বিরাশি বছর বয়সে আমাদের 'নূরো স্যার' গত ২৫ আগস্ট নিজ বাসগৃহে মারা গেছেন। এ মৃত্যুর কারণ হয়তো বার্ধক্যজনিত। তবে স্যারের ডায়াবেটিস এবং হার্টের সমস্যাও ছিল। স্যারের পুরো নাম শেখ নূরুল হক। পিতা ডা. শেখ জহুরুল হক (জহুর ডাক্তার)। পাকিস্তান আমলে বাগেরহাট মহকুমার রামপাল থানা ছিল দেশের সম্ভবত সবচেয়ে অবহেলিত অঞ্চলগুলোর একটি। রামপাল একটি থানা হলেও থানা সদরে একটি মাত্র প্রাইমারি স্কুল ছিল, কোনো হাইস্কুল বা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। তেমন কোনো পাকা ইমারতও নয়। থানা এলাকায় মূল সড়কটিতে বড়জোর ৫০০ গজ লম্বা একটুখানি ইটের রাস্তা ছিল; বর্ষাকালে তাও থাকত কর্দমাক্ত। থানার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রামপাল নদী দিয়ে খুলনা-মংলা-বরিশাল রুটে বড় বড় তেলবাহী ট্যাঙ্কার এবং ছোটখাটো জাহাজ, লঞ্চ, নৌকা ইত্যাদি চলাচল করত। এই নদী পার হয়ে রামপাল বাজার এবং এই বাজার থেকে অন্তত আড়াই মাইল দূরে অবস্থিত ছিল পেড়িখালী উচ্চবিদ্যালয়। অপরদিকে থানা কেন্দ্র থেকে দাউদখালী নামে আর একটি বড় নদী পার হয়ে ৫-৬ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল গিলাতলা হাইস্কুল। থানা থেকে কোনো নদী পার না হয়ে প্রায় ৬-৭ মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফয়লাহাট হাইস্কুল। অন্যদিকে মংলা তখন ছিল রামপাল থানার অন্তর্ভুক্ত। অন্তত ১৫-২০ মাইল দূরে মংলায় অবস্থিত ছিল সেন্ট পলস হাইস্কুল। এ ছাড়াও আরও দূরে দূরে ডাকরা হাইস্কুল, ভূয়ারকান্দা হাইস্কুল ইত্যাদি দুই-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু ছিল। মোটাদাগে এই হলো স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত রামপাল থানার 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাপিং'। ১৯৬০ দশকের মধ্যভাগে নূরুল হক স্যার বিএ পাস করে গ্রামে আসেন। থানা সদর সংলগ্ন এই গ্রামটির নাম শ্রীফলতলা। থানা সদর থেকে স্যারের বাড়ি প্রায় দুই মাইল দূরে। পাকিস্তান আমলে বিএ পাস যে কোনো ব্যক্তি চাইলেই ব্যাংক বা সরকারের যে কোনো অফিসে একটা চাকরি খুঁজে নিতে পারতেন। রামপাল এলাকার মানুষ ছিলেন বেশ জমিজমাওয়ালা এবং এসব জমিতে প্রচুর ধান জন্মাত। কোনো পরিবারের শিক্ষিতজনেরা বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চাকরিতে যেতে তাদের আগ্রহ ছিল কম। আমার দুই চারজন আত্দীয়-স্বজনের ব্যাপারেও আমি এমনটাই দেখেছি। এ ধরনের ব্যক্তিরা তখন বাড়ি থেকে যাওয়া যায় এমন দূরত্বে স্কুলের শিক্ষকতার চাকরিকে সাধারণত বেছে নিতেন। স্যারের বাড়ি থেকে সহজে হেঁটে যাওয়া যায় এমন কোনো স্কুলও কাছাকাছি ছিল না। সম্ভবত এ কারণেই তিনি রামপাল থানা সংলগ্ন নিজ গ্রাম শ্রীফলতলাতেই তার বাড়ির সঙ্গে একটি জুনিয়র হাইস্কুল খুলে বসলেন। ৩-৪ বছরের মধ্যেই এটিকে হাইস্কুল করে ফেললেন। ১৯৬৭ এবং '৬৮ সালে এই স্কুলে সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার বাবার সঙ্গে পূর্ব পরিচিতির কারণেই স্যার একরকম জোর করেই আমাকে তার স্কুলে ভর্তি করান। আমরা যখন ছাত্র স্কুলটি তখন প্রতিষ্ঠার পর্যায়ে। স্যার নিজে হেডমাস্টার আর স্যারের বাবা জহুর ডাক্তার সাহেব স্কুল কমিটির সভাপতি। স্যার এখানে আরও কিছু শিক্ষক যেমন_ মোজাহার স্যার, শৈলেন স্যার, ইউনুস কাজী স্যার, মৌলভী (সাহেব আলী) স্যার (আরও অনেকের নাম এখন মনে নেই) প্রমুখকে সম্পৃক্ত করেন।
স্যারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানের প্রতি এবং ছাত্রদের প্রতি এসব শিক্ষকের যে কি রকম মমত্ববোধ এবং ডিভোশন আজো আমাদের তা মুগ্ধ করে। স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্নে যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া সহজ ছিল না। পাশর্্ববর্তী এলাকা এবং দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে স্যার এবং স্যারের বাবার শিক্ষার্থী জোগাড়ের যে তোড়জোড় তার বর্ণনা দেওয়া সত্যিই কঠিন। নূরো স্যারের বাড়ি ছিল স্কুলের সঙ্গেই। স্কুলে কোনো হোস্টেল ছিল না। বিশেষ করে বর্ষাকালে স্যারের কাচারিতে (এবং আরও ২-৩টা বসতঘর ছিল) একাধিক শিক্ষক এবং ছাত্রের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল অবারিত। শ্রীফলতলা গ্রামের প্রত্যেক সচ্ছল পরিবারে (অন্তত বর্ষাকালে) এক বা একাধিক শিক্ষার্থীর (যাদের বাড়ি ছিল অনেক দূরে) থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল অনেকটা বাধ্যতামূলক। নূরো স্যারের স্কুলের ছাত্র বিধায় 'সিজিনাল লজিং' হিসেবে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবার এক বা একাধিক ছাত্রকে তাদের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার জায়গা করে দিত। এলাকার মানুষের প্রতি স্যারের যে কী ধরনের কদর এবং প্রভাব ছিল তা না দেখলে বোঝা যাবে না। স্যারের পরিবার অন্যান্য অনেক পরিবারের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ধনী ছিলেন। এলাকায় একটি কথা প্রচলন ছিল_ 'দুই বাপ-বেটাকে স্কুল করার নেশায় পেয়ে বসেছে'। আসলেও ব্যাপারটি ছিল তাই। শ্রীফলতলা স্কুল (আজ যেখানে জ্ঞানমেলা অনুষ্ঠিত হয়) প্রতিষ্ঠা করার সময়ের দুই-একটি কাহিনী আজো আমাদের মনে গেঁথে আছে। জুনিয়র থেকে হাইস্কুলে উন্নীতকরণের সময় স্যার তথা ডা. জহুর পরিবার এক ধরনের অর্থ সংকটেই পড়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত নামমাত্র বেতন (যেসব ছাত্রকে অন্য এলাকা থেকে জোগাড় করে এনে ভর্তি করা হতো তারা অধিকাংশই ফ্রি বা নামমাত্র ফি দিয়ে পড়ত) দিয়ে স্কুলের পরিচালনা ব্যয় এবং শিক্ষকদের বেতন প্রদান সব সময় সম্ভব হতো না। এসবের দায়ভারও বহন করতেন স্যার এবং তার বাবা। অন্যদিকে বছরের প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষক-ছাত্র মিলিয়ে ১০-১২ জনের খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পরিবারের ওপর ভীষণ চাপ তৈরি হতো। কিন্তু স্যার এবং তার বাবা নাছোড়বান্ধা_ স্কুলকে হাইস্কুলে উন্নীত করতেই হবে। এ জন্য মহকুমা শিক্ষা অফিস, যশোর শিক্ষাবোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা এবং তদবির প্রয়োজন। আমরা স্কুলে একসময় শুনতে পেলাম স্যারকে তার বাবা কিছু টাকা দিয়েছেন এবং বাকি টাকা জোগাড়ের জন্য তার স্ত্রীর বিয়ের গয়না বন্ধক রেখে নূরো স্যার স্কুলে নবম ও দশম শ্রেণী খোলা এবং এসএসসি পরীক্ষার জন্য পারমিশন আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্যার আমাদের কখনো ইংরেজি, কখনো অঙ্ক আবার কখনো বা সমাজ পড়াতেন। এই স্কুলের শাসন ছিল বড়ই কঠিন। পড়া না করে এলে প্রত্যেক শিক্ষক বেত দিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটাতেন। আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য মনোনীত হই আমাদের তৈরি করতে দুই-তিন মাসের জন্য স্যার নিজেই কোচিং শুরু করেন। তার জন্য একটি পয়সাও তিনি দাবি করেননি। স্যার তার ছাত্রদের সবাইকে 'তুই' সম্বোধন করতেন। আমাকে এই মধুর সম্বোধনটি আর জীবনে কেউ করবে না_ এটা ভেবেই আমি আমার নূরো স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। স্যার কি মমতা দিয়ে আমাদের ভালোবাসতেন তা একটি ঘটনায় উপলব্ধি করেছিলাম। ২০১০ সাল। তখনো আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডস্যার (শেখ আবুল হাশেম), জুনিয়রের হেডস্যার (শেখ নূরুল হক) এবং হাইস্কুলের হেডস্যার (বাবু চিত্তরঞ্জন পাল) তিনজনই বেঁচে রয়েছেন। আমি মাঝে-মধ্যে আমার গ্রামে কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা দিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। ২০১০ সালের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক। এই অনুষ্ঠানে আমি আমার এই তিনজন স্যারকেও দাওয়াত দিয়েছিলাম। আমি উপাচার্যের সঙ্গে আমার স্যারদের একটু পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলাম এবং অনুষ্ঠানের একটি অংশে তাদেরও একটু সম্মানিত করার ব্যবস্থা রাখলাম। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। অন্যরা মঞ্চে আছেন। 'নূরো স্যার' তার বাড়ি থেকে ভ্যানে করে একটু দেরিতে এসে মঞ্চস্থলে পেঁৗছালেন। আমরা সবাই উপাচার্য, খুলনার তৎকালীন মেয়র, রামপাল-মংলার এমপি মঞ্চে উপবিষ্ট এরকম কিছু সুধীজনদের নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ একজন আমাকে বললেন 'নূরো স্যার' এসেছেন। আমি এগিয়ে গেলাম। স্যার ভ্যান থেকে নামছেন আর আমি শুনতে পাচ্ছি স্যার ক্লান্ত গলায় মানুষকে জিজ্ঞাসা করছেন 'আমার সালাম কই'? পরক্ষণে আমাকে সামনে দেখে স্যার বললেন, শুধু তোর জন্যই অসুস্থতা সত্ত্বেও আমাকে আসতে হলো, তুই ভালো আছিস? আমার এবং আমাদের প্রিয় 'নূরো স্যার' আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন। আমাদের আর কেউ 'তুই' সম্বোধন করবে না। আমার সালাম কই? আমার সেলিম কই? আমার মান্নান কই? এভাবে কেউ আর প্রাণ উজাড় করে আমাদের খুঁজবেও না। 'নূরো স্যার' আপনার চলে যাওয়ায় আমরা আজ ছায়াশূন্য হয়ে গেলাম। আমরা আপনার আত্দার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।