অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...
বাস্তবে কন্যার বিশেষত পিতা সিনেমা কিনবা রবীন্দ্রনাথের গল্পের মত কন্যা সম্প্রদান কার্যটি দ্রুত সম্পাদনে এতটা উদাসীন হননা। তবে মায়ের ভূমিকাটি অবশ্য গল্প কিনবা বাস্তব দু'ক্ষেত্রেই সমানে সমান। সাক্ষাত দেবী যেন তার ভক্তদের যাবতীয় পঙ্কিলতা থেকে দূরে রাখার প্রতিজ্ঞায় সর্বদাই রুদ্রমূর্তিতে আবির্ভূত হন। অবশ্য দুই ভুবনেই বিবাহ যোগ্য মেয়েরা কম-বেশী একই রকম উতকণ্ঠাময় দিনাতিপাত করে। মেয়ে নামক বিশেষনের আগে কিনবা পরে যখন বাড়ন্ত, পয়মন্ত, যুবতী এই সব বাড়তি বিশেষনের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়, তখনই বুঝতে হবে যার বিয়ে তার হুশ না থাকলেও পাড়া-পড়শীর ঘুম ঠিকই হারাম হয়েছে।
আর অবধারিত ভাবেই জননী কর্তৃক যখন ধিঙ্গি-মেয়ে বিশেষনে ভুষিত হতে হবে তখনই বুঝতে হবে, এই কাঁটা সবার চোখে বড় বেশীই বিঁধছে।
কেউ তো আর মন্দ চায় না; সুতরাং সবাই হঠাতই বিশেষ পুণ্য অর্জনে জন সেবায় আত্মনিবেশ করে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সবার হাতে একটা না একটা মোয়া যেন থাকেই। তাই বিপুল উদ্দীপনায় শুরু হয় তড়িত প্রস্তাবনা - ও বাড়ীর ছেলে, উমুকের ছেলে, এক মাত্র ছেলে, বিদেশ ফেরত, উচ্চ পদস্থ, দাবী-দাওয়া নেই ; পুরো হুলুস্থুল কারবার।
দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু এদিক-সেদিক দিয়ে ঘুরিয়ে নিলে পুরো ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্যই হয়ে ওঠে।
তবে কঠোরভাবে খেয়াল রাখতে হবে উপভোগের এই ব্যাপারটি যাতে সবাই বুঝতে না পারে। কত রকম চিন্তা-ভাবনার মানুষ যে আছে তা এক বিয়ের সাগর পাড়ি দিতে গেলেই ভীষণভাবে বোধগম্য হয়। আজকের আধুনিক যুগে আমাদের এমনিতে যতটা উদার মনে হয় এইসব ক্ষেত্রে কথা বলতে গেলে বুঝা যায় আসলে আমরা হীনমন্য ।
আমার এক ডেন্টিস্ট বান্ধবীর কাছে আসা ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের শর্ত ছিল বিয়ের পর চাকরী করা যাবে না !! লেহ্ বাবা ! পড়তে পড়তে যে বান্ধবী আমার চেয়ার-টেবিল থেকে পরে যায়; বি.সি.এস পরীক্ষা দিয়ে রাত-দিন তজবী জপে, যাতে টিকে যায়, একটা ভাল জায়গায় পোস্টিং হয় - তাকে কিনা উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকের অযাচিত আদেশ ! "স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রী'র বেহেস্ত" - এই ভুলে বোধহয় এখনও হবু স্বামীরা ডুবে আছে। তাই বিয়ের আগেই আপন মর্জির ফরমায়েশ শুরু হয়ে যায়।
বান্ধবী পক্ষের মেজাজ এরকম প্রস্তাবে একটু চড়ে যাওয়ায় পাত্র হঠাতই যেন বিশাল মহানুভবতার পরিচয় দেখায়। বলে, কিছুটা ফেক্সিবিলিটি নাকি দেয়া যেতে পারে; তবে তা বিয়ের পর ভেবে দেখা হবে। আমার তেজী বান্ধবীর পাল্টা জবাব ছিল, "আপনার কাছ থেকে ফেক্সিবিলিটি নিব কিনা সেটাও তো ভেবে দেখার বিষয়..." ।
আমার এক দারুন বাহিরমুখী বান্ধবীর বিয়ে হলো অনেক রক্ষণশীল পরিবারে। ওখানে অনেক ভাল-মন্দ নিয়মের মাঝে একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল, কোন বন্ধু-বান্ধবের সাথে ফোনে কথা বলা যাবে না! স্বামীর অবশ্য এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল না কিন্তু পরিবারের আদেশের বাইরে সে কিছু বলবেও না।
বেচারী বান্ধবী আমার, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত তখন স্বামীকে বলে নিয়ে গভীর রাতে আমাদের ফোন দিত।
এরকমই আরেকটা টাটকা ঘটনা। এক শুভাকাক্ষীকর্তৃক মেয়ের মা একখানা প্রস্তাব পেলেন। আগ্রহী মা প্রাথমিকভাবে দূরালাপনীর সহায়তায় কথা বলেন ছেলের বাবার সাথে। ভদ্রলোক শিক্ষিত; কথানুযায়ী তাঁর ছেলে-মেয়ে এমনকি অন্যান্য ছেলের বউরাও শিক্ষিত।
মেয়ের মা ভাবে এইখানে বোধহয় মেয়ের শিকে ছিঁড়বে। কিন্তু পরক্ষণেই বিপত্তিটা বাঁধে। বিশাল শিক্ষিত, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই ব্যক্তি মেয়েদের চাকরী করার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি তুললেন, বিশেষত যারা প্রাইভেট কোম্পানীগুলোতে আছে। তাঁর মতে ওসব কোম্পানীতে মেয়েদের সাথে কি হয় তা তাঁর ভালই জানা আছে; কিছু মেয়ে মুখ ফুটে বলে, কিছু বলে না। টাকার জন্যই যখন চাকরী তখন সেটা তাঁর অঢেল আছে; তাঁর ছেলেরা ভাল কামায়; মেয়েদের চাকরী করার কোন মানেই নাই।
মেয়ের মা জানেন, মেয়ে এইখানে রাজী হবেনা; তাই আলোচনা ওখানেই থেমে যায়। তবে কন্যাদায়গ্রস্থ মায়ের মন চুপসে যায়- এইরকম শিক্ষিত লোকের মুখে এতটা রক্ষণশীল কথা শুনে নিজেই মেয়ের চাকরী করার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে ওঠেন। মায়ের দূর্বল মনে সেই লোকের চাপিয়ে দেয়া যুক্তিগুলোই অকাট্য হয়ে ওঠে।
এখানে কিছু প্রশ্ন করা যায় ওই লোককে। উনি গর্ব করে বলেছেন উনার মেয়েরা, ছেলের বউরা শিক্ষিত; সেই মেয়েরা যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন সেখানে তারা কতটুকু নিরাপদে ছিল তাকি তিনি জানেন ? সেই লোকের ছেলেরা চাকরী করছেন ভাল ভাল প্রতিষ্ঠানে।
মেয়েরা যদি সব প্রতিষ্ঠানে সর্বদাই হয়রানির শিকার হয়ে থাকে তাহলে তার ছেলেরাও যে এসব হয়রানিরমূলক আচরনের জন্য দায়ী নয় তা বিশ্বাস করি কি করে !!
কিছু কিছু জায়গায় মেয়েদের মাঝে আগে থেকেই ভীষনভাবে পুরোন ভ্রান্তধারণাই বদ্ধমুল করে দেয়া হয়। ছেলের মা যদি জীবিত না থাকে কিনবা কোন বোন না থাকে তাহলে অনেককেই বলতে শোনা যায় এই প্রস্তাবটা ভালই হবে, 'ঝামেলা' নাই । অর্থ্যাত মেয়েটির মনে শাশুড়ী-ননদ-ননাস কে নিয়ে একটা অযাচিত ভয়ের প্রতিচ্ছবি তৈরী করে দেয়া হয়।
এটা-ওটা নানা কারনে যখন মেয়ের কাছ থেকে 'না' শুনে সেটা আবার উদগ্রীব শুভাকাক্ষিদের জানিয়ে দেয়া হয়; তখন শুরু হয় মান-অভিমান-অপমান বোধের পর্ব। জানতে চাওয়া হয়, তা মেয়ে কি চাইছে আসলে ? এই জানতে চাওয়ার অর্থ কিন্তু ভিন্ন; খানিকটা উষ্মা-শ্লেষ যুক্ত।
এরপর তাদের কার্যকলাপে খানিকটা ভাটা পরে; কিন্তু তারা এবার পরিদর্শকের ভূমিকায় তক্কে তক্কে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয়, 'আমার দেয়া প্রস্তাব তো ফিরিয়ে দিলেন..কত ভাল ছেলে ছিল..' । যেন তােদর কথা শুনে চোখ-কান বুঁজে বিয়ের পিঁড়িতে না বসাটা একটা মহাপাপ।
ভালকে কে কিভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝা মুশকিল। অনেক সময়, একটা ঘটনা ঘটার পর আমরা বিজ্ঞ সেজে বলে বসি , কেন জানি আগেই মনে হয়েছিল ওই লোক ভাল হবেনা ।
অথচ এটা অনেকাংশেই ফালতু কথা। একটু পেছনের কথা ভাবলেই দেখা যাবে ঘটনা পূর্ববর্তীতে কথার সুর অনেক পেলব ছিল।
মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে বলে, অমুক ছেলেকে ভাল মনে হচ্ছে, ভেবে দেখা উচিত; এরকম হিতপদেশ শুনে যদি প্রবল জোসের সাথে ঝুলে পড়া হয় এবং দেখা গেল ছেলে আসলেই ভাল, তখন ভবিষ্যতবক্তার একান-ওকান হাসি দেখা যায়। কিন্তু যদি ভীষন বৈপরিত্যতার মুখোমুখি হতে হয় তখন সেই সব ভবিষ্যতবাণী দেনেওয়ালাদের সুর একটু সাবধানী; আরো বেশী জ্ঞানী জ্ঞানী এবং উপদেশের ফুলঝুরি।
আসলে ঘটনা যা মনে হচ্ছে, বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েরা একটা সময় পর নিজের পরিবারের জন্য কম-বেশী বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
বিয়ে করা ফরজ হয়ে দাঁড়ায় যতটা না নিজের জন্য তার চেয়ে বেশী তথাকথিত শুভাকাক্ষিদের খুশি করার জন্য; কিছু লোকের মুখ বন্ধ করার জন্য। আর বিয়ের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় স্বামীর ঘরে একটা জ্যান্ত শো পিস্ হিসেবে পরজীবি জীবন-যাপন।
আমি অবশ্য এত বেশী নৈরাশ্যবাদী নই। আমি জানি এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার পাশাপাশি অনেক চমতকার কিছু উদাহরনও পাওয়া যাবে। কিন্তু একটা চমতকার ঘটনা ঘটার জন্য দৈবযোগ লাগে তাই খানিকটা অপেক্ষা জরুরী।
আশ্চর্য্য ! একটা মেয়ে একবারই বিয়ে করবে; নতুন কতগুলো মানুষের মাঝে যাবে; নতুন এক জনের সাথে অনেক অনুভুতি ভাগাভাগি করে নেবে; বিয়ের সময় শাড়ী-গয়নায় সেজেগুঁজে আয়নায় অবাক হয়ে নিজেকে দেখে নিজেই বলবে, "মেয়ে, আজ তোমার বিয়ে ; আজ তোমার নতুন জীবন; আজ থেকে তুমি যুক্ত হলে আরেক জীবনের সাথে..আচ্ছা, তোমাকে বউ সেজে এত সুন্দর লাগছে ! তুমি এত সুন্দর ছিলে কি বউ হওয়ার আগেও ? ..."
সমস্যা হলো, এভাবে নিজেকে আবিস্কার করার সময়টা পাওয়া যায়না, চাওয়া যায়না, কেউ দিতে চায়না। পাল্টা প্রশ্ন আসে, অনেক তো হলো, আর কত ! সময় নেয়ার মত সময় তো নেই আর তোমার !
ইশশ ! জীবনটা কি ছোট ...সময় কি তাড়াতাড়ি চলে যায় ...(আম্মাআআ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।