আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলে গেছ দূরে তবু তোমাকেই, খুঁজে ফিরি বারে বারে। বুঝে গেছি আজ তুমিই বাবা, বারে বারে আসো ফিরে।

সুখের দিনে তোমার কথা ভাবি....দুখের সাথে একলা রয়ে যাই....

শৈশব হইতেই জামাকাপড়ের প্রতি আমার অগাধ প্রেম। প্রেমের বাড়বাড়ন্ত- অভাবের কারনে। নিখাদ প্রেম কদাপি সাফল্যের মুখ দর্শন করেনা ইহার উদাহারন ভূড়ি ভূড়ি। আমার বেলায়ও তাহার অন্যথা হইবে ইহা কেমনে আশা করি। ছোটবেলায় নতুন জামাকাপড় বলিতে সেই পূজা।

এক বৎসর অপেক্ষা করিয়া নতুন জামা প্যান্টের দর্শন করিতাম। সাথে মালিকানা লাভ। ঐ সময়ে এই ধরাধামে আমা হইতে সুখী কেউ থাকিত বলিয়া বোধ হয়না। পূজার মাসে পিতৃদেব যেইদিন বলিতেন, চল বাজার যাইব। আমি হাজারো ইম্পর্টেন্ট কর্ম ছাড়িয়া সঙ্গ লইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করিতাম না।

দোকানে গিয়া ভীড়ের মাঝখানে কাহারও ঠ্যাংয়ের তলা দিয়া মাথা গলাইয়া বুঝিতে চেষ্টা করিতাম ঠিক কোন বস্তু আমার মালিকানাধীন হইতে যাইতেছে। পিতৃদেবের স্বভাব অদ্বিতীয়। হাজার কাঁদিয়াও বাজেট বাহিরে কিছু আদায় করিতে পারিব না জানি। অতএব ঘোলে না মিটাইলে স্বাদ, থাকিবে বিস্বাদে- মানিয়া লইয়া গলাধঃকরন করিয়া ফিরিতাম নতুন কাপড়। ইহাই ছিল আমাদিগের পরিবারের রেওয়াজ।

বাকী সকলেও খুব একটা লাভে চলিত বলিলে ভূল হইবে। উপায় নাই। কি পরিমান কষ্ট বুকে লইয়া পিতৃদেব অন্য সকলের প্রতিযোগিতার মাঝে নিজ পরিবারের পূজা সংস্থান করিতেন তাহা এখন বুঝি। মনে হয় সম পরিমান কষ্ট অনুভব করিতে কড়াইতে ফুটন্ত তেলের মাঝে নিজেকে ছাড়িয়া দেই। ইহা আর আলোচনা করিব না।

করিতে গেলে লেখা হইবে না। দুঃখিত। পূজা আসিয়া পৌঁছিবার পূর্বেই আমার জামকাপড় হাজার বার দর্শন হইয়া গিয়াছে। এমনি দেখাইয়াছি ৪০০ বার, পড়িয়া ৬০০। ষষ্টীর রাত।

আমার চক্ষে ঘুম কিছুতেই টানিয়া আনিতে পারিতেছি না। কেন!!!! সকাল কখন হইবে!! আমি নতুন জামা প্যান্ট পড়িয়া মন্ডপ আলোকিত করিব। রাত্রিমাঝে মা লাগাইল গাট্টা। ঘুমাইস না কেন! খালি এইপাশ ঐপাশ নড়িস। কে বুঝাইবে রাত্রিখানি ঘুমছাড়া অতিসত্বর পার হইলে তাই সই।

সকালে উঠিয়াই স্থলপদ্মের গাছে। এলাকায় একটাই তাহাও আমাদের বাড়ি। স্থলপদ্ম লাগিবেই। এই পদ্মের বিনিময়েই আমি পূজা মন্ডপে অপর বালক বালিকাদের চাইতে অধিক সন্মান লাভ করিতাম (ইহা আমার কল্পনা আসলে মা ছিলেন পূজার এ টু জেড)। সকলেই আমাকে ইর্ষা করিত আর আমি ফুলিয়া চোদ্দ হাজার বেলুনের একক সংস্করন হইয়া যাইতাম।

১০ বৎসর বয়সকালেও ফুলপ্যান্ট শুধু হাতাইয়া অনুভব করার সৌভাগ্য হইয়াছে, পড়িতে পারিনাই। আরও একটি আগ্রহের বস্তু ছিল প্যান্টর চেইনখানি। বোতাম লাগানোর ঝামেলা নাই। টানিলেই সড়াৎ করিয়া দরজা বন্ধ। কদাচিৎ পিতৃদেবের অলক্ষ্যে তাহার প্যান্টের মাঝে নিজেকে গলাইয়া দেখিতাম কেমন লাগে।

রশি দিয়া কোমরে বাঁধিতে হইত। বড়ই মনোহর দৃশ্য। এখন এইবেলায় আসিয়া বুঝিতে পারি, পিতৃদেব তাহা জানিতেন। হ্য়তো নিভৃতে তাহার প্রান কাঁদিত। তিনি একদিন বলিলেন, তোর জন্য ফুলপ্যান্ট তৈয়ারী করিতে দিয়াছি।

আমার সেই রাতে নিদ্রা আসিল না। পরদিনই পাড়ার এইমাথা হইতে ঐমাথার সকলে জানিয়া গেল আমার ফুলপ্যান্ট আসিতেছে। যেই সকল বন্ধু বহু পুর্বেই সেই সুখ পাইয়াছে তাহাদের মুখ দেখিয়া মনে হইল ইর্ষা করিতেছে। পিতৃদেবকে একবার খালি ভয়ে ভয়ে বলিলাম, বাবা, দরজীকে চেইন লাগাইতে বলিয়াছো? ফুলপ্যান্ট আর আসে না। প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করিতে করিতে আর করিনা।

মনে ভাবি, জিজ্ঞাসা করি বলিয়াই হয়তো পিতৃদেব তাহা আনেন না। দরজীতো দিতেই চায়। এক বিকালে তিনি ফিরিয়াই ডাকিলেন। খেলার মাঠে থাকিয়াই আমার মন বুঝিয়া গেল কারনখানি কি। পাইলাম পিতৃদেব তাহার একখানি পুরাতন প্যান্ট কাটাইয়া উহা তৈয়ার করিয়াছেন।

তাহাতে কি, হাতে পাইয়াই দরজায় হাত দিয়া বোতামের অস্তিত্ত অনুভব করিলাম। পাছে পরিবর্তন করিতে গিয়া আরও একমাস লাগে তাই কিছু বলিলাম না। একটু বড় হইলাম মানে হাইস্কুলে উত্তরণ হইল। আমাদিগের সিস্টেমের বিন্দু মাত্র পরিবর্তন নাই। সেই পূজা সেই জামাকাপড়।

বদলাইলো খালি সাইজ। পূর্বে রেডিমেড আসিত এখন ইচ্ছামত। তবে তাহার সহিত নতুন বিষয় যুক্ত হইল। পূজায় নতুন পাইব কিন্তু জামা সাদা প্যান্ট কালো। কারণ! আমাদিগের স্কুলড্রেস ঐ রঙ ফলো করিয়া থাকে।

প্রথম দুই বছর মানিয়া লইলাম কেন না এই সূত্রেই জামাকাপড়ের প্রমোশন হইয়াছে। হাফ হইতে ফুলপ্যান্ট। হাঁপাইয়া গেলাম তিন বছরেই। কাহাতক আর সাদা কালো সহ্য করা যায়। ঠাকুরদাদা গত হইলেন।

শ্রাদ্ধ করিতে সকলের নতুন বস্ত্র পরিধান করিতে হইবে। পুরোহিতের ঘোষনা। অতএব শ্রাদ্ধের আগের দিন সকলের জন্যে বস্ত্র আনিতে পাঠানো হইল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে। তাহাকে বারে বারে বুঝাইয়া দিলাম কালো প্যান্ট সাদা জামা কোন মতেই আনিবি না। আনিবি না আনিবি না আনিবি না।

তাহার মাথায় বসিয়া গেল কালো প্যান্ট সাদা জামা। পরের দিন প্যাকেট খুলিয়া তাহাই পাইলাম। কালো প্যান্ট সাদা জামা। আমার ক্রন্দন ঠাকুর দাদার মৃত্যুকালে পিতামাতার ক্রন্দনকেও ছাড়াইয়া গেল। আমার হাতে টাকা পয়সার স্বতস্ফুর্ত আগমন ঘটে নাই।

দাদার ঘটিয়াছে কারণ দিন দূপুরে পিতার পকেটে ডাকা ডালিতে তাহার কোনরূপ মনোপরিবর্তন ঘটিত না। ডাকাতির মাল দিয়া কেনা তাহার লুকায়িত বস্ত্রসকল আমার ইর্ষার কারন বনিত। কিছুই বলিবার উপায় ছিলনা। বলিলেই যেই সকল পদার্থ ভ্রাতৃহস্তে আমার পিঠে পড়ে, তাহা অপেক্ষা আমার মৌনব্রত পালন অধিক সুখকর বোধ হইত। কিন্তু লোভ সামলাইতে পারিতাম না।

কখনও কখনও তাহার কষ্টার্জিত বস্ত্র পড়িয়া উত্তমরূপে গাত্র মালিশ উপভোগ করিতাম। দিন পাল্টাইয়াছে। বস্ত্র কিনিতে শুরু করিয়াছি নিজেই। সেই সকল অদ্যাবধি কোন অজ্ঞাতকারনে ভ্রাতার প্রিয় বলিয়া গন্য হয়, ফলাফলে আমার সামান্যই জোটে। কেন জানিনা আমার ভালই লাগে।

আমার পছন্দের সব অন্য কারোর পছন্দ হইয়া যায়। ইহাতে আমি বড়ই গর্বান্বিত বোধ করি। বাড়ির সকলের বস্ত্রও বেশীরভাগ আমাকেই পছন্দ করিয়া দিতে হয় অথবা কিনিতে হয়। বস্ত্র কিনি, ৬-৭ মাসের মাথায় ভুলিয়া যাই। কোনদিন পথে দেখিয়া অবাক হই ঠেলাওয়ালা আমার বস্ত্রসম "পিটার ইংল্যান্ড" এর শার্ট পড়িয়া ঘর্মাক্ত কলেবরে ঠেলা ঠেলিতেছে।

মনে পড়িয়া যায় আমার সম্পত্তির কথা। খোঁজ করিতে গিয়া জানিতে পারি মাতৃদেবী তাহা দান করিয়া দিয়াছেন। বর্তমানে আমার বস্ত্রাভাব নাই। তবুও কেন জানি আমার এক অজ্ঞাত ক্ষুধা অনুভুত হইয়া থাকে মনে মনে। কেহ আমাকে উপহার হিসাবে বস্ত্র দান করিলে আমার মনে অতিশয় আহ্লাদ উপস্থিত হয়।

তাহা যেইমূল্যেরই হোক না কেন। তনু আমাকে জন্মদিনে টি-শার্ট দিয়াছিল। যেইকারনেই হউক তাহা কিনিবার সময় আমার বপুখানি স্মরণে রাখে নাই। সেই টি-শার্টে দুইজন আমি ঢুকিতে পারি। পায়জামা কাহিনী আগেই বলিয়াছি।

কিন্তু সকলই রাখিয়াছি সযতনে। এইসকল আমার বস্ত্রক্ষুধা কি পরিমানে নিবৃত্ত করে বর্ননা করিতে পারিব না। আজিকে আরেকখানি পাইলাম। পূজা উপলক্ষে। "অনুমান"এর স্ত্রী মানে আমার কাকিমা দিয়াছেন বাড়িতে ডাকিয়া।

কেন জানি বাবার কথা মনে পড়িয়া গেল। অনুমানের পরিবারের সহিত পরিচয় বেশীদিনের নয়। তথাপি এই গৃহছাড়া ছেলেটিকে ইহা দ্বারা তাহারা যেই ভালবাসা দিলেন তাহার মূল্য কিভাবে চুকাইব আমার জানা নাই। শুধু এইটুকু বলিতে পারি ইহা লাভ করিবার সাথে সাথে আমার অন্তর জলাসিক্ত হইয়াছিল। কারণ চক্ষে আমার জল আসেনা অনেক দিন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।