিস্মৃত হতে চলেছে জয়নাল-দিপালীদের নাম। আমি তুমি টাইপের ব্যক্তির ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার-প্রতিরোধ দিবস। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দিনটিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ স্বৈরাচার-প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করে আসছিল। নব্বই-পরবর্তী মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল জোয়ারে এদিনটি পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। রক্তের অক্ষরে যাঁরা আমাদের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন, তাঁদের জন্য অবহেলা ছাড়া আমরা কিছুই দিতে পারিনি।

” ভোট কিংবা সংস্কার নয়, আসুন, বিপ্লবী সংগ্রাম বেগবান করি! এরশাদের পতন ঘটিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন ছিল শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি সংস্কার মাত্র। এতে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার পোশাক বদল হয়েছে মাত্র। ফলে মার্কিনসহ সা¤্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং তাদের তাঁবেদার ফ্যাসিস্ট শাসক শ্রেণী দোর্দ- প্রতাপেই ক্ষমতায় রয়েছে। এতে বিপ্লব হয়নি, শাসক শ্রেণী ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়নি, শ্রমিক-কৃষক-জনগণের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ কারণেই স্বৈরাচারী এরশাদ আজ পুনর্বাসিত হয়েছে, সংসদীয় ব্যবস্থা উন্মোচিত হয়েছে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র রূপে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গণে চলছে খুনোখুনি, স্বৈরশাসন। আজ ছাত্র-যুব সমাজকে দেশপ্রেমিক, জাতি ও জনগণের সেবক হিসাবে গড়ে না তুলে, নৈতিক অবক্ষয়ের চরমে ঠেলে দেয়ার সবরকম আয়োজন চলছে। এ পরিস্থিতিতে উত্তরণের পথ ভোট বা সংস্কার নয়-এ কথা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। আজ কোটি কোটি বঞ্চিত জনগণের স্বপ্ন পুরণের একটিই পথ-বিপ্লব।

এদেশ, জাতি ও জনগণ মুক্তি পায় নি; কিন্তু তার মুক্তির আকাঙ্খা কখনো দমে নি। তার লড়াই কখনো থামে নি। জাফর, জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চনসহ লাখো শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে এ লড়াইকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের তরুণ প্রজন্মকেই। আসুন, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে আওয়াজ তুলি: *সংসদীয় স্বৈরাচার নিপাত যাক, স্বাধীনতা-গণতন্ত্র মুক্তি পাক! শিক্ষার উপনিবেশিকীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ, দলীয়করণ-ফ্যাসিকরণ রুখে দাঁড়ান! ‘ভ্যালেন্টাইন’ সংস্কৃতিসহ অশ্লীলতা, যৌনতা ও নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধে গড়ে তুলুন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।