কঠিন বাস্তবতা মলিন সরলতার সঙ্গেই বসবাস সবসময়
বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি, মাঝে মধ্যেই কানে আসছে বুকে কাপন ধরানো বজ্রপাতের তর্জন-গর্জন। সামনে অবস্থিত উন্মুক্ত বিশাল মাঠের সবুজ ঘাস সিক্ত হচ্ছে বর্ষার অবিরত জলধারায়। তবে সেদিকে তাকালে শুধু ঘাসগুলোই দেখা যায়, বৃষ্টির কারণে মাঠের শেষ সীমানার কি পরিস্থিতি তা আর চোখে পড়ে না। না হলে হয়তো মাঠের সার্বিক অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব ছিল। তারপরও সব মিলিয়ে খুব রোমান্টিক এক পরিবেশ।
সারাদিনের কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরে এ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করার এটুকু সময় বা সুযোগ কোনোটাই তো আমাদের হয় না বা বলা যায়, আমরা করে নিতে পারি না। বিপরীতে বিশাল বিশাল গগনচুম্বী ইমারত এবং ইট-কাঠ-কংক্রিটের দেয়াল অতিক্রম করে এমন সুন্দর মোহনীয় দৃশ্য চাইলেই দেখতে পাওয়া খুব সহজ নয়। পুরো ব্যাপারটি আরো স্বপ্নময় হয়ে যায় যখন মাঠে প্রবেশের দরজার ফাক দিয়ে মাঝে মধ্যেই দমকা হাওয়ার কারণে গায়ে এসে পড়ে বৃষ্টির হাল্কা ছাট। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার বৃষ্টিতে ভেজার দিনগুলোর কথা।
কৌতূহলী পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, উন্মুক্ত মাঠ তো আর কোনো বদ্ধ ঘর নয় যে, এখানে প্রবেশ করার জন্য দরজা থাকবে।
সেই দরজার ফাক দিয়ে আবার সুযোগ পেলেই বৃষ্টির পানি চলে আসবে। কিন্তু এখানে দরজাও আছে, আছে বৃষ্টিস্নাত মাঠের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য বসার উপযুক্ত স্থান। আর আছে বলেই এটা অন্য দশটা পাড়ার মাঠ থেকে একেবারে আলাদা। একেবারেই ভিন্ন এর ভৌগোলিক অবস্থান।
বর্ণনাকৃত দৃশ্যটি কিন্তু কোনো অলীক কল্পনা নয়।
নয় শুধু স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশিত একরাশ হতাশা। কোনো এক মেঘলা দুপুরে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে গেলে এমন মন মাতানো দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক এক প্রাপ্তি হতে পারে। টোয়েন্টি২০ ক্রিকেটের উন্মাদনায় পুরো দেশ যখন নতুন উত্তাপে উন্মত্ত, সাউথ আফ্রিকায় আশরাফুলরা যখন ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের প্রমাণ করার জন্য ঠিক সে সময় আমাদের হোম অফ ক্রিকেট যেন ভুগেছে করুণ নিসঙ্গতায়।
এখানে তখনো নিয়মিত বিভিন্ন পর্যায়ের খেলোয়াড়দের আনাগোনা হয়েছে, দীর্ঘক্ষণব্যাপী তাদের মধ্যে আড্ডাও চলেছে। যারা সেই মুহূর্তে জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন তাদের অনুশীলন, ফিজিকাল ফিটনেস, ট্রেইনিং সবই বেশ জোরেশোরে পরিচালিত হয়েছে।
কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই কি যেন নেই, কি যেন নেই এমন একটা শূন্যতা ছিল। আসলে ছিলই না তো, যে সময়ের কথা বলছি একাডেমি দল অস্ট্রেলিয়া থেকে তখনো দেশে আসেনি, কোনো ছোট-খাট টুর্নামেন্টও চলছিল না। খেলার মাঠে খেলা না হলে তা আর জমজমাট হবে কিভাবে?
খানিক অপেক্ষা করতেই সেদিন দেখা হয়ে গেল জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। সকালের ফিটনেস ট্রেইনিংয়ে অংশ নিতে এখানে এসেছিলেন। দুপুরের আগেই চলে যেতেন কিন্তু বৃষ্টির কারণে বাসায় ফিরতে কিছুটা দেরি হচ্ছে।
তখনো টোয়েন্টি২০ শুরু হয়নি, দল ভালো করবে বলেই আশা প্রকাশ করলেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে পরপর দুই ম্যাচ হেরে বিদায় নেয়ায় পুরোটা না পারলেও আশার কিছু প্রতিদান তো বাশারসহ আমরা পেয়েছি। সামনে জাতীয় লিগ শুরু হবে, তার প্রস্তুতি কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বললেন নানা ধরনের প্র্যাকটিসের কথা। নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে অনেক বেশি পরিশ্রম করছেন। এরই সঙ্গে বিসিবির দেয়া ট্রেইনিং চার্টটা যোগ হওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছে।
এটা শুধু তার জন্য নয়, বাকি সবার জন্যই খুব উপকারী বলে জানালেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ী অধিনায়ক। প্রসঙ্গ পাল্টে কিছুদিন আগের ছিনতাইয়ের ঘটনার কথা জানতে চাইলে চোখে-মুখে বেশ ভীতিকর অনুভূতি ফুটে উঠলো তার, এর আগে এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি কিন্তু কেউ নিজে ওই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার না হলে ভীতির মাত্রা সম্পর্কে ধারণা করা যায় না। তবে নতুন কোনো গল্পের বই পড়ছেন কি না এ প্রশ্ন শুনে আবার হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠলেন হাবিবুল। আমি আসলে কোনো বাছ-বিচার করি না ছোটদের বই, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, রহস্যগল্প কোনো কিছুই বাদ দিই না, হাতের কাছে যা পাই সবই পড়ি। রিসেন্টলি মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি বই পড়েছি।
এর ফাকে বই সংক্রান্ত একটা সমস্যার কথাও জানালেন। ইদানীং বাজারে নকল বইয়ের ছড়াছড়ি। বই কেনার আগে মলাটে নতুন নাম দেখে হয়তো কিনলাম। পরে দেখা যায় ওটা আসলে পুরনো কোনো বই, কণ্ঠে খানিকটা আফসোসের সুর তার। এ সমস্যা রোধে সরকার আশু কোনো পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা প্রকাশ করলেন তিনি।
নইলে বই কেনা যে তার একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। তার পক্ষে বই ছাড়া বেচে থাকা, সেও কি সম্ভব ?
মেঘের কান্না থামছে না তাই বৃষ্টি মাথায় রেখেই বেরিয়ে গেলেন গত ওয়ানডে ওয়ার্ল্ড কাপে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করা এ ক্রিকেটার। ততোক্ষণে জানা হয়ে গেছে জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ এখনো ভেতরে আছেন। একটু পর তার সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ মিললো। কথা হলো নতুন ঘরানার ক্রিকেট নিয়ে।
আলোচনায় অবধারিতভাবেই চলে এলো সাউথ আফ্রিকার বাউন্সি উইকেট প্রসঙ্গ। মাসুদের বিশ্বাস ছিল সাউথ আফ্রিকানরা দর্শকদের আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্য এবার কোনো ধরনের বাউন্সি উইকেট তৈরি করবে না। ফলে সহজ হবে সেখানে ব্যাট করা। তার কথার সত্যতা টোয়েন্টি২০-এর প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক সাউথ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলায় খুজে পাওয়া গেলেও পুরো টুর্নামেন্টের ক্ষেত্রে হয়তো প্রযোজ্য হয়নি। বাংলাদেশের বর্তমান টিমের ওপরও অনেক আস্থা তার।
বিশেষ করে প্রস্তুতিমূলক টোয়েন্টি ম্যাচগুলোতে ভালো করা নাজিমউদ্দিনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন খালেদ। এবারের আসরে সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, কিন্তু ভবিষ্যতে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তরুণ নাজিম চেষ্টার নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি করবেন না।
ক্রিজের ক্যারিয়ারকে এখনো পুরোপুরি বিদায় জানাননি খালেদ মাসুদ। অথচ তার আগে বেশ সিরিয়াসভাবে কোচিংয়ের প্রাথমিক দীক্ষা নিয়ে ফেললেন। কেন? এর উত্তরে বলেন, আমরা যখন খেলা শুরু করেছি তখন তো এতো সুযোগ ছিল না, নিজের উদ্যোগেই সব শিখতে হয়েছে।
তাই টেকনিকগুলো ভুল না সঠিক ছিল বা ভুল থাকলেও কতোটুকু ভুল ছিল সেগুলো জানতাম না, কিভাবে সেসব শুধরানো যায় তা জানার জন্যই এ ট্রেইনিংটা করলাম। আরো একটা কারণ অবশ্য আছে। তার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে, কোনোখানে গেলে প্রায়ই নবীন ক্রিকেটাররা অনেক কিছু আমার কাছে জানতে চায়। তখন যাতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শেখাতে পারি, সেজন্যই এ ভিন্ন রকম প্রস্তুতি।
সামান্য কিছু আলাপচারিতার মধ্যেই চোখ পড়লো ঘড়ির দিকে।
ঘণ্টার কাটা ৩টাকে অতিক্রম করেছে বেশ আগে। এখনো বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফিরে যাওয়ার তাড়া অনুভব করলেন পাইলটও। পুরো স্টেডিয়ামই তখন বলতে গেলে ফাকা।
যেন খাওয়া-দাওয়া সেরে বেশ বড় লম্বা একটা ভাতঘুম দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুরো গ্যালারি, দুই-চারজন তখন শুধু এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে।
সবাই ওখানকার কর্মচারী। খেলা চলুক বা না চলুক তাদের ওখানেই থাকতে হয়। ড্রেসিংরুমের কার্পেটটা হয়তো ছিড়ে গেছে, ওটা সেলাই করতে হবে কিংবা রোদ না ওঠায় সিড়ির কোনো ধাপে শ্যাওলা পড়ে যাচ্ছে সেটা পরিষ্কার করতে হবে ইত্যাদি নানা কাজে ব্যস্ততাময় দিন পাড়ি দেয় পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা।
একটু বৃষ্টি হলেই স্টেডিয়ামের মূল ফটকের বাইরে ও ভেতরে বেশ পানি জমে যায়। আসা-যাওয়া করা তখন বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এ অসুবিধাটার কথা মোটামুটি কমবেশি সবাই উল্লেখ করলেন। এবারের বর্ষা মৌসুমে তেমন বড় ম্যাচ না থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি কিন্তু সামনের দিনগুলোয় দর্শকদের জন্য ছোট-খাট কিছু ব্যাপারই হয়ে দাড়াতে পারে বড় ঝামেলার কারণ। বিশেষত সামনে যখন বাংলাদেশের কাধে ২০১১ ওয়ার্ল্ড কাপ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনের মতো গুরু দায়িত্ব।
মিরপুরের এ স্টেডিয়ামটি ক্রিকেটের জন্য পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ার পর এখানকার স্থানীয় এক বাসিন্দা মন্তব্য করেছিলেন, খুব ইচ্ছা ছিল বাড়ির পাশের মাঠে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হবে আর আমি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তা দেখতে যাবো, তাই এখন দারুণ খুশি, এতোদিনে সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।
হ্যা, সব কথার শেষ কথা এটাই এখন হয়তো কিছুদিন নির্জনতায় ঘুমিয়ে আছে আমাদের হোম অফ ক্রিকেট, কিন্তু ঘুম ভাঙানির ডাক চলে এলো বলে।
ঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করাই আছে, এখন শুধু অপেক্ষা সঠিক সময়ে কাক্সিক্ষত শব্দ শোনার। দেশের মাটিতে অভিজ্ঞ ও তরুণ খেলোয়াড়দের কিছু জম-জমাট ক্রিকেট লড়াই দেখার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।