জীবন তো একটাই, এ এক জীবনকে সাজাতে বর্ণিল বাঁধনে বাঁধতে সেই গর্ভকালীন সময় থেকে শুরু হয় আয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। অনাগত সন্তানকে ঘিরে মাতা-পিতার মনে দোলা দেয় কত কি স্বপ্নসাধ। ভূমিষ্ঠ শিশু মানেই এক একটি পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের সম্পদ, আগামী ভবিষ্যৎ, অনন্ত আশার আলো। তাকে ঘিরে সূচিত ভালোলাগা ভালোবাসার বাঁধন ক্রমশই হয় বিস্তৃত। এই বিস্তৃত পথ সব সময়ে সমতল মসৃণ হবে এমনটা নয়।
যারা পারছেন না বিরূপ পরিবেশকে কঠোর মনোবল দিয়ে রুখতে, হচ্ছে না দেহ-মনের সমন্বয়, কাটছে না সংকট, ফলে শেষ অস্ত্র হিসেবে তারা বিতর্কিত অধ্যায়কে বেছে নিচ্ছেন। আইনরক্ষক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ দিনমজুর, মঙ্গাকবলিত কর্তাপুরুষটি পর্যন্ত বাদ যাচ্ছেন না, সমস্যা সমাধানে আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছেন। আর এই আলোচিত প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয় অনেকের সঙ্গে-
ঘটনা-১
মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার এক ভুক্তভোগী মা কামরুন্নাহার বলছিলেন- আজ থেকে ১১ বছর আগের কথা। ৬ ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বশেষ সন্তান নাফিস ছিল তার হৃদয়ের মধ্যমণি। বরিশালের রহমতপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি, এইচএসসিসহ মেধাতালিকায় তালিকাভুক্ত ভালো ছাত্র হয়েও যখন বুয়েট, ঢাকা মেডিকেলে টিকল না, তখন ওর ভেতরে ভেতরে মনোবল ভেঙে পড়ছে।
কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। ওর দুর্বলতাকে ঘিরে পরিবারের ভিন্ন সবার মতো মা হয়েও তিরস্কার করতাম। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেললাম-এত ভালো পাস দিয়ে যখন কোনো জায়গায় স্থান হলো না গলায় দড়ি দিয়ে মরব।
নাফিস শেষ ভরসা ভালোবাসার আশ্রয় মায়ের মুখ থেকে শোনা কথাটিকে সত্য বলে ধরে নেবে মা হয়ে তিনি বুঝতে পারেননি। আঁচলে চোখ মুছে বলছিলেন- ছেলে সত্যি সত্যি ফ্যানের সাথে রশি ঝুলিয়ে...আসলে আমারই ভুল, নিজ সন্তানকে বুঝতে পারিনি।
মায়ের মমতাবোধ ভালোবাসার অধিকারে সন্তানের কাছে খুব বেশি বিনিময় আশা করেছিলাম। অধিক আশার বিচ্যুতি হওয়াতে নিজ সন্তানকে মরতে বলেছি। এই অপরাধবোধ থেকে ইহজনমে আমার মুক্তি নেই। জানি না পরপারে কী হয়! অনেক বাবা-মা আছেন সন্তানের মঙ্গল কামনায় এতটা উদগ্রীব যে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই মুখে যা আসে বলে, অকথ্য ভাষায় গালি দেয় এমনকি মারধর পর্যন্ত করে। তাদের উদ্দেশ্যে একটাই অনুরোধ- অতি ভালো চাওয়া যেন চির বিচ্ছেদময় অমঙ্গলকর কিছু না হয়।
যার বাস্তব উদাহরণ আমার নাফিস, আর তার এই শোকাচ্ছন্ন মা।
ঘটনা-২
কলাবাগান লেক সার্কাস রোডের সুশিক্ষিত দিলরুবা, তার প্রয়াত স্বামী কলেজ প্রিন্সিপাল মফিজুল আলম সম্পর্কে বলতে গিয়ে, শোকে-দুঃখে, মুষড়ে পড়ছিলেন। বারবার বলছিলেন বিশ্বাস করুন ও এভাবে গাঢ় অভিমানে দুটি সন্তানসহ আমাকে জীবনের অকূল সমুদ্রে ফেলে হারিয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। দ্বিধান্বিতভাবে স্বীকার করছিলেন দিলরুবা, আমার চেয়ে ঢের সুন্দর সুপুরুষ, গুণী হওয়াতে হীনমমন্যতার শিকার হয়ে ওকে ঈর্ষা করতাম। এক পর্যায়ে দেখলাম সেই ঈর্ষা সন্দেহের রূপ ধরল।
ওর পোস্টিং ভিন্ন শহরে হওয়াতে সন্দেহের বেগ বহুগুণে বেড়ে গেল। আমার প্রতি মফিজ একটু আধটু অমনোযোগী হলেই রাগে, দুঃখে অগ্নিমূর্তি ধারণ করতাম। মা-বাবার নিত্য দাম্পত্য কলহ সহ্য করতে না পেরে, ছেলেরা যে যার রুম বন্ধ করে বসে থাকত। আসলে ওর শৈল্পিক সুন্দর জীবন আদর্শ কুণ্ঠিত আমাকে দিশেহারা করে ছিল। তাছাড়া নিজের অব্যক্ত কথা খুলে বলার মতো বাবা-মা, ভাই-বোনসহ তেমন কোনো বন্ধু ছিল না।
উচিত ছিল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া, যেতেই হলো তবে অনেক দেরি করে, মফিজুলের আত্মহত্যার পর। আসলে আমি শুধু স্বার্থপরের মতো নিজেকে বুঝতে চেয়েছি। একবারও বুঝতে চাইনি স্ত্রী হয়ে স্বামীর প্রতি তিক্ত অনুভূতি, সন্দেহে অহরহ তিরস্কার ওকে আত্মহত্যার চরম সিদ্ধান্তে ঠেলে দেবে। যখন বুঝলাম তখন ও আমাদের কাছ থেকে অনেক-অনেক দূরে, যেখান থেকে কেউ কখনো কোনোদিন ফিরে আসে না। বাবার শোক ভুলতে বড় ছেলেটা লেখাপড়া ছেড়ে গোপনে ড্রাগ ধরেছে।
ছোটটা মন দিয়ে লেখাপড়া করলেও মাঝে মাঝে প্রচণ্ড জিদ ধরে। কখনো মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করে না। আমাকে সদা চিন্তিত রাখে, ওকে চোখের আড়াল করতে সাহস হয় না। নিজেকে সারাক্ষণ কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখি বুঝে নিয়ে, জীবন থেকে সোনালি দিনগুলো হারিয়ে গেছে, নিজের ভুলের দংশন-আত্মহুতি দিয়ে।
ঘটনা-৩
বরিশাল বিএম কলেজের অনার্সের দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ বাণীর মা বলছিলেন, চাপা স্বভাবের মেয়েটা যে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে বুঝতেই পারিনি।
লোকমুখে ভাসা ভাসা শুনেছি মধ্যবিত্ত ঘরে অর্থ শিক্ষিত এক ছেলে ওর বন্ধু ছিল, সে বন্ধুত্ব যে এতটা প্রীতিময়, গভীর বাণী নিজেকে নিঃশেষ করে আমাদের বুঝিয়ে গেল। যেদিন পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসছিল সেদিন ৮-১০টা মেয়ের মতোই ও ছিল স্বাভাবিক। মেহমানদের নিজ হাতে খাবার পরিবেশন, পাত্রের সাথে মুখোমুখি জানাশোনার পর্ব, তাদের পরিয়ে দেয়া এনগেজমেন্ট রিং জড়তা ছাড়াই পরে নিয়েছিল। সবকিছুই ছিল যে পরিবারের লোকদের খুশি করার ভূমিকা বাণী কাউকেই তা বুঝতে দেয়নি। ও না পেরেছিল আমাদের কষ্ট দিতে, না পেরেছিল প্রেমিককে পীড়িত দেখতে।
উভয় দ্বন্দ্বে ভুগে নিজ দহনে নিজে জ্বলে নীরবে হারিয়ে গেছে। অভিভাবকদের করে গেছে কষ্টবিদ্ধ হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি। যা থেকে পরিত্রাণের পথ নেই। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আমার হাতের মাঝে ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে যখন বলছিল, মা আমি একবারের জন্য শুধু বাঁচতে চাই তখন আর সময় ছিল না, শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ পৌঁছে গিয়েছিল। সেলাইনের রিদম থেমে গেল।
চোখের সামনে ফুটফুটে মেধাবী মেয়ে আমার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল, মা হয়ে আমি তা দু’চোখ মেলে দেখলাম।
সন্তানের শোকে উন্মাদ কাতর মা চিৎকার করে বলছিলেন, দেশে এত কিছুর ভেজাল হয় এসিড আর বিষে কেন ভেজাল হয় না? তাহলে কোনো একটা মেয়েকে এসিডে পুড়ে কিংবা অতি আবেগের বশে আত্মহত্যার পথ ধরে মরতে হতো না, শূন্য হতো না মায়েদের কোল।
ঘটনা-৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অন্ধের মতো যাকে ভালোবেসেছিল, দেহ-মনের সমস্ত অস্তিত্ব উজাড় করে দেখেছিল বাসরের স্বপ্ন, যাকে ঘিরে নিত্য মনের কোণে বুনছিল সংসার-সন্তানের বুনন। শিক্ষিত সেই ইঞ্জিনিয়ার মানুষটি পারিবারিক চাওয়া-পাওয়ার কাছে মাথানত করে, প্রেমিকার হৃদয়ের সুষমামণ্ডিত ভালোবাসার বন্ধন এড়িয়ে গেল। শিল্পী সইতে পারল না নিখাদ ভালোবাসার অপমান।
নিজের চেয়েও আপন দীর্ঘদিনের চেনাজানা বিশ্বাসঘাতক মানুষটি প্রকৃত পরিচয় জেনে অবশেষে অপমানিত গ্লানিকার বোঝা এড়াতে মৃত্যুর ব্যাসার্ধে নিজেকে তলিয়ে দিল।
ঘটনা-৫
ব্যবসায়ী আশিক-লুবনার স্বাচ্ছন্দ্যময় সুখের সংসার দু বছরের মেয়ে ফাইজাকে ঘিরে সুখেই কাটছিল। নতুন ব্যবসার কাজে ভীষণ রকম ব্যস্ত হয়ে পড়াতে, পরবর্তীতে আশিক লুবনাকে নির্দিষ্ট কোনো সময়ই দিতে পারত না। সংসারের সব দায়িত্ব টাকার মাপকাঠিতে সারতে চাইত। স্বামী-সংসার-সন্তান-কাঁচা বাজারসহ দৈনন্দিন চাহিদা এক হাতে সামাল দিতে লুবনা হিমশিম খেত।
এছাড়া আশিকের লুবনার প্রতি ছিল না কোনো মানসিক পরিচর্যার দায়। ঈদ, বিবাহবার্ষিকী, মেয়ের জন্মদিনসহ বিশেষ বিশেষ দিনেও আশিকের অনুপস্থিতি লুবনাকে নতুন সম্পর্ক গড়তে প্রেরণা জোগাল। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে বন্ধুত্বের পথ ধরে সিফনের অস্তিত্ব লুবনার হৃদয়ে কখন যে ঠাঁই করে নিল লুবনা অনুভব করার অনুভূতি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিল। ভুলে গিয়েছিল স্বামী-সংসার সন্তানের উপস্থিতি। এক সময়ে আশিক নিজ অধিকারের বলে সব জেনে, লুবনার কাছে জানতে চাইল সিফনের পরিচয়।
লুবনা স্বামী আশিকের কাছে কোনো কিছু গোপন করেনি। বলেছিল লুকায়িত সব সত্য। আর এই সত্যের বলে আশিক ওকে আট বছরের নিজ হাতে গড়া সংসার থেকে বের করে দেয়। লুবনা ছুটে যায় সিফনের কাছে। সেই বিনয়ী প্রেমময় সদা হাসিখুশি সিফনকে অসহায় লুবনার মনে হয় বদলে যাওয়া মানুষ।
সিফন তাদের সম্পর্ককে নিছক বন্ধুত্ব বলে লুবনাকে এড়িয়ে যায়। সাতদিনের ব্যবধানে কীর্তনখোলার চরে যেদিন বেওয়ারিশ লুবনার লাশ ভেসে উঠে তখন শিশু ফাইজা জানে না তার মা কোথায়, কবে কখন ফিরে আসবে।
ঘটনা-৬
খবরে প্রকাশ, অবশেষে মঙ্গার কবলে পড়ে কেশবপুর উপজেলার বেগমপুর গ্রামের ৩৩ বছরের রেজাউল নিত্য অভাব, ধার করার টাকা ও ঋণ শোধ করতে না পারার অক্ষমতা সহ্য করতে না পেরে স্ত্রীর ধার করে আনা বিশ টাকায় বিষপানে আত্মহত্যা করে দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে পালাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।
বাণী-নাফিস-শিল্পী-লুবনা-রেজাউলের মতো অনেকেই আত্মহত্যার পথ ধরে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। এর পেছনে আছে ঘটনা অঘটন-লুকায়িত কষ্টবোধ, অসহনীয় যন্ত্রণা।
তাদের চিন্তাধারায় এর কোনো সমাধান ছিল না বলেই দেহকে বলি দিয়ে জীবনের বলয় গুছিয়েছে। এই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের শোকের দুঃখে কোনো কিছু কি থেমে থেকেছে? আশিক নতুন করে বিয়ের আসরে বসেছে। সিফন তার নিজ সংসারে গৃহস্বামীরূপে সদা ব্যস্ত। শিল্পীর প্রেমিক মানুষটি সুখ-আনন্দ স্বপ্নে বিভোর। বাণীর প্রেমিক একদিন বেঁচে থাকার তাগিদে কোনো এক নারীর চরিত্রে বাণীকে খুঁজে ফিরবেন।
অথচ ফাইজা কি পাবে কোনো নারী চরিত্রে তার মায়ের মমত্ববোধ! নাফিসের মা, বাণী-শিল্পীর মা-বাবা কি পারবে নিজ সন্তানের দাবিতে ভিন্ন কাউকে বুকে ঠাঁই করে দিতে? রেজাউলের বৌ দিলরুবা কি পারবেন নতুন কোনো পুরুষকে তাদের সন্তানের পিতার পরিচয়ে পরিচিত করতে?
চলমান সময়কে ঘিরে আসবে অপবাদ লাঞ্ছনা-হতাশা। সম্পর্কের রেশ ধরে দেখা হবে, জানা যাবে বিশ্বাসঘাতকদের পরিচয়। অভাবের পিষ্টতা করবে নিষ্পেষিত। তাই বলে মৃত্যুর কাছে পরাজিত আত্মসমর্পণ কখনো কোনো বিজয়ী সৈনিক সৃষ্টির শ্রেষ্ঠদের সমাধান হতে পারে না। তাই সবাই কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি-
আর নয় কোনো একটি প্রাণের আত্মাহুতি-নিজের সাথে নিজের প্রবঞ্চনা, অকাল মৃত্যুকে আলিঙ্গন, পরাজয়ের দংশনে নিজেকে বিলুপ্ত করা।
গাইতে হবে বিজয়ীর বেশে সকল বৈরিতাকে রুখে আত্মজয়ের গান।
আরও অনেক নতুন নতুন খবর এখানে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।