সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...
শ্রীমঙ্গলের কথা উঠলেই মনের কোণে উখি দেয় বর্ণময় শিল্পকলা সমৃদ্ধ আদিবাসী মণিপুরী সম্প্রদায় কিংবা সবুজ তাবুর মত গোটা উপজেলাকে ঘিরে রাখা চা বাগানের কথা। কিন্তু না আর একটি জীব বৈচিত্রে পরিপূর্ণ প্রকৃতি লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
একবার গেলেই মনে হবে বার বার সেখানে যাই। সবুজ শ্যামল ভরপুর অরণ্যের আচ্ছাদিত, গাছ পালা, বন্যপ্রাণী, নানা প্রজাতির পাখি ও পাহাড়ী ঝর্ণার কল কল ধ্বনিতে মুখরিত মনোমুগ্ধকর সবুজ পরিবেশ সমৃদ্ধ আকর্ষনীয় স্থান কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়ক হয়ে মাত্র ৬ কিঃমিঃ এগিয়ে গেলেই দেখা মিলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের।
শুরুতেই রাস্তার পাশে চোখে পড়বে সিলেট বিভাগের বৃহত্তম ঔষধি বৃরে বাগান ভেষজ “আরোগ্য কুঞ্জ”, ফুলবাড়ী চা বাগান, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি ও সেই বহুল আলোচিত মাগুরছড়া গ্যাস ক্ষেত্র। এসব দেখতে দেখতে আপনি এক সময় পৌছে যাবেন লাউয়াছড়া উদ্যানের মূল প্রবেশ দ্বারে। শ্রীমঙ্গল- কমলগঞ্জ সড়কের ডানদিকের সরু মেটো পথ ধরে উত্তরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে লাউয়াছড়া মূল অঙ্গন বন বিট কার্যালয়, রেষ্ট হাউস ও দেশের একমাত্র বন গবেষনা কেন্দ্র। বিশ্বের অগনিত বিনোদন প্রিয়, গবেষক ও পর্যটকদের সু-পরিচিতি শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় আরও রয়েছে উচু নিচু পাহাড়ি টিলায় প্রচুর পরিমাণ চা, আনারস ও কাগজি লেবুর বাগান।
খাসিয়া, মণিপুরী ও পাহাড়ী ললনাদের নানা সংস্ড়্গৃতি দেখতে ও জানতে হলে ভ্রমনপিপাসুদের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে যেতেই হবে।
ব্যস্ত জীবনের প্রতিটি মানুষের বিনোদনের অভাব মেটাতে এই স্থান অন্যতম। চা বাগানের নারী শ্রমিকদের কচি পাতা উত্তোলনের দৃশ্য আর দিগন্ত রেখায় বিস্তৃত চা বাগানে বন্ধু বান্ধবী সহ ঘুরতে এলেই মনে হবে এ যেন এক অচেনা জগৎ। এখানে রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানায় নানা প্রজাতির বিরল পশু পাখি।
দেশে ট্রপিকেল রেইন ফরেষ্ট খ্যাত এ পার্কটি বিনোদনের আকর্ষনীয় স্পটে পরিণত হয়েছে। এছাড়া প্রসিদ্ধ পিকনিক স্পট শ্যামলিতে রয়েছে উঁচুনিচু পাহাড় ও ঝর্না ধারায় পরিপূর্ণ।
মৌলভীবাজার জেলার প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যে হßদয় ও মন বুলানো এ পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে। অজস্র ভ্রমন পিপাসুরা আনন্দভ্রমন কিংবা শিা সফরে ছুটে আসছেন এই পার্কে। মৌলভীবাজার ফরেষ্ট রেঞ্জের আওতাধীন ভানুগাছের পশ্চিম পাহাড়ে অবস্থিত এই ন্যাশনাল পার্ক শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য তাই নয়, দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে নান্দনিক ও আকর্ষনীয় স্থান।
১৯২৫ সালে ১২৫০ হেক্টর সমতল ও টিলা ভূমি দ্বারা পরিভৃত জায়গা জুড়ে বনটি তৈরি করেছিল বিট্রিশরা। প্রায় ৮০ বছর আগে আনুষ্ঠানিক তৈরি করা এই বনটি এক সময় বাগানে পরিণত হয়ে যায়।
বিট্রিশদের রোপিত গাছের পাশাপাশি গজে উঠা বিভিন্ন ধরণের গাছ গাছালির সমন্বয়ে বনটি এখন পরিণত হয়েছে ঘন অরণ্যে। বনের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলেছে ঢাকা-সিলেট-চট্রগ্রাম রেলপথ এবং শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়ক পথ। জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই পার্কে দেখা মিলে বিভিন্ন ধরণের বিরল প্রজাতির পশু পাখি।
দেশ বিদেশের পাখি প্রেমিকরা লাউয়াছড়ায় ছুটে আসেন পাখি দেখতে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ধীরে ধীরে দেশের শিক্ষা, গবেষনা, ইকো-ট্যুরিজমসহ ভ্রমন বিলাসীদের চিত্র বিনোদনের অন্যতম আকর্ষনীয় স্পটে পরিণত হয়ে উঠছে।
গভীর অরণ্য সমৃদ্ধ অদভুত এক পরিবেশে গড়ে উঠা লাউয়াছড়ায় রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষাদি। এর মধ্যে সেগুন, গর্জন, মেনজিয়াম, চাপালিশ, ডুমুর, কদম, জলপাই, চাউর বা বন সুপারি, বনোকলা, শ্যাওড়া, কৃষ্ণচুড়া, গামাই, ছাতিম, বন পেঁপে, মৃর্তিংঙ্গা, কাঁকরা, বাতা, বাজনা, বন রুই, ঝাওয়া, জগডুমুর, কাইমুলা, করই, আওয়াল, জাম, জাম্বুরা লটকন প্রভৃতি উল্ল্যেখযোগ্য। এই লাউয়াছড়ায় ছিল দনি এশিয়ার বিরল প্রজাতির বৃ কোরোফোর্ম। এই গাছটি দেখার জন্য ছুটে আসতেন পর্যটকরা।
কিন্তু ২০০৬ সালের শেষের দিকে ঝড়ে গাছটি উপড়ে পড়ে।
তবে বিরল বৃ কোরোফোর্মের আর একটি গাছের সন্ধান পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যা পর্যটকদের অত্যন্ত আর্কষন করে। তাছাড়া এই বনে ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং ২৪৬ প্রজাতির বৃ। এদের মধ্যে বিরল প্রজাতির উল্লুক, বানর, হনুমান, লজ্জাবতি বানর, ধনেশ, শ্যামা, অজগর, মেছু বাঘ ও হরিণ উল্লেখযোগ্য। এ বনের বিচিত্র পশুপাখি ও পোকামাকড়ের অদভুত এক ঝিঝি শব্দ, বানরের ভেংচি ও ভাল্লুকের গাছে গাছে ছুটাছুটির দৃশ্য পর্যটকদের মনে অনাবিল আনন্দে শিহরণ জাগিয়ে তুলে।
ঝিঝি পোকার একটানা শব্দ নৈর্সগিক পরিবেশের সৃষ্টি করে।
পাহাড়ী ঝর্ণার কল কল শব্দ, পাখির কিচির মিচির শব্দ মিলে এক অদভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই ফরেষ্ট মিউজিক শুনতে শুনতে পর্যটকরা হারিয়ে যান বনের গহিন অরণ্যে। রুপকথার গল্প কাহিনীর পরিবেশ সৃষ্টিকারী লাউয়াছড়ায় নারী পুরুষ, যুবক যুবতী ও ছাত্র ছাত্রীদের পদচারণায় বিনোদন পিপাষু ও সাহিত্যকদের নিয়ে যায় অজানা স্বপ্নপুরিতে। এ বনে রয়েছে তিনটি প্রকৃতিক ফুট টেইল বা পায়ে হাঁটা পথ।
এর মধ্যে একটি ৩ ঘন্টার, একটি ১ ঘন্টার ও একটি ৩০ মিনিটের পথ রয়েছে।
পর্যটকরা নিঃসর্গের ইকো-ট্যুর গাইডের সাহায্য নিয়ে প্রয়োজনীয় ফি পরিশোধ করে পার্কটি ঘুরে দেখতে পারেন। তবে ইচ্ছে করলে নিজেরাই দেখতে পারেন। এই পার্কে পর্যটকদের জন্য রয়েছে একটি ইনফরমেশন সেন্টার। এখান থেকে পর্যটনের যাবতীয় তথ্যাদি।
পার্কে রয়েছে ইকো-কটেজ, ইন্সপেকশন বাংলো, গোল ঘর, ফেন্সিব্রীজ টয়লেট প্রভৃতি। বন বিভাগের আওতায় হলেও ইউ এস এ আইডির অর্থায়নে বাংলাদেশ বন বিভাগ বন সংরণ ও জীব বৈচিত্র রার প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের নাম নিসর্গ। ২০০৩ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হলেও পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৬ সালের জানুয়ারী মাসে। এই লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কটির ২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী থেকে রক্ষণা-বেক্ষনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওয়ার্ল্ড লাইফ কে।
বনে যেতে পর্যটকদের সুবিধার জন্য পার্কের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে বিল বোর্ড ও নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড। যা আপনাকে সাহায্য করবে। এ ছাড়া লাউয়াছড়ার ভিতরে জীব বৈচিত্রের তথ্য জানার জন্য খোলা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র।
এখানে রতি গাইড বই বিক্রি হয় ১২৫ টাকায়। নানা জাতের ক্রেপ ও জীব বৈচিত্রের ছবি সম্বলিত ব্রোশিয়ার বাংলা ও ইংরেজি বই বিক্রি হয় ১৫ টাকা।
পোষ্ট কার্ড ও রঙ্গিন পোস্টার ১০ টাকা। নিসর্গের ক্যাপ ১০০ টাকা। এই সব বই ও ক্যাপের বিক্রিত টাকা নিসর্গ কো-ম্যানেজম্যান্ট কমিটির তহবিলে জমা হয়। লাউয়া ছড়া ওয়াল্ড লাইফ রানা বেণের দায়িত্ব নেয়ার পর পর্যটকদের ট্যাক পরিদর্শনের জন্য হাতির সংযোজন করেছে। একজনকে হাতির পিঠে চড়ে বন ঘুরতে হলে দিতে হবে ২৫ টাকা।
এই সব সুবিধার জন্য সব মিলিয়ে পর্যটক ও গবেষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কটি এক অনন্য সুযোগ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।