mahbub-sumon.com
এবার প্লেনে উঠেই মনে হচ্ছে এবার আসলেই সে বাংলাদেশে যাচ্ছে। চারপাশে অনেক ভাত ভাতে চেহারা, বাংলায় কথা বার্তা। ওয়ার্ক অর্ডার-শিপমেন্ট-বায়ার-এলসি শুনেই কিছু লোককে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে। চেহারায় সুখি সুখি ভাব কিন্তুকেমন যেনো ধুর্ততার আভাস। যাত্রিদের বেশিরভাগই গতর খাটা সাধারন মানুষ , সেই চিরচেনা সংগ্রামী যোদ্ধা।
হয়তো অনেকের জন্যই এটা তাদের জীবনের দ্বিতীয় কিন্তু শেষ বিমানভ্রমন। আচরনে অনভ্যস্ততা ছাপ, চোখে দেশে ফেরত যাবার আনন্দ। কিছু তার মতো, প্রবাসী।
ছোটবেলায় শ্রতিলেখন বলে একটা খেলা হতো । একজন জোরে জোরে পড়তো আর বাকি সবাই শুনে শুনে তা লিখতো।
যে সবচাইতে শুদ্ধ ভাবে এবং বেশী লিখতে পারবে সেই বিজয়ী। নাফিজ সবসময়ই প্রথম হতো। এ অভ্যাসটি আজো রয়ে গিয়েছে। আশে পাশে কেউ কথা বল্লে সে শুনতে পছন্দ করে। আচ্ছা এই শ্রুতিলেখন খেলাটাকি আজো খেলা হয় ! নাফিজ ভাবছে।
মনটা একটি বিষন্ন নাফিজের। সে ভাবছে রাজিবের কথা। কতো বিচিত্র মানুষ! কতো বিরিত্র জীবন মানুষের ! কতো বিচিত্র মানুষের কস্ট।
এবার পাশের সিটে এক হংকং চায়নিজ মহিলা, সাজে তরুনী আদতে পেত্নি, ইংলিশে উচ্চারনে বিচিত্র। অবশ্য আলাপ জমানোর ইচ্ছে নেই নাফিজের একদমই।
সে ভাবছে আগত দিনগুলোর কথা। বিয়ে-সংসার-বাবা-মা-ভবিষ্যত জীবন।
টেলিফোনে হবু বউয়ের সাথে তিন চারবার কথা হয়েছে তার। শুধু ছবি দেখে আজকাল কি কেউ বিয়ে করে !! একজন আরেকজনকে দেখেনি কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে, এও কি ঘটে। আরে এটাতো তার জীবনেই ঘটছে!
" স্যার টি অর কফি "
কেবিনক্রুর কথায় চিন্তায় ছেদ পরলো নাফিজের।
"টি প্লিজ" বলে মুচকি হাসতেই কেবিন ক্রু অভ্যস্ত হাতে চা দিয়ে চলে গেলো। "থাংকস মাইট " বলে একটু হাসলো নাফিজ।
এই কেবিন ক্রুর চেহারা কেন জানি সব সময়ই একই রকম লাগে নাফিজের। যতোবারই সিংগাপুর এয়ারে সে ভ্রমন করেছে ততবারই মনে হয়েছে সেই একই কেবিন ক্রু। এতবার অস্ট্রেলিয়ার বাহিরে বের হতে হয়েছে নাফিজকে ততবারই সে ভেবেছে সময়কারে সে একটু দেশে যাবে।
হয়নি, কেন হয়নি সেটা অজানা।
৪ ঘন্টা যে কখন শেষ হবে !! অস্থির নাফিজ।
৬ বছর পর দেখা হবে বাবা মার সাথে। পলাশীর মোড়ে চা- মিতালি হোটেলের পরাটা ভাজি কতদিন খায়না সে। আচ্ছা বন্ধুরা কি সবাই আগের মতোই আছে ? মোড়ের মুন্শির দোকানটাকি আছে !
"ভাই আমার ফরম টা একটু পূরন কইরা দিবেন"
চমকে উঠে নাফিজ।
তাকিয়ে দেখে একটি ছেলে, কতই বা বয়স হবে ২০ !! ২২ ?
"সমস্যা নাই" বলেই নাফিজ পুরণ করতে থাকে ফরমটি। শেষ হতেই যখন সই করতে বল্ল তখন সে আবিস্কার করলো ছেলেটি লেখা পড়া জানে না। কোনক্রমে সই করতেই আরেকজন বল্ল ভাই আমারটাও কইরা দিবেন !
এভাবে বেশ কিছু ফরম পূরন করতেই নাফিজ নিচে তাকিয়ে দেখে। বাংলাদেশ দেখা যাচ্ছে। কক্সবাজার-চিটাগাং - নারায়নগন্জ- এইতো ঢাকা !! সে তাকিয়েই আছে।
অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু সে বোঝার চেস্টা করছে কোথায় কি। অন্ধকারে সবইতো একরকম লাগছে।
এয়ারপোর্টে সে বিদেশী পাসপোর্টধারীদের লাইনে দাড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি সব ফর্মালিটি শেষ করতেই চোখে পড়লো রাজিবকে। বয়স্ক এক লোককে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে। পাশে দাড়িয়ে শাড়ি পরা এক কিশোরী মেয়ে।
মেয়েটাকি রাজিবের বউ? নাফিজ ভাবছে রাজিবের কাছ হতে বিদায় নিয়ে আসবে, পরমুহুর্তেই ভাবলো 'কি দরকার, থাক'।
ওইতো মা, ওইতো বাবা। পারলে সে উড়ে যায়।
পেছনে সে আবার তাকিয়ে দেখে রাজিব সেই বৃদ্ধ লোকটির হাত ধরে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। নাফিজের কান বাজছে রাজিবের কান্না জরানো সেই কথাগুলো।
"ভাই, আমি আপনার লগে মিথ্যা কথা কইছিলাম, আমি কোরিয়া গিছিলাম তয় ৮ বছর থাকি নাই। ভিসা শ্যাষ হওনে ইল্লিগাল ছিলাম। ২ মাস পরেই পুলিশ কারখানায় রেইড দিয়া ধরছে, তার পর সোজা প্লেনে তুইলা দিছে। ৮ লাখ টাকা খরচ কইরা কোরিয়া গেছিলাম, বাপের ভিটা-ধানের জমি জমা সব বিক্রি কইরা গেছিলাম, একটাকাও ফেরত আনতে পারি নাই, দ্যাশে আমার এখন থাকনের জায়গাটা পর্যন্ত নাই। "
"আমার বাবু সোনা, ও আমার বাবু সোনা" মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে নাফিজ, সেই ছোট্টবেলার মতো।
বাবা সেই আগের মতোই নিরুত্তাপ, মুচকি হাসি।
মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নাফিজ।
এর পরে কি হলো সেটা অন্য আরেক গল্প।
(শেষ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।