নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। অবতরণিকাঃ
চেতন ও অবচেতন মনের এই ধারনাটি ফ্রয়েড (Freud) আবিস্কার করেননি, তবে জনপ্রিয় করার কাজটি তিনিই করেছেন।
'সচেতন মন' হলো আমরা যেসব বিষয়ে মানসিক ভাবে সচেতন... যেমন, আমাদের দর্শন, স্মৃতি, চিন্তা, ফ্যান্টাসি, অনুভূতি,আমাদের সঞ্চয় এগুলো। সচেতন মন বলতে সোজা কথায় যত টুকু স্মৃতি আমাদের মাথায় টাটকা থাকে। যখন তখন যেই ব্যাপারগুলা আমরা স্মরণ করতে পারি... অনেক সময় নিয়ে ভেবে ভেবে বের করতে হয় না।
ফ্রয়েডের মতে মনের এই (সচেতন) অংশটা হলো ছোট অংশ। মনের বিশাল অংশটা জুড়ে রয়েছে 'অবচেতন মন' টা। এই অংশে থাকে সেই ব্যাপারগুলো যেগুলো আমরা খুব সচেতন ভাবে ভাবি না। মনের এই অবচেতন অংশ টা থেকে অনেক কিছু সৃষ্টি হয়... যেমন আমাদের প্রবৃত্তিগুলো... । আমরা আমাদের ইমোশনাল শক গুলো বা যে সব কষ্ট আমরা সচরাচর মনে করতে চাই না , সেগুলোকে মনের এই অবচেতন অংশে রাখি (বা এগুলো নিজ দায়িত্বে এখানে এসে জমা হয়!) ।
ফ্রয়েডের মতে, অবচেতন মনই মানুষের মটিভেশন এর উৎস। যে কোন কাজের দিকে অবচেতন মনই আমাদের ঠেলে দেয়। তবে অবচেতন মনের কাজ কর্মের ধরন একটু ছদ্মবেশী প্রকৃতির। ফলে আমরা প্রায়ই আমাদের কাজের পেছনের হেতু হিসাবে 'অবচেতন মন' এর ভূমিকা টের পাই না। আমাদের মনে হয়... আমরা পেটের ক্ষুধা বা যৌন তৃষ্ণা নিবারনের জন্য কিংবা বিশেষ কোন কাজের প্রতি সুগভীর আগ্রহ (অবসেশন) থেকে আমরা কাজটি সম্পন্ন করছি।
প্রকৃতপক্ষে এটি হলো 'অবচেতন মন' এর খেলা!
ইড- ইগো- সুপার ইগোঃ
ফ্রয়েডের ধারনা অনুযায়ী, এক গাদা জিনিস ভর্তি একটি পরিবেশ নিয়ে মানুষের মন জগতের সূচনা হয়। সেই জিনিসগুলোর মধ্যে একটা বিশেষ জিনিস হলো... ইন্দ্রিয়পূর্ণ দেহ। এই দেহটির বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো... এটি বেচে থাকতে চায় ও বংশবৃদ্ধি করতে চায়। দেহ সব সময় কোন দিকে যেতে চায় তা নির্ধারিত হয় যে চাহিদাগুলো দ্বারা সেগুলো হলো - ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কষ্ট এড়িয়ে যাওয়া এবং যৌনতা।
এই দেহের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো স্নায়ুতন্ত্র।
মানুষের ঐ চাহিদাগুলোর পূর্ণতা বা অপূর্ণতায় স্নায়ুতন্ত্র সাড়া দেয়।
জন্মের সময় মানুষের স্নায়ু ক্রিয়া অন্য যে কোন পশুর চেয়ে আলাদা কিছু থাকে না...। এর দশা টিকে বলে 'ইড'। ইড দশায় স্নায়ুতন্ত্র দৈহিক চাহিদা গুলোকেই 'মটিভেশনাল ফোরস' (motivational force) এ পরিনত করে। এরপর মটিভেশনাল ফোরস গুলো পরিনত হয় 'প্রবৃত্তি'তে।
ফ্রয়েড এদের আরেক নাম দেন 'ইচ্ছা' (wish)। চাহিদা গুলো এভাবে প্রবৃত্তি বা ইচ্ছায় পরিনত হওয়াটাই প্রাথমিক প্রক্রিয়া।
ইড ধাপটি স্বস্তি অর্জনের মূলনীতিতে চলে। চাহিদা পূরণের মাধ্যমে স্বস্তি অর্জিত হয়। তাই ইড ধাপের মূল লক্ষ্যই হয় চাহিদা পূরণের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া ।
যেমন, একটা পিচ্চি বাচ্চা ক্ষুধা লাগা মাত্র সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। সে 'জানে' না, সে কি চায়... সে শুধু জানে, সে কিছু একটা জরুরি ভিত্তিতে এখনি চায়!
ফ্রয়েডের মতবাদ অনুসারে, এই শিশু একেবারে বিশুদ্ধ ইড। এক কথায় বললে- ইড হলো জীববিদ্যার মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ।
ইড এর পরের ধাপ হলো 'ইগো' (আত্ম)। সেই ছোট্ট শিশুটা যখন একটু বড় হয় তখনই তার মধ্যে 'আমার' বা 'আমি' ধারনাটি জন্ম লাভ করে।
আমরাও প্রায়ই আমাদের আশেপাশের ছোট শিশুগুলোকে এভাবেই কথা বলতে শুনি। সব কিছুতে নিজের কতৃত্ব প্রকাশের চেষ্টা... (আমার আম্মু, আমার বাসা...) । ইড ধাপে মানুষ শুধু বুঝে তার কিছু লাগবে... আর ইগো ধাপে এসে সে কি লাগবে, তা বুঝতে শুরু করে।
ইগো ধাপটি বাস্তবতার নীতিতে চলে। এটি চাহিদা পূরণের জন্য 'সঠিক' বস্তু চায়।
এই ধাপটি চালিত হয় বাস্তবতার নিরিখে... অনেক সময় এটি কোন কাজের 'কারন'টিও প্রকাশ করে।
তাহলে যা দেখা গেল সেটা হলো... ইগোর সংগ্রাম হলো ইড কে সুখি করার জন্য। এটা করতে যেয়ে কিছু বাধা-বিপত্তি পার করতে হয় কখনো কখনো। কখনো আবার এমন কিছু জিনিসের সাথে তার পরিচয় ঘটে যেটা তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। সে এসব বাধা ও সহায়তার একটা রেকর্ড রাখে।
যেমন একটা শিশু তার মনোজগতের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী দুটি জিনিস... বাবা- মা...এর দ্বারা কি কি অভিনন্দন পেয়েছে ও কি কি তিরস্কার পেয়েছে সেটা রেকর্ডে রাখে।
এই রেকর্ডকৃত করনীয় ও বর্জনীয় কাজের থেকেই আত্মপ্রকাশ করে এর পরের ধাপটি... 'সুপার ইগো'। মোটামুটি সাত বছরের আগে সুপার ইগো সম্পন্ন হয় না। কোন কোন মানুষের জন্য সারা জীবনেও হয় না।
সুপার ইগোর দুইটি দিক আছে।
একটা হলো বিবেক (conscience)... যেটা গঠিত হয় জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত শাস্তি, সতর্কবাণী, তিরস্কার হজমের ফলাফলরূপে। দ্বিতীয়টা হলো আদর্শ (ego ideal)... যেটা গঠিত হয় পুরস্কার এবং ইতিবাচক মন্তব্য থেকে। 'বিবেক' এবং 'আদর্শ' মনের সাথে গর্ব, লজ্জা বা অপরাধবোধের মত অনুভুতির মাধ্যমে যোগাযোগ করে।
সময় বাড়ার সাথে সাথে জৈবনিক চাহিদার চেয়ে সামাজিক চাহিদা গুলো আমাদের কাছে গুরুত্ব পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হলো- সমাজ জীবনের নতুন এর 'ইচ্ছা' গুলো প্রায়ই ইড পর্যায়ের ইচ্ছাগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক।
দেখাই যাচ্ছে, ইড বা ইগো পর্যায়ে ফোকাসটা থাকে নিজের উপর... সুপার ইগোতে ফোকাসটা থাকে সমাজের উপর। এবং সমাজ প্রায়ই চায় যাতে তুমি তোমার ইচ্ছা গুলো পূরণ করতে না পারো !!
প্রবৃত্তিঃ
ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণে, মানুষের আচরণ গুলো তার প্রবৃত্তি দ্বারা মোটিভেটেড। প্রথমে তিনি এগুলো কে 'জীবনের প্রবৃত্তি' নাম দেন। এই প্রবৃত্তি গুলো ব্যাক্তি কে জীবিত রাখে... তাকে খাবার ও পানি খুজতে মোটিভেট করার মাধ্যমে; প্রজাতিকে জীবিত রাখে... যৌনতার দিকে মোটিভেট করার মাধ্যমে।
ফ্রয়েড এর মতে, যৌনতা অন্য অনেক চাহিদার মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সতেজ।
সবকিছুর পরও, আমরা সামাজিক জীব, এবং যৌনতাও সমাজের বাইরে নয়। খেয়াল করা দরকার , যৌনতা মানে কেবলই 'যৌন মিলন' বুঝানো হয় না... আরও গুরুত্বপূর্ণ 'কিছু' বুঝানো হয়। এটা একটা শক্তিশালী প্রবৃত্তি... শক্তিশালী মোটিভেশনাল ফোরস ।
পরবর্তীতে ফ্রয়েড মনে করলেন... 'জীবনের প্রবৃত্তি' গুলোই সব নয়। আকাঙ্ক্ষা গুলো সতেজ... আকাঙ্ক্ষা গুলোর পূর্ণতা আমাদের সুখি করে।
তাই এগুলোই বেশি ফোকাস হয়। সব কাজের লক্ষ্য একটাই... শান্তি, সন্তুষ্টি। কিন্তু জীবনের লক্ষ্য আসলে কী?
অনেকেরই ধারনা জীবনের লক্ষ্য বা গন্তব্য হলো 'মৃত্যু'। ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন জীবনের প্রবৃত্তি গুলোর পাশাপাশি ও পরে 'মৃত্যুর প্রবৃত্তি' বলেও কিছু একটা আছে। তার ধরনা ছিল- সকল মানুষেরই অবচেতনে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার একটা ইচ্ছা থাকে।
শুরুতে এটাকে বেশ অদ্ভুত একটা ধারনা মনে হলেও... কিছু ভিত্তি ছিল বলেই ফ্রয়েড এভাবে ভেবেছিলেন।
সবার জীবন এক রকম হয় না... এটা আমরা বুঝি। জীবন কষ্ট... ক্লান্তিময় এক প্রক্রিয়া। বেশিরভাগ মানুষের জীবনেই সুখের চেয়ে কষ্টের পরিমান বেশি থাকে। অনেকে এটা আবার স্বীকার করতে চায় না! 'মৃত্যু' এই সবরকম কষ্ট, ক্লান্তি , হতাশা থেকে মুক্ত হওয়ার একটা উপায়।
সংগ্রাম মুক্তির পন্থা।
ফ্রয়েড 'নির্বাণ' তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেন। 'নির্বাণ' বৌদ্ধদের কনসেপ্ট। এর মানে হলো- স্বর্গ বা স্বর্গীয়। এই অন্য একটা অর্থ হলো 'নেভানো'... (মোমবাতি যেভাবে ফুঁ দিয়ে নেভানো হয়)।
একধরনের অস্তিত্বহীনতা, শুন্যতা, অসাড়তা বুঝানো হয়... যা বৌদ্ধ দর্শনে সকল জীবনের লক্ষ্য।
'মৃত্যুর প্রবৃত্তি' গুলো যে বর্তমান তা কিন্তু প্রতিদিনকার জীবনের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। শান্তির জন্য আমাদের আকুলতা... উত্তেজনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা... মদ ও ঘুমের ওষুধের জন্য মানুষের দুর্নিবার আসক্তি... কাজ ফাকি দেয়া... বই- মুভি তে নিজেদের হারিয়ে ফেলা... বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য আমাদের আকুলতা...। আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার ইচ্ছা পোষণও এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ। এই প্রবৃত্তিরই আরেকটা রূপ হলো নিষ্ঠুরতা, আক্রমন, হত্যা কিংবা ধ্বংস।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .। .।
.। .। .। .।
তত্ত্বের শেষের দিকে মৃত্যু সম্পর্কে বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে বলা হয়েছে।
ধর্ম ভেদে দর্শন টা প্রযোজ্য হবে না। ইসলাম ধর্মে মৃত্যু মানেই অস্তিত্বহীনতা বা শুন্যতা নয়... বরং অসীম জীবনের পথে যাত্রা। তাতেও আমরা তত্ত্বের একটা ব্যাখ্যা দিতে পারি... দুনিয়ার জীবনে ন্যায়বিচার, সম্পদের বণ্টন, প্রশংসা, তিরস্কার, শাস্তি এগুলো কিছুই অনেকাংশে সুষ্ঠু ভাবে হয় না... তখন মুসলিমরা কিন্তু পরকালে সেই সুষ্ঠুতার আশায় থাকে। আর ইহকাল – পরকালের ট্রানজিশন ধাপটাই তো মৃত্যু। অতএব মৃত্যু যে একটা মোটিভেশনাল ফোরস সেটা ঠিক আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।