পিদিমের বয়স মাত্র তেরো। তেল চকচকে গায়ে আলো ফোটেনা ,কিন্তু মুখে কথার খই ফোটে। এইতো সেদিন, স্কুলে শিক্ষক তাকে বললো,‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগি মারা গেল’ এর ইংরেজি কি হবে ? পিটপিটে চোখে পিদিম বললো-এটার ইংরেজি পারিনা স্যার । তবে আরবিটা পারি । মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে শিক্ষক বললেন,তাই বলো।
পিদিম বললো-ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন’ !
শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি। অনুভবের সুযোগও নেই। কাঁধে পেটফোলা ব্যাগ ঝুলিয়ে চুইংগাম চিবোনোর পাট চুকেছে বছর দশেক আগে। তবে পিদিমের নাঁড়ি কাটার পর থেকে একজনকে দেখে আসছি। তার বাবা নাদিম।
বেচারা ! নিজ রক্তপিন্ডের কোপে সে নিজেই কুপোকাত ! নাদিমের শৈশব কেটেছে পাবনা জিলা স্কুলের হোস্টেলে । সপ্তাহ অন্তর সে চিঠি লিখতো তার বাবাকে। তার ভাষা আজও অনুরণ তোলে স্মৃতির মানসপটে। এখন পিদিমও চিঠি লেখে তার বাবাকে। সে চিঠির ভাঁজ নেই।
কাগজ-কলমের বালাই নেই। ট্যাবলেটে বুড়ো আঙ্গুলের ঘা মেরে চিঠি লেখে পিদিম। এইতো সেদিন লিখলো-Ma ask korlo j, kaal 2mi maa k phn korlena keno ?
ভাষাটা বাঙ্গালীর , হরফ ইংরেজদের। মনে পড়ে সেই প্রথম যৌবনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা। সেটা সম্ভবত ২০০৪ সাল।
পহেলা বৈশাখ। চারিদিকে বাসন্তির আগুন গায়ে চাপানো হাজারো উর্বশী। যেন রুচি বদল করতে তাদের পা পড়েছে স্বর্গ থেকে মর্ত্য । তাদের কুটুম পাখির মতো রক্তলাল ঠোঁট দেখে আমার বুকের ছাতি ফাটে । কোথায় যেন তিয়াস লাগে ।
তাই চারুকলায় ঘুরছিলাম ভবঘুরে কায়দায়। হঠাৎ বিলবোর্ডে দেখলাম ‘Dejuice দুনিয়া....আসছে। ’ এখন সেই দুনিয়ার স্রোতে নাদিমের চিঠি ভেসে গেছে অতীত মোহনায়। সেখানে এখন বসত করে পিদিমদের ‘বাংলিশ-চিঠি। ’ শরৎ বাবুর সেই অমৃতবচনটির মতো-‘অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে,কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় তেলাপোকা আজও টিকিয়া আছে।
’
সেই তেলাপোকা এখন গিলে খাচ্ছে বাঙ্গালী। ই-মেইল,এসএমএস,ফেসবুক সর্বত্র নানা কিসিমের বাক্যবিন্যাস। পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই পদে পদে । বান্ধবীর hate লেখা দেখে ভাবি,আমি কি এতটাই ঘৃণ্য ? অ্যানালগ মন বুঝতে পারেনা ওটা হলো ‘হাতে। ’ এভাবেই ক্রমাগত শিখে চলছি ইঁদুর (মাউস) যুগের সংক্ষিপ্ত বাংলাভাষা।
ফেসবুক এসবের কারখানা। বলতে পারেন ডিঁপো। সংক্ষিপ্ত করণের ছড়াছড়িটা এখানে বিচিত্র। এই দুনিয়ায় হাতে খড়ির সময় ‘o.m.g' লেখা দেখে মনে করতাম-‘ও মাগো। ’ কিন্তু আদতে সেটা ‘ও মাই গড !’ সংক্ষেপে লেখার ইঁদুর মারা কল যে কি সাংঘাতিক,তা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
হাঁটুর বয়সী এক মেয়ে সেদিন ক্ষুদে বার্তায় লিখেছে,‘ আঙ্কেল এই নিয়ে চারটে টেক্সট দিলাম,বাট এখনো তুমি আমাকে রেপ করলে না !’ চোখ কচলে বাক্যটি বারবার পড়ি। তবুও তল পাইনা । রাতে খোপে ফিরে পেরে স্টার জলসায় নেশাগ্রস্ত গিন্নিকে জিজ্ঞেস করি-ময়না পাখি এটার অর্থ কি ? আমার ময়না পাখি সুকুমার রায়ের দ্রিঘাংচুর মতো কটাক্ষ হেনে বললো-‘আরে গাধা, ইংরেজি হরফে ‘Rep' হলো Reply-এর সংক্ষিপ্তকরণ। ’
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো তখন। মনে মনে বললাম-মা,আমাকে বরং ‘Ans' করতে বলো।
কত সংক্ষেপে লেখা যায়,তার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ই-ভাষায়। শুধু ‘U' অক্ষরটি লিখে দিলে বুঝে নিতে হয় ওটা আসলে ‘You'। এই রীতিতে লিখতে থাকলে শহীদুল্লাহ-সুনীতিকুমারা যে ফের জন্মানোর দরখাস্ত দেবে ! তারচেয়ে বরং একটা নমুনা পেশ করি-‘o-p-c-a-d-k-e-s-o ' । মাথায় কিছু ঢুকলো ? বাংলা বলছেন ভেবে ইংরেজি হরফগুলো উচ্চারণ করুন,দেখুন কানে মধুবর্ষন করবে হালফিলের এই ই-ভাষা ‘ও পিসি এদিকে এসো। ’
মুসলানদের মক্কা,হিন্দুদের কাশী,খ্রিস্টানদ্বানদের বেথেলহেমের মতো ই-ভাষার তীর্থস্থান ফেসবুক।
মার্ক জুকারবার্গের এই আজব দুনিয়া রীতিমতো ভাষা সংক্ষিপ্ত করণের গবেষনা কেন্দ্র। খ্যাতনামা ব্যক্তিদের পয়দা-বার্ষিকী কিংবা অন্তর্ধান বার্ষিকী এলেই খেল খতম ! বিশেষ করে মৃত্যু বার্ষিকীতে। খালি কমেন্ট আসবে ‘RIP' । বিপ বিপ ধ্বনির মতো এই এই ‘রিপে’র অর্থ ‘Rest in Peach' । শান্তিতে থাকার কি অশান্তিকর প্রার্থনা প্রয়াস।
শুধু কি ভাষার জটিলতা ? ফেসবুকিয়ানরা এক জিনিষ বটে ! কেউ লাইক বিশেষজ্ঞ। এরা হরফ খরচ না করে পাইকারি হারে লাইক মেরে যায়। এমনকি প্রিয় বন্ধুর বাবার মৃত্যুসংবাদের লাইক পড়ে দু-চারটে ! আরেক ধরনের ফেসবুকিয়ান আছেন,যারা পরিসংখ্যানে কাজী মোতাহার হোসেনকেও হার মানাবে। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর হেঁচকি তোলার মতো তারা স্ট্যাটাস দেন-‘বড্ড মাথা ধরেছে। ’ উফ, কি দিলো !’ কে দিলেন,কাকে দিলেন,কেনইবা দিলেন-তা কেউ জানতে চায়না।
তবু তিনি স্ট্যাটাস দিয়ে যান।
ই-রাজ্যের আরেক বাসিন্দার নাম ট্যাগনেশিয়ান। যাকে খুশি তাকে স্টাইলে ব্যক্তিগত ছবিতে এরা সবাইকে ‘ট্যাগ’ করে থাকেন। তিনি বুঝতেও চান না যে,তার বাথরুমের জন্য কেনা নতুন মগের ছবি নিয়ে অন্যেরা কি করবেন !
ট্যাগনেশিয়ানদের এক কাঠি ওপরে কমেন্টেশিয়ান। যেখানে-সেখানে কমেন্ট মেরে বেড়ানোই তাদের কাজ।
হয়তো দুই শিল্পি বন্ধু একটি বিমুর্ত ছবি নিয়ে কথা বলছেন,সেখানে কাবাবের মাঝে হাড্ডি হয়ে দুঁদে কমেন্টেশিয়ান লিখবেন-থ্যাঙ্ক ইউ ! এই অপ্রাসঙ্গিক ধন্যবাদের হেতু এবং উপযোগিতা শুধু বিধাতা এবং তার সৃষ্ট ওই কমেন্টেশিয়ানই জানেন।
পিদিমের মতো ই-দুনিয়ার দরজায় যারা করাঘাত করছেন,তারা জানেন না কি বিচিত্র,এই দেশ। এখানে কারো ঘর ভাঙ্গে,কেউ ঘর বাঁধে। উৎফুল্ল হয় নানা ধরনের গ্র“প। সেই গ্র“পের সদস্যরা গেট টুগেদার করে।
এতে ক্ষুধা না মিটলে লিভ টুগেদারও বাদ পড়েনা ( একটু বেশি হয়ে গেল কি ? )। তারপর বদহজম হলে চোখে সর্ষেফুল দেখে। মান বাঁচাতে তথাকথিত ফ্রেন্ডশিপকে তারা কিছুদিন এড়িয়ে চলে । কিন্তু আফিম খোঁরের মতো একসময় তারা ফিরেও আসে। শহীদুল্লাহ হলের সামনে প্রায়ই দেখতাম রাণীক্ষেত রোগে ভোগা মুরগীর মতো ঝিম মেরে দম দিচ্ছে সেইসব আফিমখোর।
ছিলিমে চুমুক দেয়ার আগে তারা যেমন রোজকার অভ্যাস মেনে প্রতিজ্ঞা করে-‘এটাই শেষ বার। ’ ই-দুনিয়াতে এমন প্রতিজ্ঞার জন্ম হয় হাজারবার।
তবে,ফেসবুকিয়ানদের মতো দেয়ালের চিকা মারা পোষ্টারেও সরস মন্তব্য করার লোভ ছাড়েনা রসিকজন। একদিন রাতে কালাভুনার খোঁজে ক্যাম্পাস ছেড়ে চাঁনখার পুলের পানে হাঁটছি। সোডিয়ামের আলোয় দেখলাম রোকেয়া হলের দেয়ালে লেখা,‘জাগো বাঙ্গালী জাগো।
’ ঠিক তার নিচেই কে যেন লিখেছে-‘আহঃ কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাবেন না। ’
দেয়ালের ওই চিকাগুলোর জন্ম ছাপাখানায়। সেখানে এক ভূত বাস করে। অদম ভূত। যার কাজ মাঝেমধ্যেই মুদ্রন বিপর্যয় ঘটানো।
সেই উমদা গপ্পটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই-খবরের কাগজে ছাপা হলো, ‘পুলিশের গুলি খেয়ে দুই বকের মৃত্যু। ’ বলা বাহুল্য ওটা আসলে গুলি খেয়ে যুবকের মৃত্যু। পরের দিন খবরটির সংশোধনীতে ছাপা হলো-ওটা ‘পাছার’ ভুল ছিল !
যন্ত্রের মতো মানুষও ভুল করে। আমিও করেছিলাম শৈশবে। পাশের বাড়ির ক-অক্ষর গোমাংস ফুপু একদিন আমায় বললো,‘ওরে গেঁদা,আমার উনির কাছে এটা চিটি লেহে দিবি?’ আমি তখন শালিক মারার ফাঁদ বানাতে শতব্যস্ত।
সে বলে চললো,আর আমি লিখে চললাম বিরাম চিহ ছাড়াই ! - ‘আমাদের মেনি বেড়ালটি বমি করেছে শশুরমশাইয়ের মুখে, ঘা হয়েছে পেঁপে গাছের, মগডালে মধুর চাক হয়েছে, শাশুড়িমায়ের কোমরে, ব্যথাটা বেড়েছে খোকার, একটি খেলনা এনে দিও ভুলো কুকুরের জন্য, আর তো পারা যায় না তোমার জন্য, মন খারাপ করে না, চিন্তা করো, না আমি পথ চেয়ে, আছি ভাল, থেকো চিঠি, ইতি আমি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।