কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার :
প্রকৃতির উঠোনে কবিতার বরপুত্র
ফকির ইলিয়াস
---------------------------------------------------------------------------------
অকাল প্রয়াত কোনো কবির জন্য এলিজি লেখা বড় কঠিন কাজ| বড় বেদনার কাজ| চলে যাবার পর একজন কবির রচিত পংক্তিমালা যখন আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করে তখন মনে হয়, আহা, এই কবির মুখোমুখি যদি আবার হতে পারতাম| যদি আরেকটিবার তাকে দেখতে পেতাম|
প্রয়াত কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর কবিতা কর্ম হাতে নিয়ে আমার আজ বার বার তেমনটি মনে হচ্ছে| প্রকৃতির উঠোনে কবিতার বরপুত্র ছিলেন কিশওয়ার| আজ মনে হচ্ছে, তিনি তার জীবন, ভবিষ্যত, দর্শন এবং মিলন নিয়ে অনেক কথা আগাম জানতেন| আর জানতেন বলেই তা লিখে নিয়েছিলেন অনেক আগে| আরেক পৃথিবীর নীরব দর্শক হয়ে|
“কবে আর বাসযোগ্য ছিলে-অবনী,
ছিলে লিখেছে পর্ণো, হিজিবীজি এক কাল-কালান্তর,
প্রাণবিহীন অবয়ব দুধে ধোয়া নয়-
স্বর্গের ক্লিশে মিথ ভেঙেছে সময়”
(বাসযোগ্য নয়/‘হৃদি’/জুন ১৯৯৭/শাহ শামীম সম্পাদিত)
কিশওয়ারের কবিতায় প্রেম যে দ্যোতনা ছড়ায়-তার ব্যাপ্তি সবসময়ই অন্তর্মুখী| নিজেকে জানার পাশাপাশি সৃষ্টিকে জানার জন্য কবি ছিলেন উদগ্রীব| তার পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি রীতিমতো ছিল ঈর্ষণীয়| গণমানুষের কবি দিলওয়ারের পুত্র হিসেবে কবিতার ঘনিষ্ঠ আবহে বেড়ে উঠেছিলেন, যদিও, কিন্ত কবিতা নিয়ে পিতা কবির সাথে তার সারগর্ভ বিতর্ক শুনলে আমরা মুগ্ধ না হয়ে পারতাম না| তিনি যে কতো তীক্ষ্ণ সমালোচক ছিলেন তা তার রচনা সমগ্র-১ এর কিছু প্রবন্ধ পাঠ করলে বোঝা যায়| সব কবিই পরম সত্তার আলোয় মিশে আলোকিত হতে পারেন না| আমার সব সময়ই মনে হতো কবিতার রক্ত ও মণিষা নিয়েই জন্মেছেন তিনি|
কবি দিলওয়ার, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় দিলু ভাই-এর সাথে অগ্রজের সম্পর্কসুত্রে কিশওয়ার আমাকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করতেন| আমিও তাকে সেই কৈশোর থেকে জেনেছি পরম শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়| দেখা হলেই আমাদের আলাপ শুরু হতো লেখালেখি দিয়ে| তীর্যক ভাষায় সত্যান্বেষী ছিলেন কিশওয়ার| দেখা হলেই শুরু করতেন এভাবে ‘চাচা, আপনার ঐ লেখাটি পড়লাম|’ ভালো লেগেছে, কিংবা ভালো লাগেনি ,তা বলে দিতেন খুব স্পষ্ট ভাষায়| কোনো রাখঢাক নেই| কোন লুকোচুরি নেই| অকপট সমালোচক ছিলেন তিনি|
দুই.
কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার ছিলেন আপাদমস্তক আধ্যাত্মিক ঘরানার কবি| তার কাব্যগ্রন্ত ‘সংঘর্ষ: আলো-অন্ধকার’ ১৯৮৯ সালে বের হবার পর তুমুল সাড়া জাগিয়েছিলো বাংলা সাহিত্যে| নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে কিশওয়ার উজ্জ্বল আলোয় দাঁড় করিয়েছিলেন পরমকে, মানব সত্তাকে| কবিতায় তার উচ্চারণ যে কতোটা তীক্ষ্ণ ছিল-এর প্রমাণ আমরা প্রতিটি পংক্তিতে পাই|
“মৃত্যুর অবসান হলে সুর্য হবে আরেক পৃথিবী
অপ্রকাশ্য প্রকাশের দু:খ সুখ ক্রোধের নির্মাণ
জীবন স্পন্দন ছাড়া অসম্পুর্ণ লক্ষ বিশ্ব
প্রেমের পুর্ণতায় জীবনের জয়ের প্রমাণ|”
(প্রেমের পুর্ণতায়/সুনৃত, প্রথম সংখ্যা)
স্রষ্টার পুরো নির্মাণশৈলীই ছিল কিশওয়ার-এর কবিতার বিচরণ ক্ষেত্র| তার অন্ত:চক্ষু এতোই দৃষ্টিমান ছিল, তিনি যখন কোন কবিতা লিখতেন, মনে হতো কোন নেপথ্য শক্তি যেন তাকে দিয়ে ঐ পংক্তিগগুলো বলাচ্ছে| কবিতা নিয়ে সাহসী সততা দেখাবার প্রচন্ড শক্তিও ছিল এই কবির| আশির দশকে আমরা যারা কবিতাকে ভালোবেসে মিলন-বিরহকে পুষ্পমাল্য করে পথ খুঁজছিলাম, কিশওয়ার ছিলেন তাদের সবার কাছে অহংকারসম| আমরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম এজন্য| কারণ কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর আবির্ভাব আশির দশকের বাংলা কবিতাকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি নতুন বাঁক নির্মাণেও সাহায্য করেছে| তার কবিতায় আত্মান্বেষণ একজন তরুণতম কবির জন্য পথ প্রদর্শন হয়েই থেকে যাবে অনন্তকাল|
একটি জীবনের পরম আরাধ্য বিষয় হচ্ছে শান্তি| কবি কিশওয়ার সেই শান্তির অমোঘ অন্বেষণে বার বার নিমগ্ন হয়েছেন আত্মদর্শনে|
“পৃথিবীর আয়ুও একদিন ফুরিয়ে যাবে
সৌন্দর্যের পরলোক, ভয়ংকরের পরলোক
জেগে উঠবে দৃশ্য সীমায়|
অনেকে হাঁটবে অতুলন পুষ্প কাননে
অসংখ্য, দাহিত হবে কৃষ্ণ অনলে,
অনিবার্য বিভাজন রেখা দেখা দেবে
দিগন্তে প্রান্তরে|
শুধু মানুষের সীমাবদ্ধ অন্তরে
অনন্ত অসীম শান্তি অপয় হবে|”
(অনন্ত অসীম শান্তি/ভুমিজ, প্রথম সংখ্যা ২০০৫)
কিশওয়ার মানুষের, পরম মানুষের আগমন এবং প্রস্থান দৃশ্যের মাঝেই বার বার খুঁজেছেন সেইসব ভুমিপুত্র-ভুমি কন্যাদেরকে| কোথায় ছিলাম, কিভাবে এলাম, কোথায় যাবো,এমন কিছু জিজ্ঞাসা শাশ্বত সুর্যের মতো উঁকি দিয়েছে তার ছন্দে, তার অনুপ্রাসে|
“তারা কি জানে না প্রতিটি পুরুষ
পৃথিবীর ভুমিপুত্র আর প্রতিটি নারী পৃথিবীর ভুমিকন্যা
যদি জেনে নিতে পারে ধ্যাণে জ্ঞানে এই বোধ
তাহলে সার্থক হবে তমোজয়ী সত্তার প্রতিরোধ|”
(ভুমিপুত্র ভুমিকন্যা/সুনৃত, ২য় সংখ্যা ২০০১)
কি চমৎকার নির্দেশনা! একজন সফল কবিই পারেন এঁকে যেতে এমন ব্যঞ্জনার চিত্রকল্প| তার হাতেই রূপ, জীবন এবং মৃত্যু-বন্দনা হয়ে উঠে গোটা মানবমনের কণ্ঠস্বর|
তিন.
কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কাব্যগ্রন্থ “সুষম দৃষ্টিতে”, “সংঘর্ষ, আলো-অন্ধকার”, “ছায়া শরীরীর গান”, ‘পাখির রাজার কাছে’, ‘চিবোয় প্রকৃতি’, “রচনা সমগ্র”, এবং প্রবন্ধগ্রন্ত ‘প্রবন্ধত্রয়ী’| একজন প্রকৃত কবির খুব বেশি লেখার প্রয়োজন হয় না| তার পরও জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, লিটল ম্যাগাজিন গুলোতে নিয়মিত লিখেছেন তিনি| উৎস প্রকাশন থেকে ২০০৫ এর বইমেলায় তার রচনাসমগ্র’ বের হবার পর বোদ্ধা পাঠকসমাজের ঘনিষ্ঠ আলোচনায় এসেছিলেন এই কবি আবারো|
তার কাব্যগ্রন্থ ‘চিবোয় প্রকৃতি’ বের করেছিল ছোট কাগজ ‘সুনৃত’| সুনৃত সম্পাদক, আমার অনুজপ্রতিম কবি আহমদ সায়েম গ্রন্থটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন এই সুদুর যুক্তরাষ্ট্রে| ঐ গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়ে আমি বার বার আলোড়িত হয়েছিলাম|
“তাপিত আত্মার ঘ্রাণে পরলোক প্রেমের কবিতা
মৃত্যু নেই আজীবনে পৃথিবীতে দু:খের চিতা
যে শিশু জন্মের পরে নিষিদ্ধ পল্লীর কারাগারে
তার পাপ পুণ্যময় অবিশ্রান্ত সত্যের ইথারে|”
(কয়েকটি পংক্তি/চিবোয় প্রকৃতি, ২০০২)
এইতো আমাদের কবি কিশওয়ার! এই তো অহিংসার প্রতীক কবিপুত্র! তাকে যতোবার পড়েছি, ততোবারই রহস্য হয়ে সরল শুশ্রুষা যেন লুকোচুরি খেলেছে বুকের অনুরণনে| সৌর পৃথিবীর ছায়া কাছে এসে করতে চেয়েছে ঘন-আলিঙ্গন| ভালোবাসা হয়েছে শ্রেষ্ঠ বোধ বীক্ষণ|
কবিতা মাঝে মাঝে ভুক নেয়| সুকান্ত, আবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকী, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কিংবা কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের এমন অকাল প্রয়াণ আমাদেরকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যুগে যুগে| কিশওয়ার কি জানতেন তিনি খুব বেশিদিন বাঁচবেন না? কবি পিতার কাঁধে শব হয়ে তিনি বিদায় নেবেন, তা কি জানতেন কিশওয়ার? আমার মনে হয়, কিশওয়ার তার নিয়তি জানতেন| আর জানতেন বলেই মৃত্যুকে নিয়ে তার অন্বেষা ছিল, নিজ মনের পৃষ্ঠায় লিখিত অক্ষর|
“দৃশ্যের অতীত কেন্দ্রে যে অস্তিত্ব লোক
আমার বিশ্বাস সেই ভর করেছে স্পর্শ
এই সত্য বাস্তবতা নয় কোনো আষাঢ়ে বিষয়
পরমেয় পথে গেলে পাবে পরিচয়|
(পৃষ্ঠায় লিখিত অক্ষর/চিবোয় প্রকৃতি/২০০২)
চার.
১৯৯৪ সালটি আমি পুরোটাই বাংলাদেশে কাটাই| সে বছর আমার জীবনে ছিল শ্রেষ্ঠ আড্ডার বছর| সিলেটের আলোচিত ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক অনুপম’ অফিসে ছিল আমাদের নিয়মিত আড্ডা| অনুপমের নির্বাহী সম্পাদক কবি গল্পকার সারওয়ার চৌধুরী (বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমীরাত প্রবাসী) ছিলেন আড্ডার প্রধান সঞ্চালক| সে আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন, কবি শাহ শামীম আহমেদ, মাশুক ইবনে আনিস, শামীম শাহান, মাহবুব লীলেন, জফির সেতু, ফজলুর রহমান বাবুল, নাজমুল হক নাজু, আহমেদুর রশীদ, শাহ তোফায়েল, ফয়জুর রহমান ফয়েজ, অকাল প্রয়াত কবি তুষার সাখাওয়াত, পারভেজ রশীদ মঙ্গল, সৌমিত্র দেব, মোস্তাক আহমাদ দীন, হেলাল আহমেদ, বাইস কাদিরসহ আরো অনেকে| এদের অনেকে এখন প্রবাসী| কেউ কেউ স্বদেশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত| সে সময়ই আহমেদুর রশীদ (তখন আহমাদ রাশীদ নামে লিখতেন) তার সম্পাদিত 'শুদ্ধস্বর’-এর ক্রোড়পত্র করেন কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে নিয়ে| কিশওয়ার প্রায়ই থাকতেন আড্ডার মধ্যমনি|
‘শুদ্ধস্বরে’ আশির দশকের এই শক্তিমান অথচ নিভৃতচারী কবিকে নিয়ে ঋদ্ধ আলোচনা-লেখাগুলো ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল সে সময়ে|
কথাটি আবারো বলি, কিশওয়ারের কবিতা নিয়ে আরো ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে| যে কবি ‘পাখির রাজার কাছে’ নামে নিজ কবিতার বইয়ের নামকরণ করতে পারেন, তিনি যে কতো বড় মহান প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়| আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আগামী দিনের কোনো কবি, কিশওয়ারের কবিতার মর্ম উদ্ধারে আরো ব্রতী হবেন| আরো গভীর উন্মীলনে খুঁজবেন পংক্তির হৃদ্যতা| বুকটি কেঁপে উঠে, সেই সারল্যের হাসিমুখ কিশওয়ারকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো না! হেসে হেসে আর বলবেন না,'' চাচা, আসুন কাকলী রেস্টুরেন্টের কাবাব-পরোটা খাবো|''
পাঁচ.
৮ ডিসেম্বর ২০০৭ ছিল কিশওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দিন চলে যায়।
আমাদের বয়স বাড়ে । কমে আয়ু। কবিতার আয়ু কমে না। লিখিত
হয় বারবার । খুব বেশী মনে হয় , আহা ! জীবনটা যদি কবিতা হতো।
-------------------------------------------------------------------------------
( লেখাটি তাঁর মৃত্যুর পর লিখিত। দৈনিক দেশবাংলা-তে প্রকাশিত।
পরিমার্জন ও সংযোজন- ডিসেম্বর ২০০৭ )
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।