আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মা তুমি দীর্ঘজীবি হও! (দ্বিতীয় পর্ব)

এসো বেপরোয়া সময়ের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে নির্বাসনে পাঠাই , এসো কষ্টবারুদে বারুদ ঘষে ভালবাসার আগুন জ্বালাই

তখনও ছেলেটির মোবাইল কিনার সামর্থ্য হয়নি। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বর্ষে পড়ছে। ছা-পোষা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাবা সদ্য রিটায়ার করেছে। কাজেই এখনো সঞ্চিত কিছু টাকা আছে।

ছেলের পড়ার খরচটা অন্ততঃ চালিয়ে নেয়া যাবে। মা-বাবা-দুই বোন থাকে গ্রামের বাড়িতে। ছেলেটি থাকে শহরের এক কোনে ব্যাচেলর মেসের দশ ফুট বাই দশ ফুট একটা ছোট কামড়ায়। থালা-বালিশ-কম্বল; এই তিন সম্বল- ব্যাচেলরদের সম্পর্কে এই ধারণাকে কিঞ্চিত ভুল প্রমানিত করে দিয়ে তার ছোট্ট ঘরে জায়গা নিয়েছে আশির দশকের বিশ ইঞ্চি একটা সাদা-কালো টেলিভিশন। পুরনো এই টিভি অনেকটা জোর করেই নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল স্নেহাসক্ত বাবা-মা।

উদ্দেশ্য পরিবার থেকে দূরে থাকা এ ছেলে অবসরে অন্ততঃ কিছুটা বিনোদন তো পাবে। কিন্তু টিভি দেখার কি আর সময় হ্য়! ভার্সিটিতে ক্লাশ, সেমিনার, লাইব্রেরী তারপর টিউশনি। ঘরে ফিরে বুয়ার কল্যাণী হাতের রান্না কোন রকমে মুখে দিয়ে আবার পড়তে বসা, অ্যাসাইনমেন্ট- একটা না একটা লেগেই আছে। সেদিন ছিল "আন্তর্জাতিক মা দিবস"। লাইব্রেরীতে রাখা পত্রিকার কল্যাণে জানা হয়েছিল আগেই।

মাকে একটা ফোন করা দরকার। কিন্তু কিসের কি? সারাদিনের ব্যস্ততায় সময় যে কখন চলে গেল টেরই পেলনা ছেলেটি। যখন বাসায় ফিরল রাত তখন এগারোটার কিছু বেশি। আজ ভালই ধকল গেছে। কোন রকমে দু'টো মুখে গুঁজে দিয়েই সোজা বিছানায় সটান হবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ছেলটি।

থালায় ভাত বেড়ে নিয়ে কি মনে করে যেন টিভিটা অন করল ছেলেটা। একুশে টিভি (তখন স্যাটেলাইট ছাড়াই সম্প্রচরিত হতো) মা নিয়ে একটা গানের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হঠাত্ একটু থামলেন। তারপর বললেন, "যাঁরা এই মূহুর্তে আমাদের এই অনুষ্ঠানটি দেখছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁদের মা সঙ্গে আছেন প্লিজ আপনারা আপনাদের মাকে বলুন, 'মা, আমি তোমাকে ভালবাসি'। আর যাঁদের মা সঙ্গে নেই তাঁরা এই মূহুর্তে ফোন করে বলুন"।

কি যেন একটা হয়ে গেল ছেলেটার মধ্যে। মাকে তো তার ফোন করার কথা ছিল আগেই। কিন্তু সময়ই করতে পারলনা। ঘড়ির দিকে তাকালো ছেলেটা। এগারোটা বিশ।

রোকনের ফোনের দোকান এখনো খোলা থাকার কথা। অন্ততঃ বন্ধ হয় হয় এমন হবে। অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই একটা ফোন করা পর্যন্ত অন্ততঃ অপেক্ষা করবে। হাতের ভাতের থালা রেখে যেই উঠতে যাবে সাথে সাথেই আবার দমে গেল। বাড়িতে ফোন নেই।

ইলিয়াস মিয়ার দোকানে ফোন করলে সে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হাজির হয় বড়িতে। ইনকামিং কল বাবদ একটা চার্জ নেয়। কিন্তু হায়! ইলিয়াস মিয়ার দোকানও তো বন্ধ হয়ে গেছে একঘন্টা আগে। গ্রামের বাজারের দোকান। কার এত দায় পড়েছে এত রাত অব্দি দোকান খোলা রাখার? বুকের মধ্যে ছ্যাঁত্ করে উঠল এক ঝলক রক্ত।

হৃদপিন্ডের অলিন্দ-নিলয়ে বাজতে লাগলো ড্রামবিট। চোখের কোল ছাপিয়ে নেমে আসতে লাগলো অবিরত অশ্রুধারা; টপটপ করে পড়ছে হাতে ধরা থালার মধ্যে। মধ্যবিত্ত হওয়ায় নিজের প্রতি ঘেন্না হতে লাগলো। ভাতে আর চোখের জলে মাখামাখি থালা হাতে নিয়ে বাইশ বছরের একটি যুবক ভেউ ভেউ করে কেঁদে চলছে। কান্নাকে বাঁধা দেবার কেউ নেই আজ আর।

এই পুঁজিবাদী সময়ে এমন বাঁধভাঙ্গা কান্নার যেন বড় বেশী প্রয়োজন। তারপরের গল্প। ছেলেটি আজ সে অসহ্য সময় পার করে এসেছে। এখন তার পরিবার থাকে শহরে। বড়িতে ল্যান্ডফোন-মোবাইল ফোন সবই আছে।

অথচ হায়! সময়ের প্রয়োজনে ছেলেটি আজ থাকে কয়েক হাজার মাইল দূরে। মায়ের মুখ দেখতে পায়নি একটি পলকের জন্যও গত তিন বছরে। বুকের ভিতর আনচান করে সবসময়। টেকনোলজির কল্যাণে বহুদুর থেকে যখন ভেসে আসে মায়ের কান্নায় ডুবে যাওয়া একটি শব্দ "বাবারে...." তখন কেউ কি জানে মাকে সান্ত্বনা দেওয়ায় ব্যস্ত এ প্রান্তে ছেলেটি কেমন শিশুর মত কেঁদে যাচ্ছে? প্রিয় বন্ধুরা, ছেলেটি ঠিক করেছে আগামী বছরের শুরুর দিকে দেশে যাবে। ততদিন যেন তাঁর মা তেমনি সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকেন, তার জন্য প্রার্থনা করবেন।

পৃথিবীর সব মায়েরাই যেন দীর্ঘজীবি হোন তারজন্যও।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।