কত অজানারে!
কাকুর কাছে শুনেছি সিভিক সেন্স নামের একটা ব্যাপার নাকি আছে! কিন্তু এই স্টেশনের কুলি মজুরদের তা শেখাতে যাবে কে? ধ্যাত! বসে আছি রেল লাইনের উপর। যশোর রেল স্টেশন। অবশ্য এখানে নাম লেখা যশোহর স্টেশন!! ছোট কাকু বলে এই স্টেশন নাকি ইংরেজ আমলে বানানো। সে সময় নাকি যশোর বাবান ছিল যশোহর! সেই নামটা আর চেঞ্জ করা হয়নি। এই যে অব্যবহৃত লাইন গুলা।
এই গুলোর নাম নাকি ব্রড গেজ লাইন। কারন দু লাইনের মাঝে অনেক ফাঁকা। তাই এই নাম। লাইনের পাত গুল অনেক চিকন! কাকু বলে এই লাইন গূলোও নাকি মোটা ছিল। প্রায় দুই তিনশ বছর বয়স তো! তাই ক্ষয় হয়ে চিকন হয়ে গেছে।
একে বারে নাকি আমার মত!! কিন্তু আমি চিকন হলেও আমার বয়স তো দুই তিনশ বছর না! কাকু যে কি বোকা!
তবে ভর দুপুরে স্টেশনে এসে রেল লাইনের উপর বসে থাকা কাকুই আমাকে শিখিয়েছে। খুব, খুব ভাল লাগে আমার! লাইনে কান পাতলে যান্ত্রিক এক ধরনে শব্দ শোনা যায়। পুর লাইনটাইতো জোড়া লাগানো! তাই। ট্রেন কাছে চলে আসলে, তখন আর কান পাততে হয় না। শুধু বসে থাকলেই বুঝা যায়!! তখন সরে প্লাট ফর্মে ঊঠে যাবার নিয়ম! অবশ্য আমার ভাল লাগে ওভার ব্রীজটার উপরে গিয়ে দাড়াতে।
ট্রেন টা হুসস করে এসে , ক্যাচ ক্যাচ করে ব্রেক করে থামে ওভার ব্রীজের নিচে। দারুন ব্যাপার!!!
আজ এখনো ট্রেন আসার সময় হয়নি। কান পেতে দেখেছি!! ট্রেন অনেক দূরে। ডান দিক থেকে নাকি বাম দিক থেকে আসবে বুঝতে পারছিনা। আমার সামনেই প্লাটফর্মের কাছে কিছুটা পানি বেধে রয়েছে।
শুকনার মধ্যে একটা জলের দ্বীপের মত!! গতকাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছেতো, তাই। মজার বিষয় হল, পানির মধ্যে একটা ছোট্ট মাছ ছুটো ছুটি করছে!!! দ্বীপের এক মাত্র অধিবাসী সে। আস পাশের কোন ডোবা নালা থেকে উঠে এসেছে হয়তো। গতরাতের বৃষ্টির স্রোতের সাথে। এটাকে আমরা বলি তিন চোখ মাছ।
মাথার কাছে একটা চকচকে সাদা দাগ আছে। দেখে চোখের মত লাগে!! কুলি মজুরদের উপর রাগ হচ্ছে। কারন তারা একটু দুরেই এক জায়গায় পেসাব করে যাচ্ছে!! একের পর এক এসে এসে। যদিও স্টেশনের ঐ দিকেই বড় বড় করে লেখা আছে ‘পাবলিক টয়লেট’!! এরা কি পড়তে পারেনা নাকি?!! পেসাবের একটা সুক্ষ ধারা আবার এগিয়ে আসছে এই মৎস দ্বীপের দিকে!! বেচারা মাছ! এমনিতেই যেই রোদ! দুয়েক ঘন্টার মধ্যেই দ্বীপের সব পানি শুকিয়ে মারা যাবে সে!! তার আগে আবার এই মুত্র স্নানও করে নিতে হবে দেখছি!!!
এমনিতে খালি হাতেই স্টেশনে আসি আমি। আজ হাতে একটা কাগজ।
আসলে একটা চিঠি! আমার বন্ধুর। দীনবন্ধুর। ‘দীনবন্ধু’ নামটা কি সুন্দর!! কিন্তু তার এই নাম নিয়ে আমার যে কি লজ্জা!! আমি যে একটু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী টাইপ, সেটা সবাই জানে। তাই কেউ মিশেনা আমার সাথে। খালি দীনবন্ধু ছাড়া! একদিন স্কুলের পড়া লিখে আনতে পারিনি।
তাই আম্মু আর সুপ্রিয়া দি (যে আমাকে পড়ায়) তাচ্ছিল্ল করে বলে “তোর সাথে তো কেউ মিশে না! কোন বন্ধু নাই। এখন কার কাছ থেকে পড়া জেনে নিবি?” আমি বলি, “না না! আছে তো এক জন। ” ...“শুধুই একজন! নাম কি তার?”... “তার নাম দীনবন্ধু!!” শুনে আম্মু আর দিদিমনির সে কি হাসি!!! পরে যখন ‘দীনবন্ধু’ শব্দের অর্থ জানলাম, খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। আসলে দীনবন্ধু ছাড়া আর কিছু জোটেনি আমার!
এমনিতে ক্লাসের শেষ বেবেঞ্চে বসে থাকি সারাক্ষন। এক দিন দেখি আমার বেঞ্চে, নিজে থেকেই এক জন এসে বসেছে!! সাদা জুতাটা লালচে হয়ে গেছে, পানির পটটা মনে হয় ছিদ্র হয়ে গেছিল, কলম গলিয়ে ফুটো বন্ধ করা হয়েছে, জামাটাও মলিন, কিন্তু মুখে একটা অমলিন হাসি!! এই হল দীনবন্ধু।
ওর বাবার একটা ছোট্ট খাবার হোটেল আছে। স্টেশনের ধারেই। এই সব বড়লোক ছেলেমেয়েরা ওর সাথেও মিশেনা! তাই ও একেবারে আমার মতই! আমার একমাত্র বন্ধু সে। আমি তাকে হারাতে চাইনা কোন মতেই। তাই বাসা থেকে আসার পর জুতায় ইট ঘসে একটু লালচে করে নেই।
স্কুলের দেয়ালে পিঠ ঘসে জামাটাকেও মলিন করে রাখি তার মত। টাই এর কোনা ছিড়ে রাখি। আরো অনেক প্রচেষ্টা!
একদিন। যে রিক্সাওয়ালা আমাকে স্কুলে আনা নেওয়া করে। সেই ইয়াসীন ভাই আসেনি ছুটির সময়।
দীন বন্ধুর বাবা সাইকেলে করে তার ছেলের সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসার দিকে। দুঃখ করছিলেন, স্কুলের ফি টি নিয়ে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার বাবা কি করে? বাবার রাস ভারি পোস্টের নাম আমার মনে থাকেনা ঠিক মত। বলেছিলাম, “ফুড অফিসে চাকরী করে। ” তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন “বুঝলে, এই স্কুল আসলে আমাদের মত গরীব মানুষ দের জন্য না!” আমি মাথা নেড়েছিলাম, নীরবে।
তিনিতো তা দেখতেই পাননি! কারন আমিতো তখন পিছনে বসা!!
সেই, দীনবন্ধুর চিঠি আমার হাতে। কিছুদিন ধরেই নাকি, কি একটা সমস্যা হচ্ছিল ওদের! স্টেশনের কাছেই ওদের বাড়ি। কিছু লোক হুমকি ধামকি দিচ্ছে সব ছেড়ে দেবার জন্য। দীনবন্ধুর বাবা রাগে অন্ধের মত হয়ে গেছেন। এই সেদিন ই।
কিছু বদমাশ এসে বলে, “আরে দাদা!! ক্যান যে এইখানে পড়ে আছেন?! উপার যান গা! ওইটাই তো আপনাগো আসল দেশ। ”...“আসল দেশ মানে!! আমি নিজ হাতে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করছি এই দেশে জন্য। আমার নিজের ছোট ভাই মারা গেছে যুদ্ধে! আর তোমরা কউ এডা আমার দেশ না!! দেশ চিনাইতে আসছো। সব শালারে ধরে...” প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। এসময় বড় মেয়েটা ডাক দেয় দরজার পাশ থেকে।
ভিতরে যাবার পর কাকিমা চোখ বড় বড় করে গুমোট স্বরে বলেন “কি করেন আপনে!! এদের সাথে লাগতে যাইয়েন না। চলেন আমরা আমার পিসিদের কাছে চলে যাই। ওপার!! আমাদের বড় মেয়ে আছে!! তাদের কথাও তো ভাবতে হবে! নাকি? আপনি এখন অত রাগারাগি কইরেন না!” এসব শুনে রাগ আরো চড়ে যায় মাথায়।
বসার ঘরে ফিরে যাবার পর। এক পশু বলে, “আপনার তো বড় মেয়েও আছে!” যেন দেখানর জন্যই জিভ দিয়ে ঠোটটা একটু চেটেনেয় সে! “তাদের কথাও ভাবেন।
কখন কি হয় যায়!! বলা যায় না। ” এতক্ষনের রাগটা যেন এখন রূপ নেয় তীব্র হতাশায়। জীবনের মায়া থাকলেতো যুদ্ধেই যেত না সে! কিন্তু মেয়েটা তার বড় স্নেহের। ওর কথা ভেবে অসহায় বোধ করে সে। হায়, ভগবান! কখনো যেন মেয়ে সন্তান না হয় কারো!!!
আগের রাত্রে কারা যেন দরজায় কয়লা দিয়ে লিখে গেছে ‘ভাগ মালাউন ভাগ!’ তাই গত রাত্রে সেই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যেই দীনবন্ধুরা চলে গেছে।
অল্প কিছু সহায় সম্বল সাথে নিয়ে। বেশির ভাগই রেখে যেতে হয়েছ। আমার জন্য এই চিঠিটা সহ।
পেসাবের ধারাটা মৎস দ্বীপের কয়েক বিঘেতের মধ্যে এসে এসেছে। আরেক জন জল ত্যাগ করলেই মিশে যাবে মৎস দ্বীপের পানির সাথে।
খুব চাইছিলাম মাছটা যেন আগেই মারা যায়। কিন্তু মুত্র স্নান দেখছি তাকে করতেই হবে। দ্বীনবন্ধুর বাবার মত। যে মারাগেলেই পারতো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে!! বিজয়ের এই গ্লানি আর সইতে হোত না তার!!
ট্রেন আসতে এখনো অনেক দেরী। ঐ যে আরেক জন এসে গেছে।
মাছটারো আর শেষ রক্ষা হবেনা দেখছি! লোকটাকে নিষেধ করতে সাহস হয়না আমার। শুধু দীনবন্ধুর চিঠিটা মাছটাকে দিয়ে চলে যাই। ও পড়ে জানুক। যে তার মত দুঃখি আরো অনেক আছে। আমাদের এই সোনার বাঙলাতেই।
বন্ধু, দীনবন্ধু আমার...
নোটসঃ- আমি হুমায়ুন আজাদ স্যারের মত সাহসী হলে লেখার শিরোনাম দিতাম “আসুন আমরাও দেশটার গায়ে মুতি!” যে দেশ আমাদের সেরা সন্তানদের প্রতি এরকম আচরন করে। অবশ্য দেশতো না! দেশের লোক। আবার লোক ছাড়া কি দেশ হয়? আসলে এসব আমার গুবলেট লেগে যায়। আর আমিতো আসলে কাপুরুষ শ্রেনীর লোক। যে কিনা ছোট্ট একটা মাছকেই রক্ষা করতে পারে না!! নামটা তাই “মৎস দ্বীপ”ই রইলো।
দেশটাতো এখন সেই মৎস দ্বীপের মতই।
বিদায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।