পঞ্চ ইন্দ্রিয়র মাঝে চোখ অপার বিস্ময়। রহস্যের চাদরে মোড়া এর প্রতিটি তৎপরতা, প্রতিটি মুহূর্ত। মনের ভাব ধারণ করতে বা বুঝে নিতে চোখের জুড়ি নেই। মানবদেহের মাঝে এটা এমন একটি স্পর্শকাতর অঙ্গ যা, অন্য সব অঙ্গের পর সচল হয়। কারণ মায়ের উদরে চোখ ছাড়া সব মানব অঙ্গই সক্রিয় থাকে।
শিশু জন্মের পরই প্রথম চোখ মেলে স্বপ্নের পৃথিবীটাকে ধীরে ধীরে দেখে। সম্ভবত এ কারণেই ভাস্কর্যবিদরা তাদের শিল্পকর্মের চূড়ান্ত পর্বে এসে চোখের আদল ফুটিয়ে তোলেন। এটাই মানব শিশু বা শিল্পকর্মের আখি উন্মীলন।
সন্দেহ নেই ভাবের সম্মোহন, আবেগের তূর্ণগতি আর মাদকতা সৃষ্টির এক সৃষ্টিশীল আধার এ মানবীয় চোখ। কবিকুল কি এ কারণেই কাতর আখি মেলে আত্মসত্তার সন্ধান করে যান সারাটি জীবনভর?
বোধের অপার্থিব পারাপারে সব চোখের ভাষাকে একই কায়দায় অনুবাদ করা যায় না।
কারণ কারো কারো চোখ শুধু বহিরঙ্গের মতো ঝলসিতই নয়, এর অন্তঃপ্রবাহেও বিচ্ছুরিত। জীবনের সাতরঙ আর সৌন্দর্যের অবলোকন চুটিয়ে উপভোগের জন্য চাই বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি। চর্মচোখে একজন শিল্পী যা দেখেন, তা তিনি তার ভাবনার পাড়ে জামদানি শাড়ির মতো বুনন করে যান অবলীলায়, একের পর এক, নিজের মতো করে। এ কারণে চোখ এক অনিঃশেষ তাৎপর্যময় অথচ সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ জটিল অঙ্গ। এটা রূপের নেকাব পরে অন্তহীন সৌন্দর্যের উৎসমূলেও নিরন্তর ছুটতে পারে।
আবার চোখ যেমন হয়ে উঠতে পারে ধ্বংসের শব্দহীন ই-মেইল, তেমনি হয়ে উঠতে পারে জীবন শিকারি এক বিমূর্ত আকাক্সক্ষার স্বপ্নিল ইশারা। তাই চোখের ব্যাকরণ উপলব্ধি করতে না পেরে অনেকে বিভ্রান্ত জহুরিতে পরিণত হয়ে কপাল চাপড়ান অথবা পানির আরেক জ্ঞাতিভাই ‘চোখের জলে’ শূন্য বুকটা ভেজান।
চোখ তো শতাব্দীর খেলাঘর। আর এ খেলাঘরে প্রতিনিয়ত জেগে ওঠে নাম না জানা হাজারো শিহরণ, কতো দুর্ঘটনা, শাশ্বত প্রেমের নন্দিত আবাহন। এটা কখনো আনন্দে হয়ে ওঠে উদ্বেল, কখনো বা বিষণœ সন্ত্রাসে হয় জীবনাহত।
এটা মানব মনে যেমন সূর্যের স্বাক্ষর একে দিতে পারে, তেমনি পারে হতাশার আজানুলম্বিত মানচিত্র একে দিতে। চোখের সামান্য কুঞ্চনে যেমন প্রথম আবেগের বন্ধ দরজা খুলে যেতে পারে, উন্মোচিত হতে পারে জীবনের এক অপরিচিত পৃষ্ঠা, তেমনি জানাতে পারে স্বপ্নভঙ্গের নির্মম বেদনা।
চোখ যে প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আশাবাদিতার উৎস। তবে মুহূর্তের অবিশ্বাসে এটা হয়ে যেতে পারে স্বপ্নভাঙার নির্ঝর, অবরুদ্ধ ইচ্ছার দেয়ালে ছড়িয়ে দিতে পারে কাটা আর কাটা।
চোখের মাঝেই মানুষ খুজে নিতে পারে পৃথিবীর তাবৎ কবিতা Ñ স্বপ্ন ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব, ইচ্ছা ও অনিচ্ছার দ্বৈরথ, শান্তি আর অশান্তির টানাপড়েন।
চোখের জোরেই মন পায় বিচিত্র গতি। প্রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে কতো কবি যে তার বিশ্বাসে সোপর্দ শব্দের ইমারত গড়েছেন, তার হিসাব কে রাখে? তবে চোখের ভাষার পাঠোদ্ধারে সবাই সমান পারঙ্গম নন। অবশ্য এক্ষেত্রে বুদ্ধির আলো নয়, মোহের অন্ধকারেই জীবন চলার নকীব হয়ে যেতে পারে। তারপরও দুটো চোখের নিরাবরণ অথবা ব্যঞ্জনাধর্মী শব্দহীন কথোপকথনের মধ্য দিয়েই অনেক সময় নিমিষেই রচিত হয়ে যায় জীবন বিশ্বাসী চেতনার উপভোগ্য কবিতা। এক্ষেত্রে কবিকুল হয়তো সবসময় এক ধাপ এগিয়ে থাকেন।
তারা নাকি তাদের চোখের ভাষার মুগ্ধতায় চারপাশের জীবনসত্য সহজে মুখস্থ করে নিতে পারেন ঈর্ষণীয় দক্ষতায়।
চোখ একটি উৎকৃষ্ট সজ্ঞান। এটা মানব মনে জাগায় সাড়া, চেতনায় জোগায় সমৃদ্ধি। এটা একটা নিশ্চিত হিরন্ময় নক্ষত্র। মনের প্রেরণায় চোখের দৃষ্টি দিয়েই চিন্তাবিদরা সমকালীন আবর্জনাগুলো চিহ্নিত করে সমাজকে ঋদ্ধ করেন।
আবার সে চোখই মানে না মনের শাসন। এটা ভূগোল নিক্ষিপ্ত অপরিচিতজনকেও আপন বানাতে শক্তি জোগায় এক দুর্নিবার তৃষ্ণায়। চোখের মনোজ্ঞ মৌলিকতা এখানেই। কখনো তা সুস্পষ্ট, কখনো বা রহস্যাবৃত। চোখের পরাজয় ঘটে শুধু এক জায়দায়, আর তা হচ্ছে সৌন্দর্য।
কারণ সুন্দরকে শতবার দেখার পরও চোখ তৃপ্ত হয় না।
আসলে চোখ শুধু কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অঙ্গই নয়। এটা কখনো সাহিত্য, কখনো বা একটি উচ্ছল প্রাণবন্ত প্রেমের কবিতা। যা কিটসের যে কোনো সরস কবিতাকেও ম্লান করে দিতে পারে। শল্যবিদের ডিসেকশান টেবিলে চোখের সব সারবত্তা বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না।
কারণ মানুষের লবণাক্ত চোখের মাঝে ঘনীভূত থাকতে পারে এক বিরাট অদৃশ্য জিজ্ঞাসা। এ জিজ্ঞাসার জবাব চাইতে গিয়ে কবির কল্পনাও নিঃশেষ হয়ে যায়। চোখের ভাষার যে মাপকাঠি নেই!
পাচের মাঝে এক
মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয় পাচটি এবং যে জ্ঞানেন্দ্রিয় আলোকের মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টি সঞ্চার করে তা-ই চোখ। মানব চক্ষু দুটো মাথার দু’পাশে বহির্কর্ণ ও নাসারন্ধ্রের প্রায় মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। এটা গোলাকার অক্ষিগোলক দিয়ে গঠিত।
মানব চোখের ছয় ভাগের মাত্র এক ভাগ বাইরে উন্মোচিত থাকে, আর বাকি পাচ ভাগ কোটরের ভেতরেই অবস্থান করে। চোখের পর্দায় অবস্থিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসের কারণে চোখ সিক্ত থাকে। অক্ষিগোলক যে স্তরে অবস্থিত তা ‘অক্ষি আবরক’ নামে পরিচিত। এটি পুরু এবং তিনটি স্তরে গঠিত। তন্তুময় স্তর, রক্তবাহিকাময় স্তর ও স্নায়ুময় স্তর।
তন্তুময় স্তর আবার দু’ভাগে বিভক্তÑ কর্নিয়া ও এসকেয়া।
রক্ত বাহিকাময় স্তর তিন ভাগে বিভক্তÑ আইরিশ, কোরয়েড ও সিলীয় অঙ্গ। আইরিশের কেন্দ্রীয় অংশই পিউপিল নামে পরিচিত। অপরদিকে চক্ষুগোলকের সবচেয়ে ভেতরের অংশটিই রেটিনা। এটিই একমাত্র আলো সংবেদী অংশ।
এছাড়া চোখের বাকি আনুষঙ্গিক অঙ্গগুলো হচ্ছে অক্ষিকোটর, অক্ষিপেশি, অক্ষিপল্লব, কনজাংটিভা ও চক্ষুগ্রন্থি। অক্ষিপেশিতে রয়েছে তিন জোড়া বিপরীতধর্মী পেশি। এগুলোর নাম হলোÑ সুপিরিয়র রেকটাস ও ইনফেরিয়র রেকটাস, ইন্টারনাল রেকটাস ও এক্সটারনাল রেকটাস, ইন্টারনাল অরবিক ও এক্সটারনাল অরবিক। আবার চক্ষুগ্রন্থিতে রয়েছে তিন ধরনের গ্রন্থির সমাবেশ। এগুলোর নাম অক্ষগ্রন্থি, হার্ডেরিয়ান গ্রন্থি ও মেবোসিয়ান গ্রন্থি।
হার্ডেরিয়ান ও মেবোসিয়ান গ্রন্থির তৈলাক্ত নিঃসরণই নেত্রপল্লব ও কর্নিয়াকে পিচ্ছিল রাখে। আবার অশ্রুগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত এক ধরনের লবণাক্ত ও রোধক তরল (লাইসোজাইম উৎসেচক) কনজাংটিভাকে নরম, সিক্ত, পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখে।
কিভাবে দেখি
নেত্রপল্লব খোলা থাকার সময় বস্তু থেকে নির্গত আলোকরশ্মি ক্রমান্বয়ে কর্নিয়া, অ্যাকুয়াস হিউমার, পিউপিল ও ভিটৃয়াসের মধ্য দিয়ে রেটিনায় প্রবেশ করে। আপতিত রশ্মি লেন্সের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিসৃত হয়ে রেটিনার ওপর একগুচ্ছ অভিসারী রশ্মিরূপে প্রতিফলিত হয়। রেটিনার আলোকসংবেদী ‘রড’ ও ‘কোন’ কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে অপটিকে স্নায়ুর মাধ্যমে এই আলোক অনুভূতি মস্তিষ্কের দৃষ্টি কেন্দ্রে পৌছে দেয়।
আর মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় ‘অজ্ঞাত’ উপায়ে উল্টো প্রতিবিম্ব সোজা হয়ে যায়।
মানুষের দৃষ্টিকে ‘দ্বিনেত্র’ বা ‘বাইনোকুলার ভিশন’ বলে। কারণ আমরা কোনো বস্তুকে একই সঙ্গে দুটো চোখ দিয়ে এককভাবে দেখতে পাই। তবে চোখের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এক চোখ আরেক চোখকে দেখতে পায় না।
আমরা আলো ছাড়া দেখি না।
বিজ্ঞানীরা বলেন, যদি কোনো বস্তু আলোকের গতির চেয়ে অধিক জোরে আমাদের কাছ থেকে সরে যেতে থাকে, তাহলে আমাদের দিকে আলো আসতে পারবে না। দূরবীক্ষণ যন্ত্র যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, আমাদের চর্মচোখ দিয়ে সেই বস্তুটি কোনো দিনই দেখা যাবে না। হঠাৎ আমাদের চোখে আলোর ঝলকানি লাগলে আমাদের মাঝে প্রতিক্রিয়া হয়। দীর্ঘদিন গবেষণার পর রুশ বিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে পৌছেন, আকস্মিক তীব্র আলো আমাদের চোখে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা ‘রিফ্যাক্স রিঅ্যাকশন’ বা ‘প্রতিবর্ত ক্রিয়া’। এটা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির মাঝে পড়ে।
জন্ম থেকেই আমাদের এমন কিছু প্রবৃত্তি থাকে, যা অর্জন করতে আমাদের অনুশীলন করা লাগে না। এসব প্রবৃত্তি শর্তসাপেক্ষও নয়। জন্মের পর শিশু কাদে, মাতৃদুগ্ধ ঠিকই পান করতে পারে। চোখের সামনে কোনো কিছু উড়ে এসে পড়তে গেলে চোখ আপনিতে বন্ধ হয়ে যায়। এ জাতীয় অনেক সহজাত প্রতিক্রিয়া আমাদের চোখে পড়ে।
চোখ জুড়িয়ে যায়
মানুষের দৈহিক সৌন্দর্যের মাঝে চোখ নিজেই একটি অনন্য আদর্শ। এটা জাগতিক সৌন্দর্যের অনুপম উপকরণ। সুন্দর চোখ দেখে আমাদেরও চোখ জুড়িয়ে যায়। চোখ যে ভালোবাসার প্রতীক। এটার সৌন্দর্য যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত দাড়ায়Ñ ‘চোখ সুন্দর’।
সৌন্দর্যের মৌল চেতনা আবার কীটপতঙ্গের মাঝেও সক্রিয়। সুন্দর ও আকর্ষণীয় ফুল প্রজাপতিকে তাড়াতাড়ি আকৃষ্ট করে। তাই যে ফুলের প্রাকৃতিক রূপ যতো আকর্ষণীয় সে ফুলের বংশগতি রক্ষা ততো সহজ হয়। এটা প্রকৃতির যৌন নির্বাচন। অবশ্য চোখ নিয়ে নারীবাদীদের চেতনা ভিন্ন।
তাদের ধারণা, পুরুষ নারীর চোখকে কেন্দ্র করে যৌন উদ্দীপক দৈহিক বৈভব তালাশ করে যায় প্রতিদিন-প্রতি রাত।
আখি বাণে হিয়া জর জর
শাস্ত্রকার ও সাহিত্যিকরা নারীর চোখ নিয়ে এতো মজাদার উপমা সৃষ্টি করেছেন, যা কল্পনাকেও হার মানায়। এগুলোর মাঝে শ্লীল-অশ্লীল দুটোই আছে। কেউ বলেছেন, পটোল চেরা আখি কখনো ‘আকাশ’, কখনোবা ‘নারকেল দিঘি’। কেউবা বলেন, ‘ও চোখের চাহনিতে ধারালো সব তীর সাজানো রয়েছে থরে-বিথরে।
’ তাই কবি বলতে পারেন, ‘আখি বাণে হিয়া জর জর’। সত্যিই নারীর চোখে বাকা অপাঙ্গ চাহনিতে কটাক্ষ হানতে পারঙ্গম। বাকা চোখে ছুড়ে দেয় ‘কষ্ট-আনন্দ-প্রেম’। আবার সেই নারীই চোখের জলে মুক্তোর মালা গাথে, কেউবা পানির আরেক জ্ঞাতিভাই চোখের জলে সারাটি জীবন ভাসেন। রবিঠাকুর বলেছেন, ‘অশ্রুজল কাঁদলে তা বেলফুল হয়ে যায়।
’ নারী চোখের নিঃসীম গভীরতা কবি নাকি তার কল্পনার রশিতেও নাগাল পান না। সাত সাগরের গভীরতা নাকি ও দুটো চোখে। আর পাপড়িগুলো যেন পদ্ম সরোবরের তীরে ঝাউ-মহুয়া কিংবা পুকুর পাড়ে তরু শ্রেণী। ভ্রƒ দুটো নাকি বাকা ছুরিÑ কামের কামান। আবার ইংলিশ নাট্যকার শেক্সপিয়ার নারীর চোখকে প্রমিথিউসের আগুনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এ আগুন কাউকে বরফশীতল ঠা-া বানায়, কাউকে আবার জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দেয়। তারপরও এটা সত্য যে, নারী তার দুরবিন চোখ মেলে পুরুষের মনের অনেক খবরই মুখস্থ করে নিতে পারে। পুরুষের বেলায় সচরাচর তা ঘটে না। বরং নারীর রহস্যময়ী চোখের সহজ-সরল অনুবাদ জানতে পুরুষ প্রাণপাত করে।
নারী চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেউ কেউ আরো এক ধাপ ওপরে উঠেছেন।
তাদের মতে, যৌবনে নারীর চোখ নাকি নিজেই শিল্প হয়ে ওঠে। তাই এটা কখনো চাদের আলোর মতো স্নিগ্ধ, কখনো রুপোলি রোদের মতো ঝকমকে, কখনো বা প্রশান্ত বিলের জলের মতো নিস্তরঙ্গ, আবার কখনো বা ঝরনার মতো ঝরঝর করে কথা বলে।
প্রতীকবাদ ও পুরাণে চোখ
প্রতীকবাদে মানব চোখ শুধু বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীকই নয়, কখনো কখনো তা ভীতিরই প্রতীক। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন লৌকিক উপাখ্যানগুলোতে সূর্যকে ‘ইভিল আই’ বা ‘কুদৃষ্টি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। জাদু ও প্রতীকবাদে বলা হয়েছে, চোখ দিয়ে মানুষ শুধু নিজেকেই দেখে না, বরং মানুষ যা দেখে তাকেও প্রভাবিত করে নিজেকে বিভিন্ন আকার-আকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও সহায়তা করে অথবা চোখের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছানুসারে অপরকে সম্মোহিত বা প্রভাবিত করা সম্ভব।
সর্বদর্শী হিসেবে অতীতে বারবার চোখকে সূর্যের সঙ্গে (মাঝে মাঝে চাদের সঙ্গেও) তুলনা করা হয়েছে। এ বিশ্বে সূর্যই আলোর উৎস। সূর্যের মতো মানব চক্ষুও আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান বস্তুনিচয়কে দেখতে পায়। প্রতীকবাদ মতে, আলো নিজেই প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। তাই সূর্য যদি চোখ বিবেচিত হতে পারে, তাহলে আমাদের চোখও একটি সূর্য বিবেচিত হতে বাধ্য এবং তখন তা মানসিক ও অন্তর্দৃষ্টির প্রতিভূ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
পৌরাণিক উপাখ্যান ও কিছু কিছু ধর্মীয় তত্ত্বেও সর্বদর্শীয় প্রতীক হিসেবে মাঝে মাঝে দেব-দেবীদের একাধিক চক্ষুবিশিষ্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাদের সর্বদর্শী ও ব্যাপক শক্তির আধার মনে করা হতো। ব্যাবিলন দেবতা মারদুকের চার চোখ। অপরদিকে ইজিপশিয়ান দেবী বেজরের সারা শরীর জুড়েই চোখ আর চোখ। আর দেবী ‘আইসিস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বহু চোখ’।
একাধিক চোখ অনেক সময় রাতের আকাশের তারার সঙ্গেও বিবেচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে হিন্দু দেবতা বরুণের নাম উল্লেখ করা যায়। তার রয়েছে হাজার চোখ। একইভাবে ভাগ্য গণনায় ব্যবহৃত ফ্রান্সের ট্যারট কার্ড’-এ বর্ণিত শয়তানের শরীর জুড়ে রয়েছে অগণিত চোখ। ওল্ড টেস্টামেন্টের গোপন তাৎপর্য উদ্ঘাটন প্রয়াসী ইহুদি ধর্মগুরুরাও তাদের গৃহ্যতত্ত্ব পুস্তকে ট্যারট কার্ডের মতো একটি অক্ষর ব্যবহার করেন।
‘আয়িন’ নামের এ অক্ষরটি চোখের প্রতিনিধিত্ব করে।
বিশ্ব সংস্কৃতির চোখ
বিশ্ব সংস্কৃতিতে চোখের ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব কম নয়। চোখের মাঝে মানুষ অশুভ চেতনাও খুজে নিয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে আজকের যুগেও ‘কুদৃষ্টি’ বিশ্বের নানা অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। অপশক্তির কুদৃষ্টিতে ছেলেবুড়ো সবাই যে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখসহ কষ্টে পতিত হয়; তার ধারণাটি কমবেশি বিশ্বের সব সমাজে আজো দেখা যায়।
গবাদিপশুর মরে যাওয়া, ক্ষেতের ফসল বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, গাভীর ওলানে দুধ কমে যাওয়া, ঘোড়া খোড়া হয়ে যাওয়া, দুর্ঘটনা, অপ্রত্যাতি প্রতিকূলতাকে আজো শত্রু বা অপশক্তির কুদৃষ্টির ফসল মনে করা হয়। ব্যাবিলন ও ইজিপশিয়ান সভ্যতার বিভিন্ন স্মারক স্তম্ভে চোখ খোদিত রয়েছে। তাদের ধারণা ছিল, দেবতাদের চোখ সমাধিতে খোদিত থাকলে মৃতের দেহ নিয়ে অপদেবতারা ছেলেখেলা করতে পারেন না।
খাবার গ্রহণকালে অপরিচিত ব্যক্তি আফসোস বা লোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে আমরা বিব্রত হই। এটা আমাদের সংস্কৃতিতে ‘নজর পড়া বা লাগা’ নামে পরিচিত।
এ জাতীয় পরিস্থিতিতে বড়রা বিশেষত সন্তানের মা বেশ বিব্রত হন। নজর না লাগার জন্য অবশিষ্ট খাদ্যদ্রব্য ফেলে দেন অথবা সন্তানকে ‘নজর’ থেকে সরিয়ে নেন। বিশ্ব সংস্কৃতিতে কুদৃষ্টির প্রভাব শিক্ষার আলো জ্বেলেও পুরোপুরি তাড়ানো যায়নি। লোকাচারে বলা হয়ে থাকে, অপশক্তির কুপ্রভাব চোখের মাধ্যমে ভিন্ন বস্তুতে সঞ্চারিত হতে পারে। হিন্দু শাস্ত্রমতে, শিশুর জন্মের পরপরই একটি অদৃশ্য আত্মা জন্ম নেয়।
এই অদৃশ্য আত্মার কুদৃষ্টি থেকে সন্তানের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে হলে পরবর্তী ৪০ দিন মায়ের একটি স্তন ঢেকে রাখতে হবে। এতে অদৃশ্য আত্মাটি খাবারের অভাবে মারা যাবে। এ সময় যদি শিশুকে উভয় স্তন চুষতে দেয়া হয়, তাহলে সন্তানটির কুদৃষ্টি পরবর্তীকালে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে, দেবতা শিব ও পার্বতীর পুত্র গণেশের জন্মদিনের উৎসবে শনি দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এতে শনি দেবতা ক্ষুব্ধ হন এবং গণেশের দিকে একনজর দিয়েই মাথাটা বড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
আমন্ত্রিত বাকি দেবতারা তৎক্ষণাৎ একটি শিশু হাতির মাথা কেটে তা গণেশের মাথায় লাগিয়ে দেন। কুদৃষ্টির শক্তিশালী প্রমাণ এটাই। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আজো কুদৃষ্টি থেকে শিশুকে বাচাতে মাথার একপাশে টিপের আকারে ‘কাজল’ লাগানো হয়। অস্বাভাবিক রঙের বা আকারের চোখকে আমাদের সমাজে আজো ‘অশুভ’ মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, ময়ূরের একটি ম্যুরাল জাতিসংঘের সদর দফতরের দেয়ালে খোদিত হওয়ার পর নাইজেরিয়ার একজন অ্যামবাসাডর জাতিসংঘের সদর দফতরের ওই করিডোর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
শুধু নাইজেরিয়ানরাই নয়, বিশ্বের অনেক জাতি ময়ূরের পালকে খচিত উজ্জ্বল ছোপকে অশুভ চোখের সঙ্গে তুলনা করেন। ইসলাম ধর্মেও কুদৃষ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।