আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের এই ব্লগ দেখে যারা হাসাহাসি করে আসুন তাদের জন্য আমরা কাঁদি!!

মহল্লায় ঘুরি, মহল্লায় ফিরি

জেবতিক আরিফ ভাইয়ের একটা পোষ্টে মেহরাব শাহরিয়ার নামে এক ভদ্রলোক বললেন, ১। আরিফ ভাই এই রকম বাচ্চাদের মত পোষ্ট দিয়েন না। ২। তেনারা আমাদের এই ব্লগ দেখে তাদের তথাকথিত হাই সোসাইটিতে (বুয়েট কে আমি সেই রকমই মনে করি) হাসাহাসি করে। [ভূমিকা: ( হযবরল এর থেকে])।

ছোট্ট একটা ভূমিকা দিয়ে শুরু করি। আমাদের দেশে চাকরী-বাকরী এবং পর্যায়ক্রমে সামাজিক স্ট্যাটাসের প্রতিভূ হয়ে গিয়েছে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার। এই দুটো পেশার প্রতি এতো তীব্র অনুরাগ আমাদের সমাজে তৈরি হয়েছে যেটা এক ধরণের অবসেশনের পর্যায়ে পড়ে। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউট হচ্ছে মেডিক্যাল গুলো এবং বুয়েট। আমাদের সমাজের এই তীব্র একমুখীতা এবং অবসেশন এমন একটা পর্যায়ে যে ছেলে-মেয়ে বুয়েট/কিংবা মেডিক্যালে ভর্তি হলে বাবা-মা গর্বের চেয়েও অহংকারে ভোগেন বেশী।

সামাজিক মর্যাদায় উঁচু পিঁড়ি আসীন হবার আনন্দই তাদের বেশী হয়। এটা একটা কমন ফেনোমেনন, '' আমার ছেলে বুয়েটে পড়ে''। আমাদের দেশে জ্ঞান আহরণ কিংবা কোন বিষয় ভালবেসে পড়ার চাইতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটা কিছুর পিছনে ছোটাটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কোন বিষয়ে পড়ে সেটার চেয়ে, বুয়েট কিম্বা মেডিকেল পড়ে সেটা মূখ্য হয়ে যায়। কেউ যাচ্ছে কর্ণেল এ বায়োসেন্সর নিয়ে গবেষণা করতে; কিন্তু তার পরিচিত মহলে একটা শ্রেণী সে আমেরিকা যাচ্ছে সেই খুশীতেই মাতোয়ারা থাকে; একটু অগ্রগামীরা সে কর্ণেলে যাচ্ছে সেটা নিয়ে মাতোয়ারা থাকে; এই হচ্ছে সুপারসমাজবদ্ধ কিম্বা সমাজারুদ্ধ মানুষের মানসিকতা।

আমার খুব মজার অভিজ্ঞতা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ তে। অডিটোরিয়ামে সিনেমা দেখানো হবে তাই গিয়েছি। টিকেটে দায়িত্বে থাকা এক বিবিএ'র ছাত্রের কাছে টিকেট চাইলাম। সে জবাব দিলো ইংরেজীতে। আবার আরেকটা প্রশ্ন, আবার জবাব দিলো ইংরেজীতে।

এটার কারণ সমাজ এবং ইনস্টিটিউট আরোপিত কিছু সুপারলেটিভনেস। আইবিএ বানাতে চায় কিছু দক্ষ ম্যানেজার, সুতরাং এটাই স্বাভাবিক। বুয়েটের ব্যাপারে যেটা বলছিলাম। একসময় দেশের একমাত্র প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে এতো বেশী সোসাইটি ভ্যালু র‌্যাপ আপ করেছে বুয়েট যে বাবা-মা, পরিজন থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের মানের চেয়েও, ইনস্টিটিউট গরিমায় ভোগে বেশী। সবার মাঝেই আমি কি গো হনুরে একটা ভাব আসে।

এটা মেডিক্যালের ছেলে-মেয়েদের আরেকটু বেশী হয়। এটা আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই একইরকম ভাবে সত্য। জিলা শহরের সবচেয়ে বড় সরকারী স্কুলে, সেরা কলেজ, কিম্বা বুয়েট/মেডিক্যাল/ঢাবি ভর্তি হওয়ার পর বাবা-মা সন্তানের সাফল্যে যতখানি আনন্দিত হন, তারচেয়েও বেশী হন লোকজনকে বড় মুখ করে বলতে পারবেন ছেলে-মেয়ে অমুকে পড়ে, তমুকে পড়ে। কথাটা খারাপ শোনায়, কিন্তু এটাই সত্যি। আমার বন্ধু ঢাবি জিওলজির ছাত্র ছিলো।

সে একদিন বলছিলো, সে জিওলজিতে ভর্তি হওয়ায় তার বাবা-মা ভীষণ হতাশ হয়েছিলো। হতাশার কারণ ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে না। সে কারণেই দেখেছি,'আমরা বুয়েট' এই ধরনের একটা মেমব্রেনে থাকার, অন্য সবার মাঝে নিজেকে একটু আলাদা ভাববার অভ্যাস বুয়েটিয়ানদের আছে। কিন্তু এটা সেসব ছেলে-মেয়েদের দোষ বলে আমি মনে করিনা। এটা হচ্ছে আমাদের সমাজের দানাবাঁধা এক ধরণের শ্রেনীবৈষম্যের ফল।

এটা ঠিক কারো ব্যক্তিগত অর্জন নয়। এখন কথা হল আসুন আমরা সবাই একটু একটু করে দেখি তাদের হাসাহাসিতে আমরা কেমনে শরিক হতে পারি। বা তাদের সেই বিজ্ঞ হাসি দেখে আমাদের মত যারা সাধারন তারা কিছু শানে-নযূল বাহির করতে পারি কি না। ১। দেশের বাহিরে পড়তে এসে অনেকের সাথেই নতুন করে পরিচয় হলেও একই কলেজের তিনজন কে পেয়ে ভালই কেটেছে।

তার মধ্যে একজন হল নাফিস। বুয়েটের সিভিল (৯৭) ইন্জিনিয়ার। আর একজন হল কবির (প্রাইভেট ইউনিভারসিটি)। নাফিস লেকহেড'কে খুব একটা পছন্দ না করায় অন্যান্য ইউনিভারসিটিতে এ্যাডমিশনের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। আমি আর নাফিস (নাফিস হল এমন একজন মানুষ যে ৫ ওয়াক্ত নামজের সব গুলোই মসজিদে গিয়ে জামাতে পরে।

মিথ্যা কথা কখনও বলে না। সবসময় টুপি মাথায় দিয়া চলাফেরা করে। ) একজায়গা থাকলেও নাফিস এইকথাটি আমাকে কখনই বলে নাই। আমাকে বলল কি না তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা হত না যদি না আমি আর নাফিস ১ বছরের বাসা ভাড়ার লিজ সাইন না করতাম। নাফিস চলে যাবার একদিন আগে আমাকে বলল যে, আমি চলে যাচ্ছি।

কথা শুনে আমার কি করা উচিত তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। নাফিস এখন আলবার্টাতে। যাবার আগে সে তার লেকহেডের প্রফেসরকে বলে গেছে সে উইনজরে যাইতাছে। নাফিস চলে যাবার পরে কপালগুনে পাইলাম আর এক ভাই মুমিন (বুয়েট '৯৬,ইলেকট্রিক্যাল)। ২।

গত বছরের এপ্রিল-মে এর দিকে, আমরা কয়েকজন বাংলাদশী যারা একই ইউনিভারসিটিতে পড়ি তারা সবাই মিলে কথা বলছি। এর মধ্যে আমি আর আরিফ ভাইয়ের অত্যন্ত কাছের একজন (যার নিকট থেকে আমি আরিফ ভাইয়ের কথা প্রথম শুনি) সাব্বির জুনে দেশে যাব তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। সব্বির হঠাৎ বলল, মুমিন ভাই (বুয়েট, ৯৬ ইলেকট্রিক্যাল) আপনি দেশে যাবেন না? মুমিন ভাই বলল, না। সাব্বির বলে আরে কি বলেন, আপনার আব্বা-আম্মারে দেখতে যাবেন না? মুমিন ভাই বলে, আব্বা আম্মাকে তো সেই ৩০ বছর ধইরা দেখতাছি, তাদের আবার নতুন করে দেখার কি আছে? আমরা কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। বলে কি এই এই জ্ঞানী স্কুলের বিদ্বান!! যে কারনে সাব্বিরকে সব সময় পছন্দ করি তারমধ্যে একটা হল, সব জায়গায় সব সময় সঠিক কথাটা ও বলতে পারে।

এরপর সাব্বির বলল, তাহলে দেশে কখন যাবেন? উততরে মুমিন ভাই বলল, বিয়ে যদি দেয় তাইলে দেশে যাব। সাব্বির আবার বলল, বউকে একাধারে ১০ বছর দেখার পরে কি করবেন? মুমিন ভাইয়ের আর কোন কথা নাই মুখে। ৩। সাব্বির কিছুদিন একবাসায় থাকত। তারমধ্যে একজন ছিল কিংকং (কিংকং সিনেমা দেখার পরে সাব্বির এরমতে তার নাম বলে এইটাই হওয়া দরকার ছিল)।

তিনিও বুয়েটের। তিনি আবার সাহিত্য চর্চা করতেন। বাসার সবাইকে নিয়ে সে দীক্ষা দিত বা দেবার চেষ্টা করত। সবার কাছে শুধু তার এইসব গল্প শুনতাম। মাগার সাব্বির থাকলে তার আর কোন চর্চাও নাই, দীক্ষাও নাই।

সবাইকে বলে বেড়াত তার বই, কবিতা নাকি হাবিব মহাজনের মত প্রকাশকরা এসে দাড়ায়ে থাকত নেবার জন্য। কিন্তু আমরা তার নাম কিংবা বই আজও পাইলাম খুজে। অন্য সবাইকে বলে সে নাকি ছদ্দ নামে লিখে। সেই ছদ্দ নামটাও আমাদের কখনও জানা হল না। এর মাঝে তিনি বললেন, আমি এইখান থেকে যাবগা অন্য ইউনিভারসিটিতে।

ভাল, কিন্তু কারন আর আমরা জানতে পারলাম না। কবির আর আমি একদিন ইউনিভারসিটি থেকে কিংকং কাছে ফোন করলাম। কবির'কে ফোনে চিনতে না পারায় কবির হয়ে গেল, গ্রাড ষ্টাডিজের অফিসার। কবির, আপনের তো টিউশন বাকী হাজার ডলার কিংকং, আমি তো প্রোগ্রাম থেকে আউট কবির, কেন? কং, ফেইল করছি এক কোর্সে, ফাঁকে আমরা জাইনা গেলাম গুরুর আসল রহস্য!! ৪। এক ঈদের পার্টিতে একজন প্রফেসরের (বুয়েটেরও প্রফেসর ছিলেন) ড্রেস-আপ গেট আপ দেইখ্যা সবাই তার লইয়াই কথা শুরু করল।

তার সেই স্যুট-কোটের সাথে চকচকা কেডস পরা অবস্থার কথা এখনও আমরা আলোচনা করি। এত বাজে রুচি মানুষের কেমনে হয় তাই জানতে পারলাম না। বন্ধুরা এখন মাঝে মাঝে বলে, আপনাকে আমার বাসায় দাওয়াত থাকল, শর্ত এই যে আপমাকে স্যুট-কোটের সাথে আপনাকে চকচকা কেডস পইরা আসতে হবে!!! ৫। মুমিন ভাই আমদের বাসায় আসার পরে আশেপাশে সবার সাথে পরিচয় হল। তিনি ছাড়া আর কেউ বুয়েটের না।

এইটা বুঝনের পরেই সে সবাইকে জ্ঞান দেবার শুরু করল। তখন বিষয়টা হল, পিয়াল ভাই এর বিয়ে নিয়ে বিপ্লব রহমানের পোষ্টের মত। মুমিন ভাই জীবনে কত স্কলারশীপ পাইছে, তার বন্ধুরা নোট নেবার জন্য কেমনে পিছন পিছন ঘুরত, কোথায় কোথায় খাওয়াইত, সে কত ভাল ছাত্র ছিল এই সব (মুমিন ভাই ১৩ তম তার ব্যাচে, বুয়েটে)। এর মধ্যে কবিরযে স্ট্যান্ড করা ১৩ তম ঢাকা বোর্ডে সেই কথা আর কেউ তারে কইলাম না, যতদিন ছিলাম মজা লইলাম। নোট: এইলেখাটি অবশ্যই বুয়েটকে ছোট করার জন্য নয়, এই লেখা তাদের জন্য যারা শুধু বুয়েট থেকে পড়তেই শিখেছে, সামাজিকতা, নৈতিকতা শিখেনি তাদের জন্য)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।