"অবশ্যই আমার নামাজ আমার এবাদাত আমার জীবন আমার মৃত্যু সবকিছুই সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহর জন্যে। "
ইরা,
এই কিছুক্ষণ আগে আমি আমার সংসার শুরু করেছি। কেরোসিনের চুলায় চা বানিয়েছি দু'জনের জন্য। আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রান্না। চা তেমন ভালো হয়নি।
ও কোত্থেকে যেন সস্তা ধরনের চায়ের পাতা এনেছে। অনেকক্ষণ জ্বাল দেবার পরেও রং আসেনি। পানসে ধরনের চা খেয়ে সে বলেছে, এতো ভালো চা সে জীবনেও খায়নি। এখন থেকে সে নাকি রোজ রাতে বারান্দায় বসে চা খাবে।
এখনো সে বারান্দায় বসে আছে।
বেচারার বোধ হয় ইচ্ছে হচ্ছে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমোতে যাবে। যেহেতু আমি চিঠি লিখতে বসেছি, সে অপেক্ষা করছে বারান্দায়। একজন আদর্শ স্ত্রীর উচিত এই অবস্থায় চিঠি লেখা বন্ধ করে স্বামীর সঙ্গে ঘুমোতে যাওয়া। আমার মনে হয় আমি কোনোদিনও আদর্শ স্ত্রী হতে পারবো না। কারণ তোকে চিঠি লিখতেই আমার ভালো লাগছে।
অপেক্ষা করুক। অপেক্ষায় আনন্দ আছে।
আমি কেমন আছি তা দিয়ে শুরু করি। ভালো আছি। আমাদের দু'জনের ছোট্ট এক কামরার ঘর।
দুটি মাত্র প্রাণী। ঠিক করেছি কাল ভোর থেকে সংসার গোছাবো। তবে সংসার গোছানোর কিছুই নেই। সবই গোছানো। আমার কাজ হলো এই গোছানো সংসারে নিজের জায়গা করে নেয়া।
সে জায়গা করে নিতে খুব অসুবিধা হয়নি। কোনো মেয়েরই বোধ হয়; হয় না। নোমান সম্পর্কে বলি। স্বামীর নাম ধরে লিখলাম বলে ভ্রু কুচকাচ্ছিস না তো ! মানুষটা ভালোই। ওর মধ্যে সরল সরল ব্যাপার আছে, জটিলতা তেমন নেই।
নেই বলেই ভয়ে ভয়ে আছি। আমরা মানুষের জটিলতা দেখে অভ্যস্ত। সারল্য আমরা ভয় করি। কারো ভেতরে এ ব্যাপারটি দেখতে পেলে থমকে যাই। মানুষটার ভেতর রহস্য তেমন নেই।
সাদাসিধা ধরনের মানুষ। একটু বোধ হয় কৃপণ। প্রতিটি পয়সা হিসেব করে খরচ করে। চা খাবো বলে চিনি এনেছে, ছোট্ট একটা পোটলায়, এতোটুকু চিনি।
পৃথিবীর সব স্বামীই বিয়ের পর পর স্ত্রীদের ওপর তাদের যে অধিকার আছে সে অধিকার ফলাতে চেষ্টা করে।
কেউ কেউ স্থুলভাবে, কেউ কেউ সুক্ষ্মভাবে করে, যেমন ধর, হঠাৎ বললে, এক গ্লাস পানি দাও তো। অথচ হাতের কাছেই হয়তো পানির গ্লাস। এই মানুষটা এখন পর্যন্ত তা করছে না। মনে হয় করবে না। শুরুতে যে করে না, সে পরেও করে না।
মানুষের চরিত্রের সব দোষ-গুণ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ধরা পরে।
অনেক কিছুই তোকে লিখতে ইচ্ছে করছে। যেমন ধর, আজ ওর এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা। সে ভদ্রলোকের নাম শফিক। তিনি ওর অফিসের প্রধান ব্যক্তি।
অফিসটাই তার। মানুষের কি পরিমাণ টাকা যে থাকতে পারে তা তাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। ভদ্রলোক ওর ছোটবেলার বন্ধু। এতে আমার আনন্দিত হওয়া উচিত কিন্তু আনন্দিত হতে পারছি না। আকাশের সঙ্গে পাতালের বন্ধুত্ব হয় না।
হওয়া বোধ হয় ঠিকও নয়। ভদ্রলোকের ব্যবহার চমত্কার, কথা-বার্তা চমত্কার। কিন্তু তবু আমার ভালো লাগলো না। কেন ভালো লাগলো না, তাও বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম অহনা।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম গহণা, পরে শুনি অহনা। নামটা সুন্দর, তাই না? এ ভদ্রমহিলার গায়ের রং কালো। কালো রংয়ের মেয়ে যে এতো রূপবতী হতে পারে কে জানতো ! ইনাদের সম্পর্কে তোকে পরে আরো লিখবো। আপাতত এইটুকু।
তোদের কথা আমি কিছুই জানতে চাচ্ছি না।
জানি তুই নিজ থেকেই সব লিখবি, কিছু্ই বাদ দিবি না। তোকে একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দেয়া দরকার। স্যুটকেস খুলে দেখি, লাইব্রেরী থেকে আনা উপন্যাসটা, 'তিথীর নীল তোয়ালে', তুই স্যুটকেসে দিয়ে দিয়েছিস। তোর চোখ কান এতোটা খোলা তা বুঝতে পারিনি। তোর এতো বুদ্ধি কেন? ভালো থাকিস।
ইতি,
তোর আপা
হুমায়ূন আহমেদের "ইরা" এর আবৃত্তি ডাউনলোড করতে পারবেন এখান থেকেঃ
ইরা - হুমায়ূন আহমেদ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।