আমার আমি ....
আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহ থেকে : স্বাধীনতা পরবর্তী ৪০ বছরে ঝিনাইদহের ইতিহাসে চরমপন্থী নেতা, ক্যাডার ও সন্ত্রাসীদের জীবনের শেষ পরিনতি হয় অস্বাভাবিক মৃত্যু, কারো এ পর্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। এদের জীবনের করুণ পরিণতি খেজুরের পাটি বা চাটাইয়ে জড়িয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরা। অনেকেরই দাফন কাফন পর্যন্ত হয় না। প্রতিপরে হাতেই বেশি খুন হয় এরা। এ পর্যন্ত ঝিনাইদহে প্রতিপ ও দলীয় কোন্দলে দেড় সহস্রাধিক চরমপন্থী খুন হয়েছে।
গত কয়েক বছর পুশিল ও র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধেও চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা নিহত হচ্ছে। র্দীঘ ৪০ বছরে চরমপন্থিদলগুলোর শীর্ষ নেতা ক্যাডারদের দিনলিপি পর্যালেচনায় দেখা যায়, অপঘাতে মৃত্যু তাদের সর্বণ পিছু তাড়া করে। শুধু ঝিনাইদহ নয় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গাসহ দণি-পশ্চিমের খুলনা বিভাগের ১০ জেলার সব চরমপন্থিদেরই পরিনতি একই ধরণের।
জানা যায়, বিগত ৪০ বছরে ঝিনাইদহে জেলায় অনেক বাঘা বাঘা চরমপন্থী ক্যাডারের উত্থান ঘটেছে। প্রতিপ চরমপন্থীর হাতে, নিজ দলীয় ক্যাডারদের বিশ্বাসঘাতকতায় ও পুলিশের গুলিতে লাশ হয়ে খেজুরের পাটি, চাটাই বা পলিথিনে পেঁচিয়ে বাড়ি ফিরছে তারা।
স্বাধীনতার আগে থেকেই এই জেলার কালীগঞ্জে রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা শুরু হয়। আর এই হত্যার রাজনীতির প্রথম শিকার হয় কালীগঞ্জের চাঁদ আলী চেয়ারম্যান।
দেশ স্বাধীনের পর ঝিনাইদহে একের পর এক গোপন চরমপন্থী দলের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। চলতে থাকে মানুষ হত্যার প্রতিযোগীতা। ১৯৭২ সালে প্রথম গোপন রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে পূর্ব-পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি (এম, এল) এর দলটি মাওবাদী ও শ্রেণীশত্র“ খতমের আদর্শে বিশ্বাসী ছিল।
ঝিনাইদহ সদর, শৈলকুপা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও হরিণাকুন্ডু উপজেলায় এদের ব্যাপক আধিপত্য ছিল। এরা বিভিন্ন সময়ে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই ও তাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হতো। সরকারী খাদ্যগুদাম লুট করে চাল, গম সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে তাদের পে রাখত, যার ফলে অল্পদিনের মধ্যে তারা ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করতে সম হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত নকশাল নেতা চারু মজুমদারের অনুসারী হওয়ায় এ দলটি ‘নকশাল দল’ নামে এ জেলায় পরিচিতি পায়। এরপর ১৯৭৩ সালে জাসদ তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড সেল গণবাহিনী গঠন করে।
গণবাহিনীর দাপট ছিল মাগুরা, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা উত্তর পাশের হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ সদরের হরিশপুর, পোড়াহাটি ও হলিধানি ইউনিয়নে। ১৯৭৪ সালে গণবাহিনী হরিণাকুন্ডু থানা লুট করে। ৭৫ সালে লুট করে শৈলকুপা উপজেলার লাঁঙ্গলবাধ পুলিশ ফাঁড়ি। এরপর থেকে এরা এসব এলাকায় ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পূর্ব-পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি (এম, এল) নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টি’ রাখে।
এরা সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটাতে থাকে গণবাহিনীর দখলীয় এলাকায়। তখন থেকেই শুরু হয় দলে দলে খুন আর পাল্টা খুনের প্রতিযোগীতা। একদল অন্যদলকে আয়ত্তে পেলেই তাদের নেতা বা ক্যাডারদের হত্যা করতে থাকে। যেন সাপে নেউলে সম্পর্ক। পাশাপাশি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী শত্র“ আখ্যা দিয়ে গ্রামের জোতদার ও পুলিশের সোর্সকে হত্যা করতে থাকে।
১৯৭৫ সাল থেকে ৮১ সালের মধ্যে গণবাহিনী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ৫’শ নেতা বা ক্যাডার খুন হয়। ৮০’র দশকের শুরুতে দুর্বার গতিতে বরিশাল, ফরিদপুর ও মাগুরা হয়ে সর্বহারা পার্টি এগিয়ে আসে ঝিনাইদহের দিকে। শুরু হয়ে যায় গণবাহিনী ও বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে এলাকা দখলের যুদ্ধ। অল্প দিনের মধ্যেই সর্বহারা পার্টি আধিপত্য বিস্তার করে। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও গণবাহিনীর অসংখ্য নেতা ও ক্যাডার খুন হয় এদের হাতে।
১৯৮৭ সালে ঝিনাইদহ সদরের কংশী মাঠে সর্বহারা পার্টির সাথে গণবাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে ৭ গণবাহিনী ক্যাডার নিহত হয় যা ঐ এলাকায় সেভেন মার্ডার হিসাবে পরিচিতি পায়। বরিশাল থেকে আসা দলনেতা রাজিবকে ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করে অস্ত্র ভান্ডার দখল করে নেয় তারই দলীয় ক্যাডাররা। পরে এই দলের উপর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি আঘাত হানে এবং তাদের আধিপত্য খর্ব করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বর্তমানে এ জেলায় সর্বহারা পার্টির কোন অস্তিত্ব নেই।
’৯০এর দশকের শুরুতে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আবির্ভাব ঘটে।
হরিণাকুন্ডুর টিপু দলের মুকুটহীন সম্রাট হয়। এই দলের দাপটে বাঘে-ছাগলে একঘাটে পানি খায়। টিপু সঙ্গী হিসেবে পায় চরমপন্থী ইছাকে। পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ইছা। দলীয় ক্যাডাররা বিশ্বাসঘাতকতা করে টিপু ও তার ৩ সঙ্গীকে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার এক বিলের মাঝে জীবন্ত কবর দেয়।
শেষ হয় টিপু অধ্যায়। দাপট বেড়ে যায় বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির। সম্রাজ্য দখল করে শৈলকুপা’র শহীদুল ইসলাম লাল, যার কথায় ছিল আইন। এ জেলার নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং শেষে ঝিনাইদহে ফেরার পথে বিসিক শিল্প নগরীর পার্শ্বে মাইক্রো থেকে নামিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
শহীদুল ইসলাম লাল হত্যার পরবর্তী ঘটনায় রাব্বুল জাহাঙ্গীরসহ আরো ৭/৮ জনকে হত্যা করা হয়। শেষ হয় শহীদ লাল অধ্যায়।
১৯৯৭ সালের দিকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ তাত্ত্বিক নেতা ঝিনাইদহের মীর ইলিয়াস হোসেন দিলিপের নেতৃত্বে গঠন করা হয় শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, দলের সামরিক শাখার নাম দেওয়া হয় গণমুক্তি ফৌজ। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির বেশির ভাগ নেতা ক্যাডার গণমুক্তিফৌজে যোগ দেয়। তারা আঘাত হানতে থাকে বিপ্লবী ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির উপর।
এই আন্ডার গ্রাউন্ড যুদ্ধে উভয় দলের প্রায় দু’শ নেতাকর্মী খুন হয়। ১৯৯৯ সালের দিকে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাধারণ মার সুযোগে আত্মসমর্পণ শুরু হয়। ঐ সময় গণমুক্তি ফৌজ গণবাহিনীর ক্যাডাররা ভাঙ্গাচুরা অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। অবশ্য এ সময় বিপ্লবী ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি আত্মসমর্পনে সাড়া দেয়নি। গুলিতে নিহত হয় মীর ইলিয়াস হোসেন দিলিপ।
২০০০ সালের দিকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তৎপর হয়ে উঠে এ জেলায়। সম্প্রতি দলটি ভেঙে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল), (এম এল লাল পতাকা), (এম এল জনযুদ্ধ),ও (এম.এল যোদ্ধা) এই ৪ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। সামরিক শক্তি এবং হত্যার দিক থেকে আবদুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপনের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল জনযুদ্ধ) এখন শীর্ষে ছিল। তারা মানুষ খুনের পর পত্রপত্রিকায় ফ্যাক্সের মাধ্যমে দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। এমনকি মারার আগে ঘোষণা দিয়েও মানুষ খুন করা হতো।
দণিপশ্চিমাঞ্চলের ভয়াবহ চরমপন্থি সংগঠন ‘জনযুদ্ধ’ নামের এই দলটির প্রধান ঝিনাইদহের দাদা তপন ওরফে আব্দুর রশিদ মালিথা ও তার ভাই আকাশ গতবছর কুষ্টিয়ায় র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর থেমে গেছে সেই খুনের ভয়াবহতা। অব্যাহত অভিযানে দলটি এখন বিপর্যয়ের মুখে।
একদিল বাহিনী প্রধান একদিল কুষ্টিয়ায় ক্রসফায়ারে নিহত হয়। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা)-এর নেতা কোটচাঁদপুরের টুটুল ডাক্তারও নিহত হয়েছে বন্দুক যুদ্ধে। মেহেরপুরের গাংনী এলাকায় চরমপন্থি নেতা রনি বিশ্বাস গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে।
এ পর্যন্ত দণি পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে চরমপন্থী দলগুলোর প্রায় ৪’শ জন নেতা ক্যাডার ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছে। এছাড়া গত ৯ বছরে খুন হয় বিভিন্ন চরমপন্থীদলের প্রায় ৪শ ক্যাডার ও নেতা। তবে চরমপন্থীদের অস্ত্র ভান্ডারের ভাল ভাল অস্ত্রগুলো এখনো রয়ে গেছে।
গত ৪০ বছরে ঝিনাইদহসহ দনিপশ্চিমাঞ্চলের আন্ডার ওয়ার্ল্ডে রক্তের মাধ্যমে যাদের উত্থান ঘটেছে রক্তের মাধ্যমেই তাদের পতন হতে দেখা গেছে। গোপন দলের হাতে দনিপশ্চিমের জেলাগুলোতে যত লোক খুন হয়েছে তাদের বেশির ভাগই প্রত্য্য বা পরোভাবে চরমপন্থি দলের সাথে জড়িত ছিল।
খুনের পর পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে যে, সে চরমপন্থি দলের সাথে কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত। তবে এদের বিরোধীতা করায় বা পুলিশের সোর্স হিসাবে কাজ করার জন্যও অনেকে খুন হয়।
দীর্ঘদিনের আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতির পর্যবেণে দেখা গেছে যে যত বেশি মানুষ খুনে পারদর্শী তার নাম ডাক তত ছড়িয়ে পড়ে। লোকে আতঙ্কিত হয়। অনেকে দিন মজুর থেকে শীর্ষ ক্যাডারে আসীন হয়।
প্রতাপশালী ক্যাডারও একদিন খুন হয়ে যায়। চরমপন্থি ক্যাডার খুন হলে মানুষ দুঃখ করে না। অনেকের লাশ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন হয়। জানা যায় বর্তমান আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে নীতি আদর্শের কোন বালাই নেই। অস্ত্র যার মতা তার।
খুন আর রক্তের মাধ্যমে যাদের উত্থান-দাপট, রক্তের মাধ্যমেই তাদের জীবনের শেষ পরিনতি ঘটে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।