মানুষ হিসেবে মানুষ কে যেমন শ্রদ্ধা করি অমানুষ দের কে ততটাই ঘৃনা করি যারা পড়েননি তাদের কে পরার অনুরোধ রইলো ( দয়া করে সম্পূর্ণ লেখা পরবেন )
ছেলেটার নাম রূপক, মিরপুরে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও সময় পেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে, ওর বয়েসি (মানে ওর মনের বয়েসি) বড় ছোট অনেক বন্ধুই এই প্রতিষ্ঠানে পড়ে। সেদিন ছিল শনিবার, দুপুর থেকেই রূপক ছবির হাটে। বন্ধুদের সাথে, আড্ডা হচ্ছিলো, গল্প গান হইচই... মাঝে কথা হচ্ছিলো দেশের সমকালীন অবস্থা নিয়ে, ব্লগার আসিফ থেকে শুরু করে বিশ্বজিৎ, ডাক্তার সাজিয়া আফরিনসহ অনেক ব্যাক্তিই ওদের আলোচনায় উঠে এসেছিল। আড্ডা শেষ করে রূপক টিএসসিতে এক কাপ চা খেয়ে, কার্জনের সামনে অকারনে কিছুক্ষন বসে থাকে, এই একা সময়টুকু ওর নিজস্ব।
রূপক যখন আজিমপুর থেকে বিহঙ্গে উঠে বসলো ততক্ষনে ৭টা বেজে গ্যাছে। তখনো বাসের অনেক সিটই ফাকা, মাঝামাঝি দিকে একটা সিটে বসে পড়ল সে। ইডেন কলেজ, নিউমার্কেট পাড় হতেনাহতেই বাস ভর্তি!! রুপকের পাশে বসলো এক শক্তপোক্ত গম্ভীর বৃদ্ধ। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও হেল্পার মাঝে মধ্যেই দুই একজন করে আরও লোক তুলছে, দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রিদের মধ্যে সবাই পুরুষ, এবং তরুন।
শ্যামলীর “আশা ইউনিভার্সিটির” সামনে থেকে এক মেয়ে এই বাসে উঠলো।
বাসের গেটের কাছে অনেক ভিড় থাকার কারনে হয়তো একটু শান্তিতে দাঁড়াবার আশায় ভিড় ঠেলে বাসের মাঝামাঝি জায়গায় চলে আসলো মেয়েটি। দাঁড়ালো রূপকের সিটের পাশে, ওদের মতই বয়শ হবে, গাঢ় নীল পোশাকের সাথে জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল খয়েরী শাল গায়ে। মার্জিত চেহারা। কেন যেন এই ভিড় উপচানো বাসের সাথে মানাচ্ছিল না তাঁকে। কী ভেবে রূপক উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে বসার অনুরোধ করে বলল “আপু বসেন”।
একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফাঁকা সিটে বসে পড়ল মেয়েটি।
বাস যখন শ্যামলী পার হতে যাচ্ছে সে সময় হঠাত বাসের দরজায় “ধুমধাম” শব্দ। বাসের বাইরে কয়েকজন ছেলে, ভেতরে ঢুকবে বলে লাথি দিচ্ছে দরজায়। ভিতরে আতঙ্কিত যাত্রী। লাথির ধাক্কায় প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেলো দরজা, তাড়াহুড়া করে ভিতরে ঢুকল ৪জন ছেলে।
(এরা ছাত্র, তবে আমি এদের “১” “২” “৩” “৪” এভাবেই পরিচয় দিচ্ছি) রূপকের চেয়ে বয়সে হয়তো ছোটই হবে ওরা, যদিও চেহারার উগ্রতা ওদের বয়স ছাপিয়ে আরও অনেক কিছুই প্রকাশ করছে। বাসে উঠেই কন্টাক্টরের কলার ধরে এক ধাক্কা---
১: দরজা লাগায় রাখসোস্ ক্যা হালার পো, আমগো উঠতে দিবি না!!
২: তুই আবার কতা কইতাসোস্ ক্যা!! লাগা দুইতিন্ডা আগে... তারপরে কতা...
৩: থাক কিসু কইস না। ছাইড়া দে এখন... অয় তো কলেজের সামনে দিয়াই জাইবো। তহন দেহুমনে...
রূপক ভাবছিলো এই যদি হয় ছাত্রের আচরন তাহলে এদের দিয়ে আর কী আশা করা সম্ভব!! এসময় তাদের মধ্যে থেকে একজন রূপক কে ডেকে বলল
৪: ভাই কই নামবেন??
-- দুই নম্বর। প্রশিকা।
৪: ম্যালা দূরে, পিছে দাঁড়ান গিয়া। আমরা এই সামনেই নামমু, একটু আরাম কইরা দাড়াই।
রূপক কয়েকটা সিট পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়... (ততক্ষনে বাস কল্যানপুর এর কাছাকাছি... রাস্তায় বেশ ভালোই জ্যাম) এবার ঐ চারজন উচ্চস্বরে অশালীন সম্বোধন সমেত কোনও এক পার্টির “পোলাপাইন” দের গালাগালি করতে শুরু করলো।
এমন সময় তাদের চোখ পড়লো পাশে বসে থাকা সেই খয়েরী শাল পরা মেয়েটির দিকে।
১: এই গরমের মইদ্দে মাইয়ারা ক্যাম্নে যে একগাদা জামাকাপড় পরে!!! বুজিনা।
৩: যা পরার এই শীতেই পরে। দ্যাহোস না!! গরম আইলে পারলে ল্যাংটা হয়া বাইর হয় এগুলা... (চারজনের হা হা হা করে বাস কাঁপানো রাগ জাগানো অট্টহাসি)
২: এইযে ম্যাডাম কই নামবেন??
৩: জিগাস ক্যা?? জেইহানে নামার নামুক, আমরাও অইহানেই নামমু। তাইলেই তো হইলো।
৪: ক্যান তগো ক্যারা উঠসে???
২: ক্যারা তো মোহাম্মাদপুর থেইকাই উঠসে, ম্যাডামের নোখ দেইখা এখন খালি চুলকাইতেসে। একটু যদি চুলকাইয়া দিতো!!! (আবার সেই একযোগে অশালীন “হা হা হা” হাসি)
রূপক লক্ষ করলো এতক্ষন মেয়েটি শুধু মাথা নিচু করে থাকলেও এখন কাঁপছে, হয়তো অপমান সইতে না পেরে, হয়তো ভয়ে।
বাস ভর্তি মানুষজন সবাই এই চারজনের দিকে তাকাচ্ছে আড়চোখে।
প্রসঙ্গ বদলাবে এই আশায় রূপক ওদের জিজ্ঞেশ করলো
– আপনারা কোথায় পড়েন?
১ ও ৪ একসাথে উত্তর দিলো “বাঙলা কলেজ”
৩: ক্যান ভাই? আপ্নের কী দরকার...!!!
– না এমনিই... কোন ইয়ার?
৩: অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। আপ্নে কই পরেন?
– ও... তোমরা তো আমার চেয়ে ছোট তাহলে... আমি আহসানউল্লাহ ভার্সিটি, ফাইনাল ইয়ার... তোমাদের স্কুল কোনটা ছিল??
২: ভাই আপ্নে বড়ভাইগিরি দেখাইতেসেন ক্যন?
৪: আপ্নের গার্লফ্রেন্ড লাগে নাকি!!
৩: আরে নাহ মনেহয় ভাগ বসাইতে চায় হালায়।
রূপক খেয়াল করল মেয়েটি চমকে উঠে ঘুরে তাকিয়েছে রূপকের দিকে, চোখে পানি আর অভিব্যাক্তিতে ভয়।
– না আমি আসলে বলছিলাম যে আপনাদেরও তো বাসায় মা বোন আছে, নাকি!! (কোনও একজন বলে উঠলো “বউ নাই”) তাঁরাও তো রাস্তায় বের হয়, আপনারা যদি এমন করেন তাহলে তো আপনার পরিবারের সম্মানই কমবে, বাড়বে না।
(ইতোমধ্যে বাস টেকনিক্যালের কাছাকাছি চলে এসেছে, দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের বেশিরভাগই নেমে গিয়েছে। ) রূপকের পাশের সিটে বসে থাকা একজন রূপককে বলল “আপ্নে পাগল হইসেন নাকি ভাই!! এদের সাথে কথা বলার কোনও মানে আছে?? থামেন”
৪: আমগো মা-বৈনরে কেউ কিছু কওার সাহস পায়না।
২: তুই এতো কথা কইতাছোস ক্যা? খাঙ্কির পোলারে ধইরা লাগা তো!! আমগো এলাকায় ঢুইকা বড়ভাইগিরি দেখাইতে আইছে, গ্যান দিতে আইছে!!
১: (রূপকের দিকে তাকিয়ে) ঐ তুই আমগো লগে নামবি, আর তোর কোন বাপ আছে ডাক দে।
বাস টেকনিক্যাল মোড় পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাঙলা কলেজের দিকে। দুইজন রূপকের জ্যাকেটের কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে বাসের দরজার দিকে, বাকি দুইজন তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।
বাসের পিছনের কয়েকজন যাত্রী উঠে দাড়িয়ছে, হয়তো কিছু বলার জন্য, হয়তোবা তামাশা দেখা জন্য।
ওদের একজন কন্টাক্টর কে বলল “ঐ মাদারচোত নামায় দিয়া যা... চোদনার পোলার খিচ কমায়া লই...”
বাস থেকে নামিয়ে প্রথমেই রূপকের ঘাড়ে আঘাত করা হয়, তারপর বুকে...
টানতে টানতে বাঙলা কলেজের মেইন গেটের ভিতরে ঢুকানো হয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কর্তব্যরত (!!!) দারোয়ান ও আনসারের সামনেই রূপককে মাটিতে ফেলে শুরু হয় ক্রমাগত লাথি আর মুখ দিয়ে অনর্গল খিস্তি। প্রায় অন্ধকার হয়ে আশা চোখে রূপক ছুটে আসতে দেখে আরও তিন চার জোড়া পা। কিন্তু কোনও শব্দ শুনতে পায়না। তলপেটে প্রচণ্ড আঘাতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে, তারপর হথাৎ সবকিছু চুপ, গাঢ় অন্ধকার।
(এসময় রূপক কে খুন করা হলেই শুধু আপনারা পত্রিকায় সেই খবর পড়তেন। দুঃখিত, রূপককে ওরা খুন করতে পারেনি)
রূপকের জ্ঞান ফিরে আসে ঐ কলেজের সামনেই, তাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড়। মাথায় পানি ঢালছে রূপকের সহযাত্রী সেই গম্ভীর বৃদ্ধ। ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, তলপেটের প্রচন্ড ব্যাথায় বিকৃত হয়ে আছে চেহারা। আরও দুইজন ধরে আছে আছে রূপক কে।
কেউ একজন একটা গামছা এগিয়ে দিলো---
: ভাই আর পানি দিয়েন না, মুইছা দ্যান...
কণ্ঠে স্নেহ, আঞ্চলিক টান। সম্ভবত কোনও চায়ের দোকানদার বা দিনমজুর। কিছুক্ষন পর।
ফুটওভারব্রিজের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপক। তাকে ঘিরে আর এখন ভীড় নেই,
পাশে দাড়িয়ে আছে ঐ বৃদ্ধ সহ আরও দুইজন।
: আপ্নের বাসা কোথায় ভাই??
- মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে
: রিক্সা ঠিক কইরা দেবো? একা যাইতে পারবেন?
- হ্যা পারবো। (তখনো ওর মাথার ভিতরে দপদপে ব্যাথা)
এসময় বৃদ্ধ বলে উঠলো
: একা যাওয়া লাগবেনা তোমার, আমার ছেলেকে কল করেছি, ও আসলে তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে।
- না না!! আমি একাই যেতে পারবো, এখন আর কোনও সমস্যা হচ্ছেনা, আমি ঠিক আছি।
(বিদায় নিয়ে চলে গেলেন দুই সহযাত্রী, রূপকের সঙ্গে এখন সেই বৃদ্ধ। ওদের সামনে একটা বাইক নিয়ে এক তরুন এসে থামলো)
তরুনঃ কী হয়েছে আব্বা!!!
বৃদ্ধঃ কিছুনা, এই তুমি হোন্ডায় ওঠো।
সুমন আমার চেম্বারে চলো।
তরুনঃ আব্বা আপনি এখন চেম্বারে বসবেন!!?
রূপক চুপচাপ বাইকে উঠে বসে, পেছনে বৃদ্ধ।
মিরপুর-১ এ একটা গোছানো ছোট্ট চেম্বারে নিয়ে রূপককে কিছু ওষুধ লিখে দিলেন বৃদ্ধ। তাঁর অনেকগুলো কথার মধ্যে একটা কথা রূপকের মনে লেগেছিলো
“তোমার বয়সে আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, এখন দেশ তোমাদের হাতে, তোমাদের এখন যুদ্ধ করার বয়স। ”
রাত ১০টা ৩০মিনিটে সুমন সাহেব (বৃদ্ধের ছেলে) রূপক কে বাসায় পৌঁছে দেন।
তিনদিন টানা জ্বরভোগের পুরোটা সময় রূপক অনেক চিন্তা করলো, তারপরও রূপক জানেনা কোন অপরাধের শাস্তি হিসেবে তাকে পিটানো হলো।
ঐ ঘটনায় রূপকের সাহায্যে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের কাউকেই রূপক সেদিন ধন্যবাদ দেয়নি। হয়তো মনের ভুলে, হয়তোবা অন্য কোনও কারনে!
[“রূপক” একটি ছদ্মনাম, এছাড়া সমস্ত স্থান, সময় ও ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য। ]
দুটি প্রশ্নঃ
* ছাত্র পরিচয় দিতে আপনার লজ্জা করেনা? (লজ্জা করা উচিৎ)
* পুরুষ হিসেবে কী আপনি অহঙ্কার করেন? (কিসের অহঙ্কার বলবেন কী!!)
কার্টেসিঃ ফেবু তে লিখেছিলেন আতিক নোমান
ফেবুতে অনেকেই কথা গুলা পড়েছেন , লেখা টা আমার মনে দাগ কেটেছে তাই সামু তে শেয়ার করলাম ।
ফেবু থেকে কোনো লেখা সেটা ভালো খারাপ যাইহোক সামুতে শেয়ার করলে অনেকেই আছেন যাদের গা জ্বলে ।
তাদের কে পোস্টে মন্তব্য থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।