আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুম থার চিবাই (তাজিংডং-2)

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

বান্দরবান যাওয়ার জন্য নাইট কোচের ইঞ্জিনে বসে আমাকে খুব বেশিদূর যেতে হয়নি। বন্ধুরা পালাক্রমে আমাকে তাদের সিটে বসতে দিয়েছে। এভাবে সকাল বান্দরবান পৌছার পর চান্দের গাড়িতে করে আমরা রুমা থানা সদরে রওনা দিলাম। চান্দের গাড়ি মূলত এক ধরনের জিপ গাড়ি। বিভিন্নভাবে মডিফাই করে এগুলোর ছাদে, বাম্পারে, ভেতরে প্রচুল লোক আটানোর ব্যবস্থা করা হয়।

পাহাড়ি রাস্তাটা খুব সুন্দর ছিল। রুমা যাবার পথটা বেশ কিছু জায়গায় খুবই বিপদজনক। রাস্তার পাশেই হাজার ফিট খাদ। অবশ্য আমার উচ্চতা ভীতি নাই। তাই ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে চান্দের গাড়ির ছাদে আসন পেতে বসলাম ।

রুমার কাছাকাছি গিয়ে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। এখান থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের নৌকায় করে যেতে হবে। হোটেলের খাবার প্রচণ্ড ঝাল। স্থানীয় লোকদের ধারণা ঝাল খেলে ম্যালেরিয়া হয় না। এরপর একটা নৌকা ভাড়া করে অসম্ভব সুন্দর একটা পাহাড়ি নদী দিয়ে আমরা রওনা দিলাম।

পাহাড়ি নদীর পানি ঝকঝকে পরিষ্কার আর ঠাণ্ডা। পানির গভীরতা কম কিন্তু স্রোত বেশি। নদীর দুই পাশে পাহাড় এবং জঙ্গল। কোথাও আবার ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামও দেখা যায়। এ এলাকায় জনবসতি খুবই কম।

নদীর বালুচরে এবং আশপাশের গাছপালা ও পাহাড়ে প্রচুর পাখি দেখা যাচ্ছিলো। এর মধ্যে কয়েকটি দুর্লভ পাখিও দেখা গেল। নদীর পরিষ্কার পানিতে দুয়েকটা মাছও দেখা গেল। নদীর পাশের বনে তেমন কোনো প্রাণী দেখা গেল না। অবশ্য গাছে কিছু বানর ছিল।

বিকাল নাগাদ আমরা গিয়ে পৌছলাম রুমা সদরে। বাজারে গিয়ে আমরা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের স্থানীয় সভাপতিকে খুজছিলাম। তিনি আমাদের এক বন্ধুুর পরিচিত। এ সময় ছোট করে চুল ছাটা সিভিলিয়ান পোশাকের এক বাঙ্গালি নিজেকে আর্মির ওয়্যারান্ট অফিসার হিসেবে পরিচয় দেয় এবং জানায় যে, তাজিংডং এবং কেওক্রাডং যেতে পুলিশ এবং আর্মির অনুমতি লাগবে। আমরা প্রথমে থানায় গেলাম এবং পুলিশকে আমাদের উদ্দেশ্য জানালাম।

এ সময় পুলিশরা আমাদের এ এলাকায় যেতে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে। পরে অবশ্য সবার নাম ঠিকানা লিখে রেখে তারপর যেতে অনুমতি দেয়। এ সময় স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র সাং লিয়েন তাজিংডং যাত্রার গাইড হবার জন্য আমাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি শুরু করে। স্থানীয় রেস্ট হাউসে আজকের রাতটা কাটিয়ে কালকে ভোরে আমাদের গন্তব্যে রওনা দিব। থাকার জায়গা ঠিক করে আর্মি ক্যাম্পে যেতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়।

আর্মিদের ব্যবহার খারাপ ছিল না। তারা আমাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখে এবং আমাদের জন্য একজন ভালো গাইড ঠিক করার চেষ্টা করে। আর্মি ক্যাম্পে আমরা যখন আলোচনা করছি তখন রুমা বাজারে আগুন লেগে যায়। আর্মি ক্যাম্পটি রুমা বাজারের খুবই কাছে অবস্থিত। আর্মিরা এ সময় নিজেদের বিপদ আশঙ্কায় সতর্ক হয়ে ওঠে।

ফলে আমাদের চলে আসতে হয়। এদিন রাতে রুমা বাজারের একাংশের সব দোকান পুড়ে যায়। এদিন ছিল ইংরেজি বছরের শেষ দিন অর্থাৎ থার্টিফাস্ট নাইট। গাইড সাং লিয়েন জানালো এই এলাকায় থার্টিফাস্ট নাইট বেশ ভালোভাবে পালিত হয়। প্রথমে তার কথা বিশ্বাস না হলেও রাতে খাওয়াদাওয়ার পর আমরা তার সঙ্গে রুমা সদরের পাহাড়িদের এলাকায় গেলাম থার্টিফাস্টের উৎসবে।

জানতে পারলাম, লিয়েনরা আগে খুমি জাতিগোষ্ঠীর ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা ধর্ম পরিবর্তন করে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছে। এখন তারা নিজেদের বম বলে পরিচয় দেয়। তবে তাদের স্থানীয় উৎসবের সঙ্গে ইংরেজি থার্টিফাস্ট নাইট মিলে গেছে। আমরা প্রথমে স্থানীয় গীর্জায় গেলাম। সেখানে সুমিষ্ট একঘেয়ে সুরে প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছিলো।

এরপর সাং লিয়েন আমাদের তার বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিয়ে গেল। দেখলাম প্রত্যেক বাড়িতেই থার্টিফাস্ট উদযাপন করার জন্য একধরনের ভাতের পিঠা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়াও কিছু পাহাড়ি খাবার ছিল। এ সময় কুম থার চিবাই- কথাটা শিখে নিলাম। কথাটার অর্থ শুভ নববর্ষ।

আমরা যেখানেই যাই পাহাড়ি দেখলেই বলে উঠি, কুম থার চিবাই। স্থানীয় পাহাড়িরা এ কথাতে সবাই খুব খুশি হয়। ছেলে মেয়ে সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে। তারা অনেকেই আমাদেরকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে। এভাবে কয়েকটি বাড়িতে ঘুরে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা আমাদের আস্তানায় ফিরলাম।

রাত তখন প্রায় 2টা। গত রাতের বাস জার্নির পর আজকের সারা দিনের পরিশ্রমে শরীর খুব ক্লান্ত ছিল। রুমা থেকে তাজিংডং যাবার জন্য পায়ে হাটা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। শিডিউল অনুযায়ি কাল সকাল থেকে আমাদের পায়ে হেটে রওনা দিতে হবে। আমাদের প্রথম দিনের টার্গেট বাংলাদেশের সর্বোচ্চ লেক বলে পরিচিত বগা লেক।

(ঝাপসা ছবিটি রুমা যাবার পথে আমাদের নৌকা থেকে তোলা)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।