আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাই ত্রাণের স্বচ্ছ সদ্ব্যবহার



চাই ত্রাণের স্বচ্ছ সদ্ব্যবহার ফকির ইলিয়াস --------------------------------------------------- বাংলাদেশে সাম্প্রতিক টর্নেডো ‘সিডর’-এর ঝাপটা প্রবাসী বাঙালিদের মনে দারুণভাবে রেখাপাত করেছে। প্রবাসীরা যেভাবে পারছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন। মানবিক প্রয়োজনে মানুষের সহযোগিতা হৃদয়ের উদারতা বাড়িয়ে দেয়। অন্যের দু:খে আমি দু:খী হতে পারছি­ এমন একটি আত্মতৃপ্তি চিত্তকে বলীয়ান করে। ‘সিডর’ আক্রান্তদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজনে প্রবাসে নানা উদ্যোগ চলছে।

সামনে শীতকাল। তাই এসব সর্বহারা মানুষকে আসন্ন শীতের হিমবাহ থেকে বাঁচাতে প্রচুর পরিমাণ শীতবস্ত্রের দরকার। প্রবাসের বিভিন্ন সংগঠন সে লক্ষ্যেও কাজ করছেন। দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সাহায্য হিসেবে সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ সাহায্য পাওয়ার কথা আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি। সর্বমোট সাহায্যের যে পরিমাণ তার অঙ্ক নেহায়েত কম নয়।

এ রকম বড় অঙ্কের অর্থ সাহায্য দিয়ে দুর্গত জেলাগুলোতে বড় ধরনের ত্রাণকর্ম, পুনর্বাসন ও গৃহনির্মাণ সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের দুটো জাহাজ বাংলাদেশে পৌঁছেছে সাহায্য করার জন্য। এই মানবিক সাহায্যের ঘটনা নিয়ে নানা কথা বলছে বাংলাদেশে একটা মহল। এরা কারা? কারা হিযবুত তাহরীরের নামে মিছিল, মিটিং, বিবৃতি দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে তা দেশবাসীর না জানার কথা নয়। ‘আমেরিকা এলো’, ‘আমেরিকা এলো’ এমন একটি ধুয়া তুলে তারা তাদের মৌলবাদী স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা অতীতেও করেছে।

আজও করছে। এবারের ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হলো ওয়ান-ইলেভেনের পর বিভিন্ন পরিবর্তন সাফল্য সাধিত হলেও এই যে জঙ্গিবাদী ধর্মারা, তাদের তথাকথিত ‘হুঙ্কার’ মোটেই কমেনি। এই মহাদুর্যোগকালেও তারা ওসব জেলার মানুষের পাশে গিয়ে না দাঁড়িয়ে, ঢাকায় মিছিল করার চেষ্টা করছে। তা থেকেই বুঝে নেয়া সহজ, তাদের প্রকৃত মতলব কি। ‘সিডর’-এর থাবার পর দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় ‘বাংলাদেশ’ প্রায় প্রতিদিনই শিরোনাম।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ‘সিডর’-এর তাণ্ডবচিত্র দেখাচ্ছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। সেদিন চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে আমার চোখ গিয়ে থেমে গেল লন্ডন থেকে প্রচারিত বাংলা চ্যানেল ‘চ্যানেল এস’-এ। নিউইয়র্কে সময় তখন রাত সাড়ে ৯টা। লন্ডন স্খানীয় সময় রাত আড়াইটা। পাঁচ ঘন্টা সময়ের ব্যবধান।

দেখলাম চ্যানেল এস-এ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ধরনের কিছু একটা প্রোগ্রাম চলছে। দু’জন মাওলানা সিডর দুর্গতদের জন্য লাইভ ডোনেশন নিচ্ছেন। ডোনেশন হেল্প লাইনে ফোন করে দাতারা সরাসরি ইচ্ছামতো ডোনেশন দিচ্ছেন। প্রায় আধাঘন্টা আমি অনুষ্ঠানটি দেখলাম। পাঁচ পাউন্ড থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত ডোনেশন দিলেন কেউ কেউ।

অনুষ্ঠান উপস্খাপক জনৈক আনসারী বলছেন, যারা দুর্গত মানুষের জন্য ঘর বানিয়ে দিতে চান তারা তাও পারবেন। একটি কাঁচাঘর বানানোর খরচ আনুমানিক সাড়ে তিনশ’ পাউন্ড। দেখলাম, যারা দাতা তাদের সিংহভাগই মহিলা। এটা আমরা সবাই জানি লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের সিংহভাগই সিলেট বিভাগ অঞ্চলের। ওই রাতে ও মধ্যরাত পর্যì জেগে যারা লাইভ ডোনেশন দিচ্ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের।

উপস্খাপক কখনও খাঁটি সিলেটী, কখনও শুদ্ধ বাংলায়, কখনও ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজিতে দান করার জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছিলেন। লক্ষ করেছি, যারা দান করেছেন তারা সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে স্মরণ করেছেন নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কেউ বলেছেন, আমি ‘এত পাউন্ড’ দান করছি। আমার জান্নাতবাসী পিতা-মাতার জন্য দোয়া করবেন। উপস্খাপক বলেছেন, রাত সোয়া তিনটায় লাইফ দোয়া হবে টিভিতে।

শরিক হবেন। মানুষের মন গলানো হচ্ছে এভাবে। পুরো বিষয়টি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে আমার মনে। প্রশ্নগুলোর পজেটিভ-নেগেটিভ দুটো দিকই আছে। আমরা বরাবরই লক্ষ করি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর লাখ লাখ ডলার সাহায্য ওঠে।

ত্রাণ তৎপরতা দেশে-বিদেশে জোরদার হয়। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে আমরা মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে, ত্রাণের ঢেউটিন, গুঁড়োদুধসহ প্রচুর সামগ্রীর সান পেয়েছি। এ রকম ত্রাণ চুরির ঘটনা আমরা আগেও শুনেছি যদিও হাতেনাতে ধরার সংখ্যা এবারই ছিল সবচেয়ে বেশি। আর তা সম্ভব হয়েছে পটপরিবর্তনের কারণেই। দেশে-বিদেশে যারা ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছেন, তারা সবটুকু ত্রাণ, অর্থ, বস্ত্রসামগ্রী আক্রান্ত মানুষের হাতে তুলে দেবেন তো? এ প্রশ্নটি এবারও আসছে সঙ্গত কারণে।

কারণ ঘরপোড়ো প্রাণী তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবেই। আর্তপীড়িত বাঙালি জাতির অবস্খা আজ এর চেয়েও ভীতসন্ত্রস্ত। সৌদি আরব ও ইউরোপ, আমেরিকা থেকে যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য পাওয়ার কথা রয়েছে তা দিয়ে পুনর্বাসনের বৃহৎ অংশ সম্পাদন করা সম্ভব বলে অনেকেই মনে করেন, যদি তা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে কাজে লাগানো যায়। তারপর তো থেকে গেল বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, ইউএনসহ বড় বড় দাতার সাহায্য। এর মাঝে এবার ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংগঠনিক, উদ্যোগেও লাখ লাখ ডলার সংগ্রহের প্রচেষ্টা আমরা লক্ষ করেছি।

সবার উদ্দেশ্য যদি মানবতার সেবাই হয়, তবে তার শতভাগ কাজে লাগালে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র দ্বীপাঞ্চল জেলাগুলোর আংশিক চেহারাই পাল্টে দেয়া সম্ভব। আমরা জানি, প্রবাসের এমনকি দেশের অনেক গৃহবধ, গ্রামীণ জনপদের মানুষ আছেন যারা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে টাকা পাঠানোর ধকল সইতে চান না। অনেকে সে পথও জানেন না। তাই তারা নিকটের কোন সংগ্রহকারী সংস্খা কিংবা ব্যক্তির হাতেই তাদের কষ্টের সঞ্চয়ের কিছু অর্থ তুলে দেন কিংবা দিতে চান। মাননীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা বলেছেন, তারা সব পরিস্খিতি মোকাবেলা করছেন।

সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ বলেছেন, কাউকে না খেয়ে মরতে দেয়া হবে না। কিন্তু তারপরও সাম্প্রতিক যেসব খবর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি, তা আমাদের শঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কেউ কেউ বলছেন, ত্রাণ এখনও সব অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বলা হচ্ছে, সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন সম্ভব সাধন করা যাচ্ছে না এর সঠিক কোন ব্যাখ্যা সরকারের কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না আপাতত।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন যারা সাহায্য করতে বাংলাদেশে গিয়েছেন, তারা একা কোথাও যাবেন না। তাদের সঙ্গে থাকবেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা, যাতে মেরিন সৈন্য নিয়ে কোন ভুলবুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। এ জন্যই এই সরকারি উদ্যোগ। উদ্যোগটি ভাল নি:সন্দেহে। কিন্তু যারা, যেসব মিডিয়া, যেসব রাজনৈতিক মোর্চা, সেসব সংগঠন বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাণ তৎপরতাকে নানা বিশ্লেষণে অভিষিক্ত করে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চাইছে; এদের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী উপকূলে গেলেই এত চেঁচামেচি করতে হবে কেন? জঙ্গিবাদী মোর্চায় যারা বাংলাদেশে শক্তি সঞ্চয় করেছে আমরা এদের কাউকে তো মাঠ পর্যায়ে দেখছি না ত্রাণকাজে। এই ফেরকা বিতরণ করে, এই ধম্রজাল সৃষ্টি করে যারা নানা বুলি আওড়ায় তারা থু থু দিয়ে আমেরিকাকে ভাসিয়ে দেয়ার কথাও বলেছে এই বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূলতা, প্রতিবকতাকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষই রুখে দাঁড়িয়েছেন। ধ্বজাধারী যারা নেপথ্যে মতলব হাসিল করেছে, এদের উদ্দেশ্য কখনই মহৎ ছিল না। প্রয়াত মনীষী, পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধেয় ড. আহমদ শরীফ একবার এক সেমিনারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মধ্যস্বত্বভোগী বুর্জোয়াদের ভাগ্য মাঝে মাঝে খুলে দেয়।

বিভিন্ন উৎস থেকে ত্রাণ এনে তারা নিজেরাই সাবাড় করে। ’ বর্তমানে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় নেই। তাই জাতির প্রত্যাশা অনেক। ঘর্ণিকবলিত এলাকাগুলোর বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্খা নেয়া এখন সময়ের দাবি। দেশে মানুষ বাড়ছে।

ভমি বাড়ছে না। বিশ্বে খরতাপ, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল বারবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বিশ্বের আবহাওয়াবিদরা বলছেন। এই সত্য মেনে নিয়ে সতর্ক হতে হবে। শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ধকল মোকাবেলার সব প্রস্তুতি নিতে হবে সরকারকেই। প্রাপ্ত ত্রাণগুলোর স্বচ্ছ সদ্ব্যবহার এই কাজগুলো ত্বরান্বিত করতে পারে নি:সন্দেহে।

নিউইয়র্ক ২৭ নভেম্বর ২০০৭ ================================== দৈনিক সংবাদ । ঢাকা । ৩০ নভেম্বর ২০০৭ শুক্রবার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।