সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com
তৃপ্তির লিখবা নাকি কথাটার মধ্যে কেমন একটা প্রলোভন কাজ করে। লাল শাড়ি পরা তৃপ্তি সমানে ড্রেসিং টেবিলের একটা কোনায় খুব কৌশলে বসে আছে। আয়নায় মাথার এক ঝাঁক চুলের প্রতিবিম্ব। লিখবা নাকি কথাটার মধ্যে কেমন একটা মায়া থাকে।
সেই মায়াটার কথা ভাবতে ভাবতে হাতের কাপটা টেবিলে রাখি আমি।
লিখতেই তো চাই। বলতে বলতে তৃপ্তির দিকে এগিয়ে যাই।
নট নাউ। তৃপ্তি বসা থেকে হঠাৎ করে উঠে পড়ে।
আমিও কথাটাকে ঘুরিয়ে স্বগোতক্তির মতো বানিয়ে ফেলি। লিখতেই তো চাই। লিখতেই তো চাই রে ভাই। আর কথা বের হয় না মুখ থেকে।
আপাতত তৃপ্তির বর্ণনাটাকুই।
আর মৌলভীবাজার সফর নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারি না। অনেক কিছু ঘটেছিল সেবার, এইটুকু শুধু মনে হয়। কী কী ঘটেছিল আর মনে করতে পারি না। আমার এই রকম হয়। লিখতে গেলে, কখনোই একটা গল্প বা উপন্যাসের পুরোটা ভেবে উঠতে পারি না।
একটা লাইনই হয়তো শুধু মনে থাকে। অথবা শুধু একটা আইডিয়াই। ব্যাস। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর কাহিনীর একটা লাইন হয়তো মনে আসে। তারপর সেটাকেই ফেনিয়ে তুলতে থাকি।
ডিটেইলিং করতে গেলেই অস্থির লাগে। এই যেমন এখন, যে ট্রেনে করে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল গিয়ে নামলাম সে ট্রেনের কথা কিছুতেই মনে পড়ছে না। তৃপ্তি চট করে বলে ফেলতো। আর একটা কাহিনীও তো লাগে। শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেলে তো উপন্যাস হয় না।
কাহিনীটা ভেবে উঠতে অনেক সময় লাগে। নিজের প্রকাশিত বইগুলোর দিকে তাকিয়ে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। গল্পের তিনটা বই দুইটা ছোট উপন্যাস। একটা প্রবন্ধের বই। সাকুল্যে পাঁচ।
বইগুলোর দিকে তাকালে মাঝে মাঝে মনে হয় এগুলো হয়তো অন্য কারো লেখা। আমি হয়তো সত্যিই কোনো বই লিখে উঠিনি। হয়তো সত্যিই কোনো বইয়ের পুরোটা এক সাথে ভেবে ওটার ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি। তৃপ্তির সঙ্গে বিয়ের চার বছর হলো। এক ডায়রি লেখা ছাড়া আর কিছু আমাকে লিখতে দেখেনি সে।
লেখক হিসেবেই আমাকে পছন্দ করেছিল। কিন্তু লেখার টেবিলে লেখক দেখতে কেমন তার সংকটগুলো কেমন সেটা তৃপ্তি এখনও দেখেনি। দেখলে লেখার প্রতি এতটা আগ্রহ ধরে রাখতে পারতো না। হয়তো পারতো। তৃপ্তির চাওয়ার মধ্যে কোনো ঘাটতি নেই।
মনে প্রাণেই সে চায় একটা কিছু লিখতে বসি আমি। তাকে নিজের বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। হাতে নিতে সাহস হয় না। তৃপ্তি এসে পড়লে খুব লজ্জা পেয়ে যাবো। ৩৭ বছরে পাঁচটা বই।
কম কিন্তু লিখিনি। ত্রিশটার ওপরে গল্প। বাংলা সাহিত্যে মনে রাখার মতো গল্প কি একটাও হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তর এখনি আমাকে কেউ দেবে না। হয়তো জীবিত অবস্থায় উত্তরটা জেনেও যেতে পারবো না। তাতে কী? এই একান্ত গোপন ভাবনাটুকু মুহূর্তের মধ্যে অনেক দিন পর ভেবে বসি আমি।
পুরনো দিনগুলোর কথা ফ্লাশব্যাক হয়ে চারদিকে ঘুরতে থাকে। আজকের দিনটা যেন কেমন। ম্যাড়মেড়ে একটা শনিবার। একটুকুতেই ক্লান্ত লাগে। বাইরের হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
বাতাস শীতল। শীতের মধ্যে এতটা ক্লান্তি কিন্তু আসার কথা না। তবু আসে।
তৃপ্তি এসে সামনে দাঁড়ায় হঠাৎ।
কই ছিলা?
মানে কী? কই ছিলা মানে কী? রাতে খেতে হবে না।
তার জন্য রান্না করতে হবে না?
ওর গলা শুনে আবারও লিখবা না, কথাটা মনে পড়ে।
না। আজ থেকেই শুরু করতে হবে। আইডিয়াটা ভাল। আদিবাসী একটা জনগোষ্ঠীর উৎসবে যাচ্ছে কয়েকজন লেখক, কবি, শিল্প।
সঙ্গে স্ত্রী, বান্ধবী। সেখানে গিয়ে একটা তুন উপলদ্ধি হলো তাদের মধ্যে। একটা ফাইল করা দরকার। মনিপুরীদের উৎসব, মৌলভীবাজারের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে তথ্যগুলো ফাইলে সেঁটে রাখতে হবে। আর ডায়রির ওই অংশটা পড়ে ফেলতে হবে।
সেগুলোও ফটোকপি করে, ফাইলে সেঁটে রাখতে হবে। কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে তৃপ্তি আস্তে করে সরে পড়ে। খুব নিঃশব্দে, বিড়ালের মতো। পৃথিবীতে তিন ধরনের নারী আছে। এক ধরনের নারী বিড়াল ভয় পায়।
এক ধরনের নারী বিড়াল ভালোবাসে। তৃতীয় ধরনের নারীরা নিজেরাই বিড়ালের মতো। কে বলেছিল কথাটা? তৃপ্তি চলে যাওয়া দেখে হঠাৎ মনে পড়ে যায়। কয়েকজন মানুষের উইকএন্ড, ছুটি কাটনো, শহরের বাইরে যাওয়া, সেখানে গিয়ে তাদের নতুন কোনো উপলদ্ধি খুব কমন একটা ফেনোমেনা। অরণ্যের দিনরাত্রি।
সুনীলের উপন্যাস, সত্যজিতের সিনেমা। এমনকি গৌতম ঘোষের আবার অরণ্যের কথা মাথায় চলে আসে। মুখের ভেতর একটা তিক্ত ভাব জাগে হঠাৎ। সিগারেট খেলে ভাল হতো। কতদিন সিগারেট খাই না।
শরীরের ফ্যাট বাড়বে বলে হুইস্কিও অকেশনালি খাওয়া হয়। জীবনটা খুব সাজানো গোছানো হয়ে গেছে। মুখের তিতা ভাবটা দূর করার জন্য ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে খাই। শব্দ পেয়ে তৃপ্তি রান্নাঘর থেকে উঁকি দেয়। ওর মুখ দেখে বলে ফেলি, অরণ্যের দিনরাত্রির মতো হয়ে যাবে।
তৃপ্তি রান্না ঘর থেকেই উত্তর দেয়,
মৌলভীবাজারে অরণ্য কই পাইলা?
অরণ্য না থাকলেও আইডিয়াটা খুব কমন লাগে না। কয়েকজন বন্ধুর উইকএন্ড কাটানো। পরস্পরের মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ, তারপর নতুন উপলদ্ধি নিয়ে ফিরে আসা।
তুমি নতুন কিছু ভাবে না কেন? একদম নতুন কিছু।
নতুন কিছু ভাবতে না পারলে আইডিয়াটা দাঁড়াবে না, স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
কিন্তু কী সেই নতুন কিছু? তৃপ্তির কথার আর কোনো উত্তর না দিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ি আমি।
তোমাকে হেল্প করি।
নো নিড। আচ্ছা এক কাজ করো। ফ্রিজ থেকে বাটা মশলার বাটিটা নিয়ে আসো।
এইটুকু কাজ করার পর তৃপ্তি আমাকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
নাউ গো। গেট লস্ট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।