বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা দিয়েই শুরু করি। হলে ওঠার কিছুদিন পর এক মামার সাথে কথা বলছি, মামা মানে উনি হলের বাগান পরিচর্যা করেন। মামার এক মেয়ে তিন ছেলে। বড় ছেলে স্কলারশীপ নিয়ে জাপানে পড়ছে, মেয়েটা আছে সুইডেনে, একইভাবে স্কলারশীপ নিয়ে, পরের ছেলেটা একাউন্টিংএ পড়ছে, আর সবচে’ ছোট যেজন, এইবার ইউ ল্যাব এ নবম শ্রেণীতে পড়ছে।
আমাদের হলের ইমাম সাহেবের এক ছেলে ছিল আমাদের একটু সিনিয়র, সম্ভবত বাংলায় পড়তেন।
হল মসজিদ লাগোয়া একটা রুমে তিনি থাকতেন। দেখতে খুব ফর্সা এবং বেশ সুন্দর, চোখে পড়তো। কিছুদিন পর যখন তাঁর অনুপুস্থিতি অনুভূত হল, শুনলাম স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যন্ড গেছেন। ইমাম সাহেবের পরের ছেলেটাই আমার সদ্য ফেলে আসা হলে এখন ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারী।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এরকম মেধাবী পরিবার অনায়াসেই পাওয়া যায়।
শিক্ষক পরিবারের কথা নাই বা বললাম।
একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বিশেষত টিচার্স কলোনীগুলোর পরিবেশ এমনই যে সেখানে মেধাবী না হওয়াটাই অবাক হওয়ার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় একটা শিশু দিনের পর দিন এই বিশ্ববিদ্যালয়কেই দেখে, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকেই পাশে পায়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে সে অবচেতন মনেই নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করাটা তার জন্য অবধারিত হয়ে যায়।
বাইরে থেকে আসা একটা ছেলে বা মেয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষা যে ভীষণ ভীতিকর এবং টেনশনের চুড়ান্ত রূপ হিসেবে আবির্ভূত হয়, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ভর্তি পরিক্ষার্থীদের কাছে সেরকম নয় মোটেও। (স্কাউট সূত্রে ভর্তি পরীক্ষায় ভলান্টারি সার্ভিস দেওয়ার সময় আমি নিজে অনেক পরিক্ষার্থীকে সব হারানোর কষ্টে কাঁদতে দেখেছি, যারা টেনশনে ভূল করে বাংলার যায়গায় ইংরেজী বা ইংরেজীর যায়গায় জেনারেল নলেজ এর গোল্লা পূরণ করে এসেছে)
এত কিছুর পরও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অসংখ্য ছেলে মেয়ে থাকে যারা অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনা। তাদের জন্য রয়েছে কোটা সিস্টেম। মেধা তালিকায় না এসেও শুধুমাত্র পাশ মাকর্স পেলেই তারা ভর্তি হয়ে যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন আরাধ্য বিষয়ে। (যদিও আমি বিশ্বাস করি হাল আমলের মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন পদ্ধতি মেধা যাচাইয়ের সঠিক পদ্ধতি নয়)
আমার হলের সেই মামা এবং ইমাম সাহেবের ছেলে মেয়েদের মেধার প্রতি সন্মান রেখেই বলছি, এই কোটা সিস্টেমের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আরোপিত মেধাবী পরিবারের ছড়াছড়ি।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফাক ফোকর গলে তারা স্কলারশীপ নিয়ে বাইরে চলে যাবে মোটামুটি রেজাল্ট করলেও। অন্যদিকে বহু মেধাবীকে পাওয়া যাবে, যার কাছে স্কলারশীপের খবরটিও পৌঁছুবেনা সময়মত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্টদের পোষ্য কোটা ছাড়াও রয়েছে খেলোয়াড় কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং সম্ভবত আদীবাসী কোটা। গত কয়েক বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে, ভূয়া ছাত্রের বেশীর ভাগই আসে এই কোটাগুলোর মধ্য দিয়ে। আমার এক বন্ধু আবাহনীতে গোলকিপার ছিল, সেই সূত্রে আমাদের সাথে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হয়েছিল মার্কেটিংএ।
তখন তার মধ্যে সম্ভাবনার জোয়ার, আজ রাশিয়া, কাল ওমান, তারপরদিন ন্যাশনাল লিগ, আমার বন্ধুর দেখা পাওয়া যায়না আগের মত। আমরা যখন থার্ড ইয়ারে, একদিন মল চত্ত্বরে দেখা। সে তখন পাবলিক এ্যাড বা পল সায়েন্সে ভর্তির জন্য কাগজ পত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে । সারা জীবন কমার্সে পড়েও কিভাবে আর্টসের সাবজেক্টে ও মাইগ্রেশন করতে পারল, সে জ্ঞান আমার নেই।
তার চেয়েও অবাক ব্যাপার, এই ঈদে বাড়িতে গিয়ে আবার তার সাথে দেখা, ও নাকি এখনও অনার্সেই পড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টিমের গোল রক্ষক সে এখন।
এই হল কোটার অবস্থা।
আমার কথা হল, মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কেন রেয়াত থাকবে? সঠিক মেধাকে বঞ্চিত করে কেন অযোগ্যকে সামনে আনতে হবে? যদি সুবিধা দিতেই হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নয়, বরং ভর্তি হতে পারলে কোটাধারীদেরকে সম্ভাব্য সব উপায়ে প্রোমোট করা হোক। বা ভর্তি পুর্ব পড়াশুনায় সাহায্য করুক বিশ্ববিদ্যালয়।
এবার আসি চাকুরী ক্ষেত্রে।
এখানে কোটার অবস্থা আরো ভয়াবহ। ডিস্ট্রিক্ট-১০%, মুক্তিযোদ্ধা-৩০%, নারী-১০% এবং আদিবাসী-৫%, মোট ৫৫%। তার মানে গিয়ে দাড়ালো প্রতি ১০০ জনে ৫৫ জনই আসবে মেধার বিচারে হেরে গিয়ে কোটার মাধ্যমে। কি সেলুকাস!
গত কয়েক বছর থেকেই ক্যাম্পাসে দেখছি বি সি এস এর সার্কুলার হওয়ার সাথে সাথে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় আবার একসময় কোন এক অদ্ভুত কারণে তাদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী শিবির আখ্যা দিয়ে হুমকি ধামকি বা পিটুনী দিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়া হয়। যথারীতি বিসিএস শেষ হয়ে যায়, কোটা বিতর্কও থেমে যায়।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে। শুক্রুবারে ক্যাম্পাসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে ’নির্যাতন বিরোধী ছাত্র-ছাত্রী’র (যেটি মূলত বাম-প্রগতিশীল ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোরই এক্সটেনশন) একটা ব্যানার দেখলাম কোটা বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করে বক্তব্য দেওয়া।
গত ১২ তারিখের মানব জমিনের ২য় পৃষ্ঠায় একটা রিপোর্টে দেখলাম, বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপ টাইপ সংগঠন এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের এক নেতাও অপরাজেয় বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে গেছে।
আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই কোটা সিস্টেমের বিপক্ষে।
যদিও কোটা সিস্টেম পূনর্মূল্যায়ন করলেই সব মেধাবীরা বিভিন্ন ভাইটাল পজিশনে গিয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করে তুলবে, তা চিন্তা করা অবান্তর। অনৈতিক অর্থ লেন দেনের মাধ্যমে যে কোটা তৈরী হয়, সেটা কোন্ কতৃপক্ষ কিভাবে বন্ধ করবে? তবুও আমার মনে হয় এখন কোটা সিস্টেম উইথড্র করার সময় এসেছে। সারভাইবল ফর দ্য ফিটেস্ট.. এটাতো শুধুমাত্র তত্ত্ব না।
আসুন আমরা আমাদের কন্ঠ ছাড়ি জোরে।
সংযুক্তি: গত সপ্তাহে হলের এক জুনিয়র’র সাথে দেখা।
তার আগের দিনই কোটা বিরোধী এবং না বিরোধীদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ হয়ে গেছে।
আমি আশিক কে জিজ্ঞাসা করলাম কি অবস্থা?
ভা-আ-ই, আর বইলেন না, কোটার বিপক্ষে যায়ে আমি নিজেই এখন স্বাধীনতা বিরোধী হয়ে গিছি। ...
ল‘ পড়া আশিক আমার হলে ছাত্রলীগের গবেষণা সম্পাদক। তাই কিঞ্চিত ভয়ে আছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।