আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদম এখনো আদমকেই সিজদা করে

যে ঘড়ি তৈয়ার করে - সে - লুকায় ঘড়ির ভিতরে

১. সৃষ্টির শুরুতে কুরআনের বর্ণনা অনুসারে আদমের দেহে স্রষ্টার নিজস্ব রুহ ফুঁকে দিয়ে (কুরআন ৩২:৯) আদকে প্রাণ দান করে স্রষ্টা প্রথমে আদমকে সব কিছুর নাম শেখান (কুরআন ২:৩১)। এই 'সবকিছুর নাম' শিখানোর সিম্বলিক অর্থ বিশ্বজগতের যাবতীয় জ্ঞান আদম ও আদমের অনাগত বংশধরের ইন্টেলেক্ট বা বুদ্ধিবৃততির করায়ত্ব করা, অর্থাৎ সৃষ্টির সব ধরনের জ্ঞানকে মানবজাতি করায়ত্ত করতে পারবে তার বীজ বপন। এই ইন্টেলেকচুয়াল সুপেরিয়রিটি এবং ফ্রি উইল বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা আদমকে উপহার দেওয়ার বদৌলতে সৃষ্টির অন্য যে কারো থেকে আদমের (এবং সার্বিকভাবে মানবজাতির) সন্মান সবচেয়ে বেশি। ইন্টেলেকচুয়াল সুপেরিয়রিটির দিক থেকে মানুষ তাই সৃষ্টির সেরা জীব উপাধিত। ফলে ফেরেশতাকে (যাদের ভিতরে ফ্রি উইল বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা নেই) নির্দেশ দেওয়া হয় আদমের শ্রেষ্ঠত্ব একনলেজ করা।

এই শ্রেষ্ঠত্ব একনলেজ করা বা স্বীকার করে নেওয়ার সিম্বলিক বহি:প্রকাশ ছিলো সিজদা করা (কুরআন ২:৩৪)। স্রষ্টার নির্দেশ মেনে অত:পর ফেরেশতারা সবাই আদমকে সিজদা করলো ইবলিশ ব্যাতীত। সিজদা পর্বের নাটকীয়তার সেই শুরু। ২. সিজদা মানে কি কেবল দৈহিক মাথা নত করা? উহু। কুরআন শরীফে সিজদা কেবল বিশেষ দৈহিক অবস্থা যেমন মাথা নত করার কনটেক্সটেই আসেনি।

এসেছে আরো কয়েকভাবে। যেমন বলা হয়েছে স্রষ্টাকে মহাবিশ্বের ও প্রকৃতির সবকিছু সেজদা করে (কুরআন ১৩:১৫, ২২:১৮। স্রষ্টাকে সিজদা করে যা কিছু আছে আসমান ও জমীনের ভিতরে। আর আসমান জমীনের সবকিছুর মাথা নেই মানুষের মতো যা মাটিতে স্পর্শ করে সেজদা করতে পারে)। এখানে সেজদার গ্লোবাল যে অর্থ তা হলো স্রষ্টার নিয়মের আনুগত্য করা।

অনু বা পরমানু যে ফিজিক্যাল 'ল বা নিয়মের অনুসরন করে তা স্রষ্টার নির্দেশ বা নিয়মের প্রতিনিধি। গ্যালাক্সি থেকে শুরু করে পরমানুর ভিতরে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন সুনির্দিষ্ট ও পূর্ব নির্ধারিত নিয়মের ব্যতিক্রম করে না। এবং এই স্রষ্টা পূর্ব নির্ধারিত প্রকৃতির ফিজিক্যাল 'ল এর আনুগত্যই স্রষ্টাকে সিজদা করা বা স্রষ্টার নিয়মের প্রতি সমর্পন। ৩. সামাজিক রীতি পূর্ব নবীদের আইনে (শরীয়ায়) মানুষ মানুষকে সিজদা করা অনুমোদিত ছিলো অনেকে হয়তো ওয়াকিবহাল নয় যে কুরাআনের সুরা ইউসুফে ইউসুফ নবীকে (বাইবেলে যার নাম জোসেফ) তার পিতামাতা উভয়ে সিজদা করেছিলো যা উল্লেখ আছে। শুধু সেজদা করাই নয়, ইউসুফ অল্প বয়সে যে স্বপ্ন দেখেছিলো তার ভিতরেও (১২:৪) সিজদা করার সিম্বলিক অর্থ ছিলো যা পরবর্তীতে সত্যে পরিণত হয় এবং ইউসুফ নবী মিশরের বড় প্রশাসনিক পদ পাওয়ার পরে তার পিতা মাতা তার কাছে এসে তাকে সিজদা করে (কুরআন ১২:১০০)।

মানুষকে সিজদা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সালাম) এর সময়ে এসে শরীয়তে বা ধর্মীয় বিধানে নিষিদ্ধ হলেও আগের নবীদের সময়ে তা অনুমোদিত ছিলো। বিশ্বের অন্যান্য সামাজিক রীতিতে বয়:জেষ্ঠদের সন্মান প্রদর্শনের জন্য সিজদা করা প্রাচীন যুগে যেমন প্রচলিত ছিলো, তেমনি এখনো প্রচলিত। যেমন জাপানে সম্রাটকে, বয়স্কদের শিন্টো ধর্মে এখনো সিজদা করা হয় সন্মান প্রদর্শনের রীতি হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মীয় গুরুকে সিজদা করা প্রচলিত। আদিবাসী অনেক সমাজে শীর্ষ সন্মানের রীতি হিসেবে সিজদা করা প্রচলিত।

হযরত মুহাম্মদ (সালাম) নিজেও বলেছিলেন, (জাহিরি শরীয়তে) মানুষকে সিজদা যদি নিষিদ্ধ করা না হতো তা হলে সন্তান পিতা মাতাকে, স্ত্রীর স্বামীকে সিজদা করার (সন্মান অর্থে, উপাসনা নয়) নির্দেশ দেওয়া হতো। ৪. যদি বলি আদম এখনো আদমকে (অথবা আরো পরিস্কার করে বললে আদমের অন্তরের রুহকে) সিজদা করে! কাবা শরীফে যাদের স্বশরীরে দেখার সুযোগ হয়েছে বা যাদের অন্তত কাবা শরীফের ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে তাদের একটু কাবার দৃশ্য কল্পনা করতে হবে। যদি আপনার স্মৃতি ঠিকঠাক মতো কাজ করে তাহলে হয়তো মনে করতে পারবেন যে কাবার সবদিকে, ৩৬০ ডিগ্রী ঘিরে মানুষ সিজদা করে থাকে। কাবা কি? একটা চৌকো ঘর। কাবা শব্দের আরিক অর্থ কিউব।

এখন কল্পনা করুন ৩৬০ ডিগ্রি ঘিরে সিজদা রত মানুষেরা সবাই সিজদা করছে একটা কেন্দ্রবিন্দুকে, সেই কেন্দ্রে হলো কাবা। এখন সেই কল্পনার ছবি থেকে কাবাকে তুলে নেওয়া যাক। কাবাকে কাবার জায়গা থেকে তুলে নিলে দৃশ্যে যা বাকি থাকে তা হলো প্রত্যেক আদম সন্তানেরা অন্য আদম সন্তানকে সিজদা করছে। ৩৬০ ডিগ্রী ঘিরে চলছে আদমের আদমকে সিজদা করা। শুনতে যতখানি ব্লাসফেমাস বা হেরেটিকই মনে হউক না কেন, ইসলামিক ইসোটেরিক বা বাতেনী কনটেক্সটে সিজদার সিম্বলজি সেই পথেই হাটে।

যে তার নফসকে চিনেছে, সে খোদাকে চিনেছে - নবী মুহাম্মদ (সালাম)। মারেফাত বা নসিস (নলেজ অফ গড) এর ভাষায় স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে ডিগ্রি অফ সেপারেশন অসম্ভব সুক্ষ। সেই সুক্ষতার হিন্টস কুরআনেও আছে যেখানে বলা হয়েছে স্রষ্টা তোমাদের গ্রীবাস্থ ধমনীর চাইতেও নিকটস্থ (৫০:১৬)। যেদিকে তাকাবে সেইদিকে খোদার বাতেনী সুরত দেখতে পাবে (২:১১৫)। কাবাকে ঘিরে আদমের আদমকে সিজদা করা প্রসঙ্গে শামসে তাবরীজের (রুমির শিক্ষক) একটা চমৎকার কবিতা আছে যা কাবার সিম্বলজি ধারন করা ছাড়াও সিজদার ইসোটেরিক ডাইমেনশন প্রসঙ্গে কথা বলে।

আবারো মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে: মানুষের দেহে যে রুহ তা খোদার ফুঁকে দেওয়া রুহ। কাবা ইজ ইন দি মিডল অফ দি ওয়ার্ল্ড অল ফেইসেস টার্ন টুয়ার্ডস ইট। টেইক ইট এ্যাওয়ে। সি! ইচ ইজ ওরশিপিং দি সউল অফ ইচ। কাবা পৃথিবীর মাঝখানে সব মুখ কাবার পানে উঠিয়ে নাও কাবা।

এইবার দেখো! প্রত্যেকে রুহ অপর রুহের ইবাদতে রত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।