আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুররা-তুল-আইন হায়দার : উর্দু সাহিত্যের মার্কেজ

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

২১ আগস্ট ২০০৭ মারা গেলেন প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক কুররা-তুল-আইন হায়দার। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি উর্দু সাহিত্য জগতে স্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ইনডিয়ার আউটলুক ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে ইনডিয়ার স্বাধীনতার ৬০ বছরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা করার জন্য একটি জুরি বোর্ড গঠিত হয়। এ বোর্ড কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ না রেখে ইনডিয়ার স্বাধীনতার ৬০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ৬০ ব্যক্তির মধ্যে তাকে নির্বাচিত করে।

তাকে অভিহিত করা হয় উর্দু সাহিত্যের মার্কেজ হিসেবে। বলা হয়, নিজের উপন্যাস ও ছোট গল্পের মাধ্যমে এ জ্যোতির্ময় লেখক উর্দু সাহিত্যকে একটি সাহসী ও অসীম নতুনত্বের সন্ধান দিয়েছেন। এর আগে দি টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট তার সর্বোৎকৃষ্ট কাজ আগ কি দরিয়া বা দি রিভার অফ ফায়ারকে তুলনা করেছিল মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচুডের সঙ্গে। বলা হয়েছিল স্প্যানিশ সাহিত্যে ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচুডের যে অবস্থান, উর্দু সাহিত্যে আগ কি দরিয়ারও ঠিক একই অবস্থান। অমিতাভ ঘোষ মন্তব্য করেছেন, ২০ শতকের ইনডিয়ায় তার কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৯ সালে তিনি আখির এ সাব কে হামসফর (ট্রাভেলার্স আনটু দি নাইট) উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, সভিয়েট ইউনিয়নের নেহরু অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১৯৬৯ সালে, ১৯৮৫ সালে পেয়েছেন গালিব অ্যাওয়ার্ড, তিনি পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত হন এবং ২০০৫-এ ভূষিত হন পদ্মভূষণ খেতাবে। বাংলাদেশে কাজ করলেও কিন্তু বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে তিনি মোটামুটি অপরিচিত। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা তৈরি হয়েছে। তাকে জানার নতুন অবকাশ ও তৈরি হয়েছে।

কুররাতুল আইন হায়দারের জন্ম ১৯২৬ সালের ২০ জানুয়ারি। উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে। মৃত্যুও হলো উত্তর প্রদেশের নয়ডায়। সাহিত্যিক বা বন্ধু মহলে তিনি স্রেফ এনি আপা বলে পরিচিত। তিনি বিখ্যাত লেখক সাজ্জাদ হায়দার ইয়ালদ্রামের মেয়ে।

সাজ্জাদ হায়দার ছিলেন মুক্ত মনের আলোকিত একজন মানুষ। তিনি নারী কল্যাণ ও নারী শিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। উর্দু সাহিত্যের প্রথম দিকের বিখ্যাত লেখক হওয়া সত্ত্বেও তিনি টার্কিশ ভাষা থেকে ছোট গল্প ও উপন্যাসিকা অনুবাদ করেছেন। তার মা নজর সাজ্জাদ হায়দারও একজন ঔপন্যাসিক ছিলেন। তিনিও মুক্তমনা লেখ ছিলেন।

উর্দুভাষী মেয়েদের মধ্যে তার সাহিত্যের বিশেষ কদর ছিল। মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কুররা-তুলের নাম রাখা হয়েছিল বিখ্যাত ইরানিয়ান কবি কুররা-তুল-আইন তাহিরার নামের অনুকরণে। তিনি যখন লিখতে শুরু করেন তখনো উর্দু সাহিত্যে উপন্যাস কোনো শক্তিশালী ধারা নয়। মুখ্যত কুররা-তুল-আইনের প্রজন্মের হাতেই কবিতা নির্ভর উর্দু সাহিত্যে উপন্যাসের ধারাটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

তিনি উর্দু সাহিত্যে সবচেয়ে আলোচিত ঔপন্যাসিক। লক্ষেèৗ ইউনিভার্সিটির ইসাবেলা থবর্ন কলেজ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি পেইন্টিং, মিউজিক বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অন্যান্য শিল্প বিষয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তার বাবা মারা যান ১৯৪৩ সালে।

তিনি ও তার মা থাকতেন দেরা দুনে। ৪৭-এর স্বাধীনতার পর দেরা দুনসহ সারা ভারতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে তিনি ও তার মা লখনউ থেকে পালাতে সক্ষম হন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে তারা করাচি যান। সেখানে তার একমাত্র ভাই ছিল। পাকিস্তানে হায়দার বিজ্ঞাপন, মুভি ও প্রকাশনা নিয়ে কাজ করেন।

তিনি বেশ কিছুদিন বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) কাজ করেছেন। কিছুদিন লন্ডনে থাকার পর ১৯৬০ সালে তিনি একেবারে ইনডিয়া চলে আসেন। লন্ডনে তিনি বিবিসিতে কাজ করতেন। মুম্বাইয়ে বেশির ভাগ সময় তিনি ছিলেন জুহুতে। কিছুদিন আগে জুহু থেকে উত্তর প্রদেশের নয়ডায় চলে যান।

নয়ডা দিল্লির কাছের একটি শহর। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন একদম ছোট বেলায় মাত্র ১১ বছর বয়সে। তিনি বিখ্যাত সব পত্রিকায় কন্ট্রিবিউট করতেন ছোট বেলা থেকেই। এ পত্রিকাগুলো ছিল প্রধানত নারী ও শিশুদের জন্য।

খুব শিগগিরই তিনি ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে তার প্রথম গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। তার প্রথম উপন্যাস মেরি ভি সনম খানে (মাই আইডল হাইসেস টু)-এর পরপরই প্রকাশিত হয়। তার সাহিত্য কর্মের মধ্যে আছে ১২ উপন্যাস ও উপন্যাসিকা, চারটি ছোট গল্প সঙ্কলন ও অন্য ভাষার বেশ কয়েকটি কাসিকসের অনুবাদ। তার অন্য বইগুলো হলো পাতঝর কি আওয়াজ (দি ভয়েস অফ দি অটাম, ১৯৬৫), রোমনি কি রাফতার (দি স্পিড অফ লাইফ, ১৯৮২), ছোট উপন্যাস চায়ে কে বাগ (টি প্লান্টেশনস, ১৯৬৫), কার এ জাহান দারাজ হ্যায় (দি ওয়ার্ক অফ দি ওয়ার্ল্ড গোজ অন)।

আগ কি দরিয়া তারা বিখ্যাত উপন্যাস হলেও পরের অনেক উপন্যাসে তিনি আরো বেশি সাহিত্যিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন আখির সাব কে হামসফর, গারদিস এ রাঙ এ চামান, চানদানি বেগম। সমালোচকরা তার গারদিস এ রাঙ এ চামান উপন্যাসটিকে সবচেয়ে সফল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার বইগুলো ইংরেজিসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বম্বে থেকে প্রকাশিত ইমপ্রিন্ট ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত।

১৯৬৮-৭৫ পর্যন্ত ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইনডিয়ার এডিটোরিয়াল স্টাফ ছিলেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, শিকাগো, উইসকনসিন ও অ্যারিজোনায় গেস্ট লেকচারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটির খান আবদুল গাফফার খান চেয়ারের প্রফেসর এমেরিটাস ছিলেন। তিনি সেই ভাগ্যবান বা দুর্ভাগ্যবান প্রজন্মের লেখক যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ ও বৃহৎ অভিজ্ঞতাকে নিজ চোখে দেখেছেন তরুণ বয়সে। আবার এ ঘটনার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই যাদের দেশভাগের অভিজ্ঞতা বরণ করতে হয়েছে।

যাদের চোখের সামনে দেশভাগের রক্তনদী বয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে আগুনের নদী। দেশভাগ ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বলতে গেলে কুররা-তুল-আইন হায়দার হলেন তেমন একজন লেখক যিনি সবচেয়ে ব্যাপকভাবে বিষয়গুলোর অনুসন্ধান করেছেন। তিনি সাধারভাবে দেশভাগের দৃশ্যমান সহিংসতা নিয়ে লেখেননি। যেমনটি সাদত হোসেন মান্টো বা অন্য অনেক লেখক করেছেন।

তার বিখ্যাত উপন্যাস আগ কি দরিয়া একটি ঐতিহাসিক গল্প। যা বিস্তৃত হয়েছে চতুর্থ শতক থেকে আধুনিক ইনডিয়া ও পাকিস্তানে। যেখানে স্বাধীনতার সময়টিকে স্রেফ একটি সাদা পাতায় আগস্ট ১৯৪৭ লিখে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাইরের ব্যথার চেয়ে তার মনোযোগ বেশি অন্তর্গত বেদনার দিকে। তিনি বলেছেন সেই অনিঃশেষ বেদনার কথা যা মানুষ চিরদিনের জন্য বহন করে বেড়াবে।

সে সমযের উর্দু লেখকদের প্রায় সবাই ছিলেন পুরুষ। তারা সেই সহিংসতা ও হিংসা নিয়ে লিখেছেন যাকে স্রেফ ধর্মের নামে বৈধতা দেয়া হয়েছিল। সাদত হোসেন মান্টো, কৃষ্ণ চন্দর, খাজা আহমদ আব্বাস, কুদরাতুল্লাহ সাহিবসহ অসংখ্য লেখক এ ধারায় গল্প লিখেছেন যা দাঙ্গার গল্প নামে বিশেষভাবে পরিচিত। কিন্তু এদের প্রায় সবাই বাইরের সহিংসতার দিকে জোর দিয়েছেন। এ কারণে তাদের উপন্যাস বা গল্প কম প্রখর।

সেগুলোতে তাদের মেধা সম্পূর্ণভাবে ব্যয় হয়েছে কিন্তু এগুলো যেন সহিংসতার কিছু সাহিত্যিক নমুনা। এদের পরের রাজেন্দর সিং বেদি এ রক্তাক্ত সহিংসতা থেকে অন্য দিকে মন দিতে পেরেছিলেন। তার কাছে দাঙ্গার চেয়ে পরিবার ও জনপদের ভাঙন অনেক বড় বিষয় হিসেবে সামনে এসেছিল। তিনি দেশভাগ ও দাঙ্গার মানবিক দিকগুলোর দিকে তাকানোর অবকাশ পেয়েছিলেন। সমালোচক সি এম নাইমের মতে, সম্ভবত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণেই কুররা-তুল-আইন হাযদার অন্যসব পুরুষ ও নারী লেখকের চেয়ে নিজের অবস্থান আলাদা করে ফেলতে পেরেছিলেন।

নিজে দেশভাগের শিকার হয়েছিলেন বলেই এর মানবিক দিকগুলো তাকে বিশেষভাবে তাড়িত করেছিল। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, তিনি প্রথমে উপন্যাসের বড় ক্যানভাসে, পরে ছোট গল্পে এগুলো নিয়ে লিখেছেন। ফিফটিজের দিকে তাকে নিয়ে কিছু সমালোচনাও হয়েছে। তিনি বুর্জোয়া সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন এমন অভিযোগ করা হয়েছে। ইসমত চুগতাই এমনকি তাকে লক্ষ্য করে পম পম ডার্লিং উপন্যাস লিখেছেন।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উর্দু সাহিত্যের সফল এ লেখকের কীর্তিই বড় হয়ে উঠেছে। ফলে তার মৃত্যু সাহিত্যের একটি ধারার অবসান ঘটালো। উর্দু সাহিত্যে যে ধারার সূচনা স্বয়ং কুররা-তুল-আইন হায়দারের হাতেই হয়েছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।