আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাকুরীর প্রত্যাশা ও বিবাহের প্রতিশ্রুতিতে নারীর দুর্গতি

পদবী মানুষকে গৌরবদীপ্ত করে। এই দীপ্তি তার জীবনেকে দেয় স্নিগ্ধ আলো। সে তার পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে অর্জন করে সম্মান. ক্ষেত্র মতো স্নেহ, আদর, ভক্তি ও শ্রদ্ধা পায়। এর যথার্থ হেফাজত করার দায়িত্ব পদবীধারীর। তাই প্রবৃত্তির অনুসরণ করার সুযোগ পদবীধারীর নাই।

এই পদবীধারীদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক সময় এই সম্মান, স্নেহ , আদর , ভক্তি, শ্রদ্ধার যথার্থ কদর করতে পরাক্সমুখ হযে পড়ে। তার মনে জন্ম নেয় অহমিকা। সে ভাবে তার অর্জিত এসবই চিরস্থায়ী। এই মানসিকতায় আপ্লুত হয়ে সে প্রবৃত্তির পিছনে ধাবিত হয়। ইন্দ্রিয় লিপ্সু হয়ে বেপরোয়া জীবন যাপন করতে শুরু করে।

তখনই সে হয়ে যায় সমালোচনার পাত্র। তার জীবনে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। সুবল সাহা এভাবেই বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছিল। দাপ্তরিক ‘ইউনিফর্ম’ পরে সুবল সাহা তার কর্মস্থল বারোবারি এলাকায় মটর সাইকেলে চড়ে সে ঘুরতো। জনগণ তাকে কর্মতৎপর দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতো।

সে ছিল সকলেরই আশীর্বাদধন্য। বারোবারি ঐলাকার সম্ভান্ত ঘরের মেয়ে অজ্ঞলী। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর সে চাকুরীর সন্ধান করতে থাকে। চাকুরী প্রাপ্তি তো সহজ নয়। অনেক জায়গায় দরখাস্ত করেও সে সফল হতে পারেনি।

চাকুরীর সন্ধানের পাশাপাশি সমাজ সেবা মূলক কাজে মন দেয় অজ্ঞলী রানী। এভাবেই অজ্ঞলী রানীর সাথে সুবলের পরিচয় হয়। তারা একে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষন করে। অজ্ঞলীর মনে বাসনা জাগে সুবলের মতো পদে চাকুরী করার। এই কারণেই সে একদিন সুবলের দপ্তরে যায় ।

নিজের মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করে সুবলের কাছে। অজ্ঞলীর বাকপটুতা ও সৌন্দর্য আকৃষ্ট করে সুবলকে। তাই অজ্ঞলীকে সে নিরাশ করে নাই। চাকুরী দেবার ক্ষমতা না থাকলেও সে অজ্ঞলীকে চাকুরী পাইয়ে দেবার আশ্বাস দেয়। এরপর থেকেই শুরু হয় অজ্ঞলীর বাড়িতে সুবলের যাতায়াত।

তারা একে অন্যেও প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। দুষ্টুবুদ্ধি চেপে বসে সুবলের মনে। নিজের স্ত্রী-সন্তানদের কথা গোপন করে অজ্ঞলীর কাছে। সরলমনা অজ্ঞলী সবই বিশ্বাস করে। এই গোপন করা বিষয় অজ্ঞলীর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।

সুবলের কর্মজীবী স্ত্রী থাকতো মণিরামপুরে সন্তানসহ। এ ছাড়া সুবলের প্রতি অন্ধ প্রেম প্রসূত বিশ্বাস অজ্ঞলীকে করে দেয় আরো অন্ধ। তাই অজ্ঞলীকে কেউ সুবল সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানাতে চাইলেও অজ্ঞলী তা কোন ভাবেই গ্রহণ করে নাই। দুষ্টু বুদ্ধির সুবল ও প্রেমান্ধ অজ্ঞলীর সম্পর্ক এভাবেই দিনকে দিন গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। ইতিমধ্যে সুবল বদলী হযে যায় দিনাজপুরে।

অভিভাবকদের বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে চাকুরীর সাক্ষাৎকার দেবার জন্য অজ্ঞলীও চলে যায় দিনাজপুরে। চাকুরীর বিষয় ছিল সাজানো কথা। দিনাজপুরে নিজের কাছে অজ্ঞলীকে রাখতে সামাজিক প্রশ্নের উদ্ভব হয়। সমাধান করতে কালী মন্দিরে গিয়ে অজ্ঞলী ও সুবল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিছুদিন একত্রে বসবাস করার পর অজ্ঞলী বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে।

টুটে যায় তার অন্ধ বিশ্বাস। সুবলও তার পরিবারের কাছে অজ্ঞলীকে নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখিন হয়। বিষয়টা এড়াতে ও ধামা চাপা দিতে সুবল অজ্ঞলীকে বিদায় করতে চায়। অজ্ঞলী নাছোড় বান্দা। সে স্ত্রীর যথাযথ মর্যাদা ও চাকুরী দুটোই দাবী করে সুবলের কাছে।

সুবল ভাবে যৌতুক দাবী করলে অজ্ঞলী সরে যাবে। তাই সে বিবাহ কালীন যৌতুক দাবী করে অজ্ঞলীর কাছে। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। অজ্ঞলীকে মারধর করে সুবল। পরিস্থিতির অবনতি হলে সুবলের সহকর্মীদের সহায়তায় অজ্ঞলী চলে যায় তার পিত্রালয়ে।

অকপটে স্বীকার করে তার ভুলের কথা। প্রায়শ্চিত্ত করে। সুবলের অপকর্মের প্রতিবিধান করার জন্য শরণাপন্ন হয় আদালতের। তার অভিযোগ বিজ্ঞ বিচারক আমলে নেন। গ্রেফতার হয় সুবল।

নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবী করে সুবল বলে যে তার বিরুদ্ধে অজ্ঞলী কর্তৃক আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। অজ্ঞলী ভদ্র পরিবারের মেয়ে হলেও বিপথগামী চরিত্রহীনা। সেই সাথে উড়ো চিঠির মধ্যে পাওয়া একটি ছবি উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালে। ছবিটি আপত্তিকর ভঙ্গিতে এক পুরুষের সাথে অজ্ঞলী তুলেছে। উভয়েই দিগম্বর।

ছবিটি অশ্লীল তাই এজলাসে সর্ব সমক্ষে দেখানো থেকে বিজ্ঞ বিচারক বিরত থাকলেন। অজ্ঞলীকে দেখানো হলে সে কেঁদে ফেললো এবং বললো যে ছবির মুখ মন্ডল তার নিজের তবে ছবিতে দেহের বাকী অংশ তার নয়। বিষয়টি সরেজমিনে যাচাই করার জন্য বিজ্ঞ বিচারক দুজন মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিলেন। তারা জানালো যে ছবি সম্পর্কে অজ্ঞলীর কথাই সঠিক। সুবল কিন্তু বলতে পারলো না ছবিটা কে তুলেছে বা কার হেফাজত থেকে সে পেয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে এসেও সুবল অসৎ পন্থার আশ্রয় নিয়েছে এটাই এ থেকে প্রতিভাত হলো। সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ শেষে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করলেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন , ২০০০ এর ১১(গ) ধারা অনুসারে আসামী সুবলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সশ্রম কারাদন্ড ও জরিমানায় দন্ডিত করে ট্রাইব্যুনাল। উক্ত আইনের অধীনে আনীত অভিযোগ সমূহের বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা ও দায়রা জজকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ গণও পদাধিকার বলে এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজদের সমপর্যায়ের বিচারকদের নিয়ে পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে । তারা মূলত এই আইনের অধীনে আনীত অভিযোগ সমূহের বিচার করে থাকেন। এ ছাড়াও সরকারী কর্মচারী ( সাজার কারনে চাকুরীচ্যূতি ) অধ্যাদেশ , ১৯৮৫ অনুসারে কোন সরকারী কর্মচারী ফৌজদারী মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা প্রাপ্ত হলে সে চাকুরীচূত হবে। সাজাদানকারী আদালত রায়ের অনুলিপি সাজাপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীর নিয়োগকর্তার কাছে পাঠাবেন বলে উক্ত আইনে বিধান রাখা হয়েছে। তদমোতাবেক বিজ্ঞ বিচারক রায়ের অনুলিপি পাঠিয়ে দিলেন সুবলের নিয়োগকারী কর্মকর্তার কাছে।

সুবল কারাদন্ড ভোগ করার পাশাপাশি চাকুরীচ্যূত হলো। অজ্ঞলী এবং উৎসুক জনগণ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো রায় শুনে। কিন্তু অজ্ঞলী কি পেলো? তার জীবন এসব ঘটনার কারণে কালিমালিপ্ত হলো , যা কোন দিন মুছে যাবার নয়। ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে প্রেমান্ধ হয়ে পড়ার কারণেই তার পূত পবিত্র জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। এটা সে বুঝলো , কিন্তু অনেক বিলম্বে ।

যখন এ থেকে উত্তরণের কোন পথ নাই। সারা জীবন তাকে এই ভুলের মাশুল দিয়ে যেতে হবে। লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।