আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পর্ব-৫- বুখারী শরীফ একটি বিকৃত গ্রন্থঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা

ভাল কথা বলুন পর্ব-১ - হাদীস সংকলনের ইতিহাসঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা পর্ব-২- বুখারী হাদীস গ্রন্থ ত্রুটিমুক্ত নয়ঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা পর্ব-৩- ইমাম বুখারীর হাদীস সত্যায়ণ করার পদ্ধতির ভুল ভ্রান্তিসমূহঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা পর্ব-৪- ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের মাঝে ঝগড়া ও বিরোধের ইতিহাসঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা বর্তমানে যে বুখারী শরীফ এর কথা আমরা জানি, অনেকেই সেটিকে একটি অবিকৃত নির্ভেজাল গ্রন্থ বলে মনে করি যা সরাসরী ইমাম বুখারীর তরফ থেকে আমাদের হাতে এসে পৌছেছে। অথচ বর্তমান বুখারী হাদীস গ্রন্থটি যে অনেক বিকৃতি, এডিটিং এর পর বহু সংকরণে বিভক্ত হয়ে, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে, কিছু অংশ চীরতরে হারিয়ে গিয়ে, কিছু অংশ কিছুটা পরিবর্তীত হয়ে অবশেষে একটি গ্রন্থ হয়ে আমাদের হাতে এসে পৌছেছে, সেকথা অনেকেরই অজানা। অর্থাত বর্তমান বুখারী শরীফ আর ইমাম বুখারীর লিখা আসল বুখারী শরীফ ঠিক একই রকম নয়। সেযুগে কোন প্রিন্টিং প্রেস, ফটোকপি মেশিন ছিলনা। তাই চাইলেই বাজার থেকে কোন বই কিনতে পাওয়া যেতনা।

শিক্ষকরাও চাইলেও শিষ্যদের মাঝে বই বিলি করতে পারতেননা। একমাত্র উপায় ছিল শিক্ষক ক্লাসে বসে কোনবই থেকে ডিকটেশন দিতেন আর হাজার হাজার ছাত্র তা নিজের খাতায় লিখে নিতেন। লিখার পর কোন ভুল ত্রুটি হল কিনা সেটা এক এক করে হাজার হাজার ছাত্রের জন্য চেক করে দেখা কোন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। ইমাম বুখারীর গ্রন্থটি ছিল অতিকায় বৃহত। আধুনিক ছাপাখানার ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখার পরেও এটি দশটি মোটা ভলিউম এর বিশাল গ্রন্থে পরিণত হয়েছে।

মান্ধাতা আমলের প্যাপাইরাসের উপর হাতে লিখা বুখারী শরীফ ছিল কাগজের বিশাল স্তুপ। দীর্ঘ আট বছর ধরে ইমাম বুখারী এই গ্রন্থটি তার শত শত শিষ্যদের নিকট শিক্ষা দিয়েছিলেন। মাত্র একবার শুনার পর শিষ্যরা সেটা নিজেদের খাতায় লিখে নিয়েছিলেন, শুধু আল ফিরাব্রী নামক একজন শিষ্য সেটা দুবার শুনার সূযোগ পেয়েছিলেন। ইমাম বুখারীর নিজ হাতে লিখা কাগজের বিশাল স্তুপের সেই গ্রন্থটি চীরতরে হারিয়ে গিয়েছে যা কোথাও সংরক্ষিত নেই। তার শত শত ছাত্রের মাঝে অধিকাংশই ইমাম বুখারীর শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

শুধুমাত্র পাঁচ জন ছাত্র এই কাজে সফল হয়েছিলেন। খ্যাতির ক্রমানুসারে তাদের নাম নিচে উল্লেখ করা হল। ১, আল ফিরাব্রী ২, ইব্রাহীম বিন মাকাল ৩, হাম্মাদ বিন শাকির ৪, আবু তালহা মনসুর ৫, হুসেইন বিন ইসমাইল উপরোক্ত পাঁচ জন শিষ্যের নিজেদের হাতে লিখা বুখারী গ্রন্থের মাঝে ছিল বিস্তর ফারাক। এত বিশালাকার একটি গ্রন্থ মাত্র একবার শুনে লিখলে মানুষ্য ত্রুটির কারণে ফারাক থাকাটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছুনা। বিষয়বস্তুর ফারাক ছাড়াও একেক জনের কপির মাঝে শত শত হাদীস কম বেশী ছিল।

তবে আসল কথা হচ্ছে, এই পাঁচ জনের নিজ হাতে লিখা পাঁচটি গ্রন্থও চীরতরে হারিয়ে গিয়েছে যা কোথাও সংরক্ষিত নেই। এই পাঁচ জনের মধ্যে প্রথমজন, আল ফিরাব্রীর ছিল আবার শত শত ছাত্র যারা আল ফিরাব্রীর মুখে শুনে নিজ নিজ খাতায় বুখারী গ্রন্থ লিখেছিলেন। ফিরাব্রীর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্রটির নাম ছিল আল খুশায়মানি। এই আল খুশায়মানি সহ ফিরাব্রীর অন্যান্ন কিছু ছাত্রের নিজ হাতে লিখা বুখারী গ্রন্থের ম্যানুস্ক্রীপ্ট বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। ফিরাব্রী ছাড়া ইমাম বুখারীর বাকি চার ছাত্রের পরবর্তী শিষ্যদের কিছু ম্যানুস্ক্রীপ্টও বর্তমানে সংরক্ষিত আছে তবে ফিরাব্রীর ছাত্রদের গ্রন্থগুলোর তুলনায় এগুলোর কদর কম।

তবে ফিরাব্রীর ছাত্রদের গ্রথগুলোও নির্দিষ্ট কোন সুস্পষ্ট গ্রন্থ ছিলনা, বিশাল ছিল বিধায় পার্ট বাই পার্ট এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো ছিল। একসাথে সংকলন ও হাদীসগুলো বুঝার জন্য তাই আরও ৫০০ বছর পর খুশায়মানী, ইউনানী সহ ফিরাব্রীর প্রায় এক ডজন ছাত্রের লিখা বুখারী কপির উপর ভিত্তি করে ৭০ টির বেশী বুখারী হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ (শারহ বা তাফসীর বা Commentary) লিখিত হয়েছিল। এই ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোই আধুনিক বুখারী শরীফের ভিত্তিমূল। এগুলোর মধ্যে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর লিখা ''ফাথ আল বারী'' ব্যাখ্যাগ্রন্থটি আলেমদের মাঝে সর্বাধিক স্বীকৃত ও শুদ্ধ বলে পরিচিতি পেয়েছে। ইমাম আসকালানী বলেছেন যে আল ফিরাব্রী ২ বার বুখারী গ্রন্থটি শুনেছিলেন বিধায় তিনি তার ''ফাথ আল বারী'' গ্রন্থে ফিরাব্রীর ছাত্র আল খুশায়মানির বইটি মূল স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্ট হিসেবে নিয়েছিলেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য ছাত্রের বই স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্সট হিসেবে নিয়েছিলেন, এবং ইমাম আসকালানী দাবী করেছেন যে নিজ মর্জি অনুযায়ী বুখারীর স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্সট বাছাই করার ইসলামী অধীকার নাকি তার ছিল।

ইমাম আসকালানী তার ''ফাথ আল বারী'' গ্রন্থে ফিরাব্রীর ছাত্রদের লিখা বুখারী গ্রন্থগুলোর মাঝে বিদ্যমান পার্থক্যগুলোও লিপিবদ্ধ করেছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে ইমাম আসকালানী আল খুশায়মানির গ্রন্থটি স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্সট হিসেবে নিয়েছিলেন, অথচ তাদের জীবনকালের মাঝে ফারাক ছিল প্রায় ৫ শত বছর। এই পাঁচশ বছরে খুশায়মানির গ্রন্থটি নানা হাতে অদল বদল হয়েছে, এবং কেউ যে এতে কিছু ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সংযোজন-বিয়োজন করেনি তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। ফিরাব্রীর ছাত্র মুসতামলীর নিজস্ব স্বীকারোক্তিতেই কিছু এডিটিং এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সে যাই হোক, আধুনিক বুখারী শরীফের ৯০% ই ইমাম আসকালানীর লিখা এই ''ফাথ আল বারী'' গ্রন্থটির স্ট্যান্ডার্ড ট্যাক্সট থেকে নেয়া হয়েছে।

এতক্ষণে পাঠক বুঝে ফেলেছেন যে আধুনিক বুখারী শরীফের কতগুলি হাদীস ইমাম বুখারীর নিজ হাতে সংকলণ করা হয়েছিল সে ব্যাপারে নিশ্চিত হবার উপায় বর্তমানে নেই। ইমাম বুখারীর নিজ হাতে লিখা মূল গ্রন্থটিই চীরতরে হারিয়ে গিয়েছে। বুখারীর মুখ থেকে শুনে লিখা তার ছাত্রদের মূল গ্রন্থগুলোও চীরতরে হারিয়ে গিয়েছে। বুখারী থেকে ফিরাব্রী এবং ফিরাব্রী থেকে খুশায়মানি পর্যন্ত ট্রান্সফার হবার সময় বুখারীর গ্রন্থে কি পরিমাণ পরিবর্তন হয়েছে মূল গ্রন্থগুলো চীরতরে হারিয়ে যাবার ফলে সেটা যাচাই করার আর কোন উপায় নেই। বুখারীর ছাত্রদের পরের প্রজন্মের ছাত্রদের লিখা গ্রন্থগুলোর মূল কপি থাকলেও তাদের মাঝে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য, আর সেগুলোর বেসিসে আধুনিক বুখারী সংকলণ হয়েছে সেগুলো লিখিত হবারও ৫০০ বছর পর।

এর মাঝে কি মূল বুখারী গ্রন্থে কোন বিকৃতি ঘটেনি? অবশ্যই ঘটেছে। তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণও আমাদের হাতে আছে। ১৮০০ হাদীস বর্ণনাকারীর চরিত্রের বর্ণনা নিয়ে ইমাম বুখারী আলাদা একটি গ্রন্থ আছে। সেখানে প্রায় এক ডজন বর্ণনাকারীকে ইমাম বুখারী অনির্ভরযোগ্য, আনঅথেন্টিক বলে রায় দিয়েছেন। অথচ আধুনিক বুখারী শরীফে সেই প্রতিটি অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বলা হাদীস সংকলিত হয়েছে! এটি কি মূল বুখারী গ্রন্থের বিকৃতির একটি বড় প্রমাণ নয়? অতএব, আলোচনার খাতিরে যদি ধরেও নেই যে ইমাম বুখারী ১০০% শুদ্ধতার সাথেই তার সহিহ গ্রন্থটি সংকলণ করেছিলেন, তবুও বর্তমানে সেই শুদ্ধতা আর বজায় নেই।

তবু কিভাবে এই বিকৃত গ্রন্থটি শরীয়া আইনের মূল ভিত্তি হিসেবে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে? সাধারণ মানুষ যখন কোনভাবে একটি হাদীসের ত্রুটি বা কোরানের সাথে হাদীসটির বিরোধ আবিষ্কার করে তখন মোল্লাশ্রেণীর লোকেরা নানা ছল চাতূরীর আশ্রয় নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ সেই হাদীসটিকেই তাকে সত্য বলে গিলিয়ে ছাড়ে। সাধারণ মানুষ ভেবে বসে আমার তো এত জ্ঞান নেই তাই মোল্লা সাহেবই হয়তো ঠিক বলছেন। এভাবেই প্রশ্নকারীকে দমিয়ে রেখে যুগ যুগান্তর ধরে এই হাদীস শাস্ত্র টিকে আছে। পরবর্তী পর্বে হাদীস বিশ্বাস করানোর জন্য মোল্লা সাহেবদের এই ছল চাতূরীর প্রকৃত স্বরুপ ও তার উপযুক্ত জবাব নিয়ে আলোচনা করা হবে। চলবে।

তথ্যসূত্রঃ ১) ফাথ আল বারী- ইবনে হাজার আসকালানী ২) Introduction to the translation of Ibn Hajar al-Asqalani's commentary on selected hadith - Abdal Hakim Murad ৩) Canonization of Bukhari and Muslim- Dr. Jonathan Brown ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।