আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্ম-৬

আমি ঘুম পান করি

(শেষ কিস্তি) --------------------------------------------------------- হাসপাতালে মৃত্যুর অশুভ ছায়া মাড়াতে আমার বড় ভয় করে- তাইতো কতবার কত বড় প্রয়োজনেও হাসপাতালে যাইনি আর গেলেও দায়সারা গোছের দেখা-সাক্ষাৎ টাইপের কিছু একটা করে চলে এসেছি কোনভাবেই দায় এড়াতে না পেরে। আজাদের সাথে আমার কোন লুকোচুরির ব্যাপার নেই, তাই হয়তো নিজের অজান্তেই যাইনি। বাসায় নিজেকে আড়াল করে বসে থেকে অপরাধবোধে জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে গেছি। যেকোন ভাবেই হোক শান্তি পেতে চেয়েছি। মনে হয়েছে আমার মনের ভালবাসার নদীতেও বুঝিবা চর পড়ে গেছে।

তবুও যখন নিজেকে ঘৃণা করতে করতে একদিন একেবারে শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছি, তখন ঘর থেকে বের হয়েছি। এসে পৌঁচেছি হাসপাতালে। তারপর ধীর পায়ে, বুকে রাজ্যের কষ্ট আর সীমাহীন আত্মগ্লানি নিয়ে ওর কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। যোখন ভুতরে ঢুকতে যাব, তখনই কেন জানি এক চূড়ান্ত হীনমন্যতা আমাকে গ্রাস করে ফেলে। ভাবতে থাকি এতটা পরাজিত হয়ে ওর কাছে যাব! কিন্তু কিভাবে এতটা অসম্মান করবো ওর সাহসী স্বত্তাটিকে! আর ঢুকতে সাহস হয় না আমার।

বাইরে জানালা দিয়ে একনজর ওর দিয়ে তাকালাম আর তারপর হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতে থাকি। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকে একবুক আপরাধবোধ নিয়ে। কি যে হল বলতে পারি না, হাঁটতে হাঁটতেই কি মনে করে জানি কিনে ফেলি একটা সবুজ চারাগাছ। আর বাসায় এসে কি এক অলীক শক্তির বশে চারাটা বাড়ির পিছনে লাগাতে লাগাতে বুঝেতে পারলাম কেন আমি এই চারাগাছটা এইরকম সময়ে কিনলাম, আর আমাকে এখন কি করতে হবে। কিভাবে এই পৃথিবীর বুকে আজাদের ভালোবাসাটুকু ধরে রাখতে হবে তাও আমি বুঝে গেলাম।

এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে আমি হাসপাতালে যাই, কিন্তু অকে বাইরে থেকে দেখেই চলে আসি আর বাসায় ফিরি একটা নতুন চারা গাছ নিয়ে। এভাবে নিয়ম করে আমি কিনে গেলাম একের পরে এক চারাগাছ আর লাগিয়ে গেলাম যেখানেই সুযোগ হল সেখানেই। দায়িত্ব নিয়েই আমি এগুলোর যত্ন করতাম। এক অন্যরকম ভালোবাসা দিয়ে আমি গাছগুলোকে আমার হৃদয়ের সাথে বেঁধে নিলাম। এভাবে কেটে গেলো ছয়-ছয়টি মাস।

একদিন সকালে যখন ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে, আমি এসে দাঁড়ালাম আমার বারান্দাটাতে। চারাগাছগুলো কিছুটা বড় হয়েছে এরই মাঝে। সবুজ, সজীব পাতা ছড়িয়ে আছে সবগুলো থেকে। কালকে আজাদ মারা গেছে, পৃথিবীর নিকৃষ্ট সব মানুষগুলোর ঘৃণা নিজের বুকে নিয়ে। কিন্তু নিজের শুভ্র আর বর্ণিল ভালোবাসাটুকু দিয়ে গেছে সবার মাঝে।

ভোরের আলো আস্তে আস্তে দূর করে দেয় আকাশের লালরঙা আভাটা আর আমি আস্তে আস্তে নেমে যাই আমার লাগানো গাছগুলোর কাছে। আমি নিশ্চিত করেই জানি যে আজাদ আবার ফিরে এসেছে এই পৃথিবীর বুকে, ফিরে এসেছে তার নিজের মমতাময়ী মাটির ঘ্রাণ নিতে। আমি তাই তার জন্য প্রস্তুত করে রাখছি বেড়াবার অবসরে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য শীতল ছায়া। হয়তোবা প্রাণভরে তার ভালোবাসার পৃথিবী, তার একান্ত আপান দেশটি ঘুরে-ফিরে দেখবার পরে ক্লান্ত হয়ে এসে বসবে আমারই লাগানো কোন গাছের ছায়ার নিচে। আমার ভালোবাসায় বড় করা গাছগুলোতে সে হয়তবা খুঁজে পাবে আমাকে, আমার অতি ক্ষুদ্র ভালবাসাটুকুকে।

আমার ভালবাসা সময়ের সাথে সাথে মহাবৃক্ষ হয়ে জানিয়ে দিবে আমি তাকে ভুলিনি, আর কখনো ভুলতেও পারবো না। আমরা তার কথা মনে রাখবো, তার অসীম শুদ্ধ ভালবাসাটুকুকে ধারণ করবো আমাদের মাঝে, আর তাকে বাঁচিয়ে রাখব মহাবৃক্ষের ভালবাসার মাঝে। এই গাছগুলো তার স্মৃতি বুকে ধরে উঠে যাবে সুবিশাল আকাশের দিকে আর মেঘেদের সাথে মিতালি করে পৌঁছে দেবে তার ভালবাসার অশ্রুটুকু দেশ থেকে দেশে। আর আমি অপেক্ষা করে যার আজাদের জন্য, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা প্রখর রোদে। অপেক্ষা করে যাব সেই দিনের জন্য যখন গাছের নকশা কাটা সবুজ চাদরের নিচে সে আসবে তার ভালবাসাটুকু নিতে।

আমি সেইদিন তাকে বলবো, “ আমার হৃদয়ের সুপ্ত নদীটাতে আবার স্রোত এসেছে। হারানো ঊষ্ণ ভালবাসাটুকু আবার গতি পেয়েছে আর সবুজ গাছগুলো পাড় ঘেষে আরো বড় হয়ে নুয়ে পড়েছে স্বচ্ছ জলের উপরে, তাদের সুবিশাল শান্ত ছায়ার ডানা বিস্তৃত করে। এইখানে আমি আছি, চিরকাল তোর অপেক্ষায়, তুই শুধু একবারের জন্য এসে দেখে যা, আজাদ, শুধু একটিবার আয়”। (শেষ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।