আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শবে বরাত - ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া (১ম কিস্তি)

কথামালা

শবে বরাত ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা প্রণেতাঃ ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া এমএম (ঢাকা), লিসান্স, এমএ, এম-ফিল, পিএইচ ডি (মদীনা) সহকারী অধ্যাপক, আল-ফিকহ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ ---------- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম শবে বরাত শব্দের অর্থঃ 'শব' শব্দটি ফারসী শব্দ যার অর্থ রাত বা রজনী। আর 'বরাত' শব্দটিও ফারসী শব্দ যার অর্থ ভাগ্য। তাই দু'শব্দের অর্থ হলো: ভাগ্য রজনী। অনেকে বরাত শব্দটিকে আরবী মনে করে থাকেন। যা সম্পূর্ণ ভূল; কারণ বরাত বলতে আরবী ভাষায় কোন বাক্য নেই।

আর যদি বরাত শব্দটি আরবী ভাষার বারা'আত শব্দটির অপভ্রংশ ধরা হয় তবে তার অর্থ হবেঃ সম্পর্কচ্ছেদ বা বিমুক্তিকরণ। কিন্তু কয়েকটি কারণে এ অর্থ গ্রহণ করা যায়না; ১. এর আগের শব্দটি ফারসী হওয়াতে তাও ফারসী শব্দ হিসাবে নেয়াই স্বাভাবিক। ২. আরবী ভাষায় শা'বানের মধ্যরাত্রিকে কেউই বারা'আতের রাত্রি হিসাবে ঘোষনা করেনি। ৩. রমযান মাসের লাইলাতুল কাদরকে কেউ কেউ লাইলাতুল বারা'আত হিসাবে নামকরণ করেছেন, শা'বানের মধ্য রাত্রিকে নয়। আরবী ভাষায় এ রাতটিকে কি বলা হয়? আরবী ভাষায় এ রাতটিকে 'লাইলাতুন নিছফ মিন শা'বান' বা শাবান মাসের মধ্য রাত্রি হিসাবে অভিহিত করা হয়।

শাবানের মধ্য রাত্রির কি কোন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে? শাবান মাসের মধ্য রাত্রির ফযীলত সম্পর্কে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে: ১) আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: এক রাতে আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুজে না পেয়ে তাকে খুজতে বের হলাম, আমি তাকে বাকী গোরস্তানে পেলাম। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন: 'তুমি কি মনে কর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবে?' আমি বললাম: 'হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর নিকট চলে গেছেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: 'মহান আল্লাহ তা'লা শা'বানের মধ্য রাত্রিতে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে বেশী লোকদের ক্ষমা করেন। হাদীসটি ইমাম আহমাদ তার মুসনাদে বর্ণনা করেন (৬/২৩৮), তিরমিঝি তার সুনানে (২/১২১,১২২), বর্ণনা করে বলেন, এ হাদীসটিকে ইমাম বুখারী দুর্বল বলতে শুনেছি। অনুরূপভাবে হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৯) বর্ণনা করেছেন।

হাদীসটির সনদ দূর্বল বলে সমস্ত মুহাদ্দিসগণ একমত। ২) আবু মূসা আল আশ'আরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ 'আল্লাহ তা'আলা শাবানের মধ্য রাত্রিতে আগমণ করে মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যতীত তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০), এবং তাবরানী তার মু'জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা বূছীরি বলেন: ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মাজমা' আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃ ত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী।

হাদীসটি ইবনে হিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম'আন, হাদীস নং (১৯৮০), পৃঃ (৪৮৬)। ৩) আলী ইবনে আবী তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ "যখন শা'বানের মধ্য রাত্রি আসবে তখন তোমরা সে রাতের কিয়াম তথা রাতভর নামায পড়বে, আর সে দিনের রোযা রাখবে; কেননা সে দিন সুর্য ডোবার সাথে সাথে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন: ক্ষমা চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি ক্ষমা করে দেব। রিযিক চাওয়ার কেউ কি আছে যাকে আমি রিযিক দেব। সমস্যাগ্রস্থ কেউ কি আছে যে আমার কাছে বিমুক্তি চাইবে আর আমি তাকে উদ্ধার করব।

এমন এমন কেউ কি আছে? এমন এমন কেউ কি আছে? ফজর পর্যন্ত তিনি এ ভাবে বলতে থাকেন"। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮) বর্ণনা করেছেন। আল্লামা বূছীরি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেনঃ হাদীসটির বর্ণনাকারীদের মধ্যে ইবনে আবি সুবরাহ হাদীস বানাতো। তাই হাদীসটি বানোয়াট। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শা'বানের মধ্য রাত্রির ফযীলত বর্ণনা করে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলিই দুর্বল অথবা বানোয়াট।

আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন প্রকার আহকাম সাব্যস্ত করা যায় না। তারা দুর্বল হাদীসের উপর আমল করার জন্য কয়েকটি শর্ত দিয়েছেনঃ ১. হাদীসটির মূল বক্তব্য অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিরোধীতা করবেনা, বরং কোন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ২. হাদীসটি খুব দূর্বল বা বানোয়াট হতে পারবেনা। ৩. হাদীসটির উপর আমল করার সময় এটা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করতে পারবে না। কারণ রাসূল থেকে প্রমাণিত বিশ্বাস করলে রাসূলের উপর মিথ্যা হাদীস বর্ণনার গুনাহ তথা জাহান্নাম অবধারিত হয়ে পড়ে।

৪. হাদীসটি ফাদায়িল বা কোন আমলের ফযীলত বর্ণনা করছে এমন হাদীস হবে। আহকাম (ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরূহ) সাব্যস্তকারী হবেনা। ৫. হাদীসটি ব্যক্তি ও তার প্রভূর মধ্যে একান্ত ব্যক্তিগতভাবে আমল করা যাবে। এ হাদীসের উপর আমল করার জন্য কেউ অপরকে আহবান করতে পারবে না। এ শর্তাবলীর আলোকে যদি আমরা উপরোক্ত হাদীস সমূহের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহের মধ্যে শেষোক্ত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদীসটি বানোয়াট।

সুতরাং তার উপর আমল করা উম্মাতের আলেমদের ঐক্যমতে জায়েয নেই। প্রথম হাদীসটি দুর্বল, দ্বিতীয় হাদীসটিও অধিকাংশ আলেমের মতে দুর্বল, যদিও কোন কোন আলেম এর বর্ণনাকারীগণকে শক্তিশালী বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র বর্ণনাকারী শক্তিশালী হলেই হাদীস বিশুদ্ধ হওয়া সাব্যস্ত হয়না। মোট কথাঃ প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসদ্বয় দুর্বল। খুব দুর্বল বা বানোয়াট নয়।

আর তাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাত্রির ফযীলত রয়েছে। আর তাই এ রাত্রির ফযীলত রয়েছে বলে অনেক মুহাদ্দিস মত প্রকাশ করেছেন, তম্মধ্যে রয়েছেনঃ v ইমাম আহমাদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্নিত। (ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন)। ঙ্ ইমাম আওযায়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। (ইমাম ইবনে রাজাব তার 'লাতায়েফুল মা'আরিফ' গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন)।

v শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। (ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু' ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪)। v ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। (তার লাতায়েফুল মা'আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য)। v প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) (ছিলছিলাতুল আহাদীস আস্সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯)।

উপরোক্ত মুহাদ্দিসগনসহ আরো অনেকে এ রাত্রিকে ফযীলতের রাত বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমরা যদি উপরোক্ত প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসদ্বয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব হাদীসদ্বয়ে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানাতে থাকেন। মুলতঃ সহীহ হাদীসে সুস্পষ্ট এসেছে যেঃ "আল্লাহ তা'আলা প্রতি রাত্রেই রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে আহবান জানাতে থাকেন "এমন কেউ কি আছে যে আমাকে ডাকবে আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব? এমন কেউ কি আছে যে আমার কাছে কিছু চাইবে আর আমি তাকে তা দেব? আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?" (বুখারী, হাদীস নং ১১৪৫, মুসলিম হাদীস নং ৭৫৮)। সুতরাং আমরা এ হাদীসদ্বয়ে অতিরিক্ত কোন কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। সুতরাং এ রাত্রির বিশেষ কোন বিশেষত্ব আমাদের নজরে পড়ছেনা।

এজন্যই শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহ আরো অনেকে এ রাত্রির অতিরিক্ত ফযীলত অস্বীকার করেছেন। (চলবে) --------------------------------------------------- এ লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ত এই লিংক অথবা এই লিংকে যান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।