প্রত্যুষ বেলাকার কথা।
সমুখের বেলাভূমি পূর্ণ হয়ে আছে
সুদর্শন যৌবনের ভিড়ে-
তোমার নোলকে স্বর্ণ আছে কিনা- ভেবে-
তাকালাম উত্তেজিত- তোমার নাকের দিকে
আমার সঙ্গে যাবে? বলবার পরও
কেউ বুঝলো না আমাকে।
---------------------ক্রিস্টোফার কলম্বাস
---------------------১৩ অক্টোবর ১৪৯২
ইওরোপের চোখে চোখ রেখে তাকালে আমেরিকা এক নতুন পৃথিবী, নিউ ওয়ার্ল্ড। উপকুলে পৌঁছে এক অনাস্বাদিত ভূমিতে পা রেখে বোহেমিয়ান কলম্বাসের চোখে যে অবাক বিস্ময় খেলা করেছিল, কয়েক শতাব্দীব্যাপী তা বিস্ময়ই রয়ে গেছে। আর আদি প্রশ্নটি শতকের পর শতক মানুষকে জিজ্ঞাসা করে গেছে- কুমারী মৃত্তিকায় কবে কিভাবে এসেছিল এই মানুষেরা?
আটলান্টিক আর মু'দের পুরাণ বলেছে পৃথিবীর হারানো মহাদেশ থেকে পাখির মতো উড়তে জানা কোমল মানুষেরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে নতুন পৃথিবীতে।
ইহুদিরা পুরাণ ঘেটে বের করেছে, এরা হলো ইজরাইলের এক হারিয়ে যাওয়া কৌম। বাইবেল পড়েছে মহা ফাঁপড়ে, ধর্ম-পুস্তকের কোথাও নতুন দুনিয়ার কথা উল্লেখ নেই। তাই বলে চার্চও মন্তব্যরহিত থাকলো না। বললো- এ হলো গার্ডেন অব ইডেন। এরপর এলো পৃথিবীর দিকে তাকাবার যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার এক নতুন পুরাণ।
নৃতাত্ত্বিকরা আমেরিকান আদিবাসীদের ধরে বেঁধে এনে চোখ কান আর কপাল বিশ্লেষণ করে রায় দিলেন এদের সাথে এশিয়ার মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর বড় মিল। আরও খুঁজে পেতে কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেলো- আরও বিস্ময়কর তথ্য। হোমো স্যাপিয়েন্স-পূর্ব মানবের কোনো অস্তিত্বই নেই সমগ্র আমেরিকায়। অর্থাৎ হয় এদিক দিয়ে না হয় ওদিক দিয়ে, হয় দশ হাজার বছর আগে না হয় ত্রিশ হাজার বছর আগে মানুষ অভিবাসন করেছিল। এই দুটি তথ্যের মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়ে তৈরি হলো আইস এজ থিওরি, পাওয়া গেল বেরিং প্রণালী।
বলা হলো, ইঁদুর, ষাঁড়, বাইসন আর ভেড়াদের পিছু পিছু সাইবেরিয়া হয়ে এশিয়ানরা আমেরিকায় পৌঁছেছে। মাড়িয়ে এসেছে বরফ যুগের তুন্দ্রা ছাওয়া বেরিং প্রণালী। সেও এগারো হাজার পাঁচশ বছর আগের কথা। বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। আমেরিকার লস এন্জেলসেই পাওয়া গেল ৪৭ হাজার বছর আগেকার প্রত্ননিদর্শন এবং মানুষের কঙ্কাল, টেক্সাসের লুইসভিলে ৩৭ হাজার বছর, কানাডার ইওকোন, পেরুর পিরেম্যাশাই সাইটগুলোতে ২৫-৩০ হাজার বছর আগেকার প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে।
তখন এই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিল- সাইবেরিয়া, বেরিং প্রণালী এবং আশেপাশের সাইটগুলোতে যেখানে মাত্র ১০-২০ হাজার বছর আগেকার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের এতো ভিতরে কি করে এত আগেকার প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেল? সত্যিই কি বেরিং প্রণালী পেরিয়ে এসেছিল এশিয়ান জাত ভাইরা?
এর উত্তর দিতে গিয়ে ঘেমে গেলেন আমেরিকান নৃবিজ্ঞানের বিবৃতিদাতা পণ্ডিতেরা। ভিন্ন মতাবলম্বী গবেষকদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলেন মিসডেটেড বলে। এমনি চলেছে গত সত্তর বছর। গোঁড়াদের ঠাঁট-বাটে বিপর্যস্ত ছিলেন হাগ, হেল্ফম্যান, বার্নো, বাডা, উইনকলে আর ম্যাকানিশের মত বিজ্ঞানীরা। ক্লোভিজ লেবেল পর্যন্ত সর্বোচ্চ খননের রূপরেখা স্থির করে গোঁড়ারা বলতে থাকলো- ১১,৫০০ বছর আগে বেরিং প্রণালী হয়েই এসেছিল- আদি আমেরিকানরা।
১৯৩০ সালে নিউ মেক্সিকোর ক্লোভিজে ১১০০০ বছরের পুরনো পাথরের তৈরি বর্শা পাওয়া যায়। একেই নতুন পৃথিবীতে মানব বসতির প্রাচীনতম নিদর্শন বলে কেতাবগুলো চিহ্নিত করে এসেছে।
কিন্তু গোঁড়াদের ক্লোভিজ লেবেল ঘেঁষা তত্ত্বকথায় কান না দিয়ে গত ২৬ বছর ধরে অ্যাবেলা'র মিডোক্রফ্ট রকশেল্টারে ভূমি থেকে ৪৩ ফুট ওপরে একটি দড়িতে ঝুলে রীতিমতো বিপজ্জনকভাবে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন পেনসিলভ্যানিয়ার মার্চিহাস্ট কলেজের প্রত্নবিদ জেমস অ্যাডোভাজিও। কেনটাকি য়্যুনিভার্সিটির টম ডিলেই ১৯৭৭ সাল থেকে প্রায় ২২ বছর চিলির মন্টে ভার্দোতে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন। অ্যাডোভাজিও তার খননে ১৭,০০০ বছরের পুরানো পাথরের হাতিয়ার, চুলা এবং পোড়ানো কয়লা পেলেন।
টম ডিলেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৫ মাইল ভিতরে একটি খাড়িতে কমপক্ষে ৩০ টি শিকারী ও সংগ্রহজীবি পরিবারের বসবাসের সাক্ষ্য হিসেবে প্রত্ন নিদর্শন খুঁজে পেলেন। গাছের ছালে তৈরী দড়ি যা ঘর তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতো, শিকারের জন্য পাথুরে হাতিয়ার, চুলা, উচ্ছিষ্ট খাদ্য ও ভেষজ উদ্ভিদ পাওয়া গেল। আবিষ্কার করা হলো বাণিজ্য লক্ষণ। ডিলেই রায় দিলেন, তথাকথিত আদি আমেরিকানদের বেরিং প্রণালী পেরুবার হাজার বছর আগেই এই বসতি ধ্বংস হয়ে গেছে জলোচ্ছ্বাসে।
তাতেও মন ভেজেনি ক্লোভিজ মাফিয়াদের।
নতুন তথ্যগুলোকে টয়লেটের কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে দিতে চাইলো তারা। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেল দ্রুত। এত বেশি উপকরণ পাওয়া গেল অ্যাডোভাজিও আর ডিলেইয়ের সমর্থনে যে- কমোডে ফ্লাশ টানবার অবস্থা আর রইলো না। দুই বছর ধরে নিমরাজি অবস্থা চলছিল টেক্সটঘেঁষা ক্লোভিজপন্থীদের। আর তখনই রীতিমতো বিস্ফোরণ ঘটালেন স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের প্রত্নতাত্ত্বিক ডগলাস অসলি এবং টেনেজি য়্যুনিভার্সিটির খুলি বিশারদ রিচার্ড জানত্স।
বেরিয়ে আসতে থাকলো স্পিরিপ কেভম্যান, কেনউইকম্যান, বাহল উওম্যান, স্প্রিং উওম্যান, ব্রাউন ভ্যালীম্যান, লারা ভার্মেলহা উওম্যান-দের বেমানান কাহিনীকথা। বেমানানদের নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা এবং পাথর ও হাড়ের প্রমাণ মোতাবেক ১১,৫০০ বছর আগে এলিস আইল্যান্ড এশিয়ানদের জন্য তার প্রবেশ পথ খোলার বহু আগেই আমেরিকা সত্যিকার অর্থে দক্ষিণ এশিয়ান, পশ্চিম এশিয়ান এবং ইওরোপীয়দের দ্বারা বহু নৃরঙের রঙধনু রূপে উদ্ভাসিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক লিফ এরিকসন এবং নৃতাত্ত্বিক ডেনিস স্টানফোর্ড একাত্মতা প্রকাশ করেন এই মতের সঙ্গে।
আমেরিকায় মানুষের অভিবাসন সম্পর্কে কেতাবি তত্ত্বগুলো বলে, উত্তর-পূর্ব এশিয়ার পথহারা যাযাবর গোষ্ঠীগুলো (যাদেরকে আমেরেন্ডু বলা হয়) সাইবেরিয়া থেকে বেরিং প্রণালী হয়ে কানাডায় প্রবেশ করে। পরবর্তীতে দক্ষিণ-পশ্চিম এমনকি পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়।
এই আমেরেন্ডুরাই আমেরিকার প্রাচীনতম নৃগোষ্ঠী।
এর বিপরীতে শক্ত খুঁটি গেড়ে দাঁড়ালেন করিৎকর্মা জানত্স এবং অসলি। কৃৎকৌশলের মাজেজা দেখিয়ে উৎখননকৃত খুলি থেকে বানিয়ে ফেললেন আদিম মানুষের প্রতিমূর্তি। দেখা গেল, এসব মানুষের শারীরিক গঠনের সাথে আমেরিন্ডুদের কোনো মিলই নেই। ১৯৮৯ সালে আইডাহো-র বাহল-এ প্রাপ্ত ১০,৬০০ বছরের পুরানো ১৯ বছরের বয়েসী এক বাহল তরুণীর কঙ্কাল পর্যালোচনা করে দেখা গেল তার দীঘল মাথা, প্রশস্ত নাক, সম্মুখবর্তী মুখ এবং সুঠাম চিবুক আমেরিণ্ডুদের বদলে জাপান কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অ্যাবোরজিনাল আইন্যুদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
একই রকম কথা বললো স্পিরিট কেভম্যান, কেনউইক ম্যান, স্প্রিং উওম্যান সহ অন্যান্য প্রতিমূর্তিগুলো। হয় ইওরোপ নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হতে চামড়ার নৌকায় সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা। পাথরের বর্শা ফলক, পলিশার, হাড়ের স্ক্রেপার ইত্যাদি হাতিয়ারগুলো কণ্ঠ মেলালো তাদের সাথে। প্রত্নতাত্ত্বিক ব্রুস ব্রাডলি এবং ডেভিড মেলত্জার এই প্রত্ন নিদর্শন বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিলেন, এগুলোর সাথে ফ্রান্স এবং স্পেনের সোল্যুটেরিয়ান সংস্কৃতির নিদর্শনগুলোর বিস্ময়কর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বোঝা গেল সোল্যুটেরিয়ান সংস্কৃতির লোকেরা এই বেমানানদের ইষ্টিকুটুম।
এই তথ্যকে আরো জোরদার করলো নিউ ওয়ার্ল্ড জুড়ে থাকা প্রত্নস্থলগুলো। ব্রাডলি বললেন, আমেরিকার প্রাচীনতম হাতিয়ারগুলো পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাইটগুলো। অথচ বেরিং প্রণালী হয়ে এই অভিবাসীরা আমেরিকায় এলে প্রাচীনতম হাতিয়ারগুলো পাওয়া যেত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সাইটগুলোতেই।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ। বললেন, যেভাবে চল্লিশ হাজার বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরা নৌকা করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছিল মহাসাগর পাড়ি দিয়ে, তেমনি করেই ফ্রান্স, স্পেনসহ ইওরোপের অন্যান্য দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে চামড়ার নৌকা করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল স্পিরিট কেভম্যান-রা।
সীল এবং অভিবাসী পাখিদের পশ্চিমের দিকে যেতে দেখে ইংল্যান্ড থেকে নোভাস্কোটিয়া পর্যন্ত জমা হওয়া বরফের চাঁই পেরিয়ে নৌকা ভিড়িয়েছিল আটলান্টিকের ওপারে সেই সব আদিম মানুষেরা। কিন্তু আজকের বিচরণশীল মানবগোষ্ঠীগুলোর মাঝে এইসব মানুষের উত্তর প্রজন্মের কোনো চিহ্নই দেখা যায় না। উত্তরকালের বেরিং প্রণালী হয়ে আসা নৃগোষ্ঠীগুলোর সাথে জাতিগত সংঘর্ষ এবং পরবর্তীকালে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানে নিঃশেষ হয়ে গেছে স্পিরিট কেভম্যান, বাহল উওম্যান-দের নৃগোষ্ঠীগুলো।
পুরাতন কেতাবগুলোর ফার্স্ট আমেরিকান অধ্যায়টি এখন নতুন করে লিখতে হচ্ছে। এখানে এমন এক আমেরিকার কথা বলা হচ্ছে যেটি মে ফ্লাওয়ার, সান্তা মারিয়া কিংবা ভাইকিং শিপের বহু আগেই এই জাদুকরী আনকা মহাদেশের দিকে হাত বাড়িয়ে ডেকেছিল বাইরের পৃথিবীর মানুষকে।
আখেরে লাভ হলো আমেরিকান বহুজাতি তত্ত্বের প্রচারকদের। যারা মাত্র দুই তিনশ বছর আগে উপনিবেশ বানিয়েছিল আমেরিকাকে, প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে আমেরিকার আদিবাসীদের, যাদের সার্বভৌমত্ব আজ হুমকির মুখে। তাই বলে এই আবিষ্কার কোনো ভাবেই স্মরণকালের ভয়াবহতম এই ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন করে না, বরং নানা জাতির এক রঙধনু মিলনের ঝলক তোলে তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।
(১৯৯৯ সালের ৪ জুলাই এই লেখা যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন তা মিথিক্যাল ফারজানা-কে উৎসর্গ করা হয়েছিল। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।