আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উর্মি-শর্মি , মুনকার-নাকীর জানি কই থাকে?(শেষ পর্ব- উৎসর্গ সাব্বির)

পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি

[সত্য এই ঘটনা তুলে ধরতে কিছু শব্দ এসেছে যা আমি ব্যবহার করি না। ক্ষমাপ্রার্থী কেউ যদি বিব্রত হয়ে থাকেন। ] : "কুত্তার বাচচা , নাই মানে? নিয়ার ডেথ পেশেন্ট কি হাইটা বাইরে গেলো না উইড়া? ইউ মাদার ফাকার , আই উইল মেক দা হেড ফাক উইথ ইউ এ্যান্ড দেন ইউ উইল নো । টাকার লাইগা তোরা তো বউরেও মা..........তেও বেইচা দিবি । উর্মি কই ? " বর্নার চিৎকারে চারিদিকে ঘোর অমঙ্গল নামে।

চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী মারমুখী হয়ে ওঠে । যদিও প্রচুর টাকা খেয়েছে আমাদের কাছ থেকে , তবু গালাগালি , তাও ওয়ার্ড ভর্তি লোক জনের সামনে । বাবুল ফুঁসতে থাকে লেজে পা পড়া সাপের মত । কিছু করতে পারে না , কারন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল রিপোর্টার ,কে জানে কোন পত্রিকার , সাংবাদিক বন্ধু টন্ধু নিয়ে ওয়ার্ডেই ছিলো । চারিদিক থেকে ইন্টার্নী ডাক্তার , নার্সরা হই হই ছুটে আসে।

আমি ছাড়া বর্নাকে কেউ সামলাইতে পারে না। কিন্তু আজকে আমার ওর দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করে না । মরলে মরুক, আমার কি- টাইপের একটা নির্লিপ্ততা চেপে বসে থাকে বুকে । উর্মি নেই ! নাস্তা খেয়ে খোঁজ নিতে এসে দেখি বেডে নাই । তার পর ওয়ার্ড , বারান্দা , সব তোলপাড় করেও আমরা পাই না ওকে ।

ছুটে দোতলায় যাই আমি । বিশ্বাস হয় না নার্সদের কথা । শর্মি , উর্মির ছোট্ট বোনটা মারা গ্যাছে । মাত্র ৩০ না ৪০ % বার্ন নিয়ে মারা যায় কি করে? সারারাত যমে আর উর্মিতে টানাটানি করেছে । আমরা ৩ জন মিলে বাঁচিয়ে তুলেছি ওকে ।

শর্মির তো সেই রকম কিছু লাগতো না। শুধু স্যালাইন ইনফিউশনের কাজটা করলেই ...........বার্ন ম্যানেজমেনেটের একটা সহজ সূত্র আছে । এত কেজি ওজনের এত বয়সের বাচচার এত % বার্ন থাকলে , এত ঘন্টায় এত মিলি স্যালাইন ঢুকবে । এই সূত্র সব ডাক্তার আর নার্সের মুখস্থ । পাশাপাশি শুধু একটু " ইউরিন আউটপুট মানে শরীর থেকে কত পানি বেরিয়ে গেল" এই মাপটা রেখে "যোগ-বিয়োগের ব্যালেন্সটা" করে নিতে হবে ।

ব্যস , এই তো । কি এমন কঠিন কাজ! এই কাজটাই যেই পোস্ট গ্রাজুয়েশনের স্টুডেন্ট ডাক্তারকে দেওয়া হয়েছিলো , সে করেনি । ওয়ার্ডের বেডে শুইয়ে , স্যালাইনের একটা চ্যানেল চালু করে দিয়ে , নার্সদের উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে উনি বাড়ি চলে গেছেন ঘুমাতে । রাত ভর সিনিয়ার কোন ডাক্তার না থাকলে , হাসপাতালের নার্সরা কে কেমন দায়িত্ব পালন করে , আপনারা যদি কেউ রাত্রিযাপন করে থাকেন ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডে , তা হলে জানবেন। আল্লাহ ও ধনিকের ।

হাড় হাভাতে গরীবের "ফুটা পয়সা দামেরও না" মেয়ে শর্মিকে তাই কেউ বাঁচায়নি । না তার ডাক্তার , না নার্স , না আল্লাহ । যে অমানবিক, নিষ্ঠুর , স্বার্থপর শহর আর হাসপাতালে শর্মির মৃত্যু হয়েছে , সেখানে উর্মিকে আর এক মুহূর্ত রাখতে চায়নি তার গ্রাম্য সহজ সরল বাবা মা। তাঁরা জেনে গেছেন , এই শহর ,এই চাকচিক্য ভরা সর্বগ্রাসী ইট কাঠের রাক্ষুসে ক্ষুধায় পড়ে তাকলে উর্মিও বাঁচবে না। আর তাছাড়া , এখানে কে তাকে দেখে রাখবে ? কে চালাবে চিকিৎসার খরচ? শর্মিকে নিয়ে কবর দেওয়ার জন্য কে যাবে আর কে রয়ে যাবে পিছনে দ্বিতীয় একটি দীর্ঘায়িত , খরুচে অবহেলার পরিণতির জন্য ? যে ডাক্তাররা এক রাত ঘুম বিসর্জন দিতে চায় না , একটি শিশুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য , তাদের হাতে নিরাপদ নয় কোন প্রান্তিক মায়ের বুকের ধন।

তাই তাঁরা শর্মির লাশ কাঁধে নিয়ে , আপাদমস্তক পুড়ে যাওয়া উর্মিকে বুকে জড়িয়ে চলে গেছেন এই হাসপাতালের চত্বর ছেড়ে । কর্মচারীরা কেউ তাঁদের ঠিকানা রাখে নাই , রাখে নাই ধরে উর্মির পোড়া দেহ , রাখে নাই খোঁজ - কি প্রকারে এই হত দরিদ্র পরিবারটি পৌঁছাবে বহুদুর ছোট্ট তাদের গ্রামে । তবে টিপ সই নিতে ভোলেনি সেই ছাড়পত্রে , যেখানে মুখ ব্যাদান করে কয়েকটি শব্দ জানান দেয় , উর্মির মত "আল্লাহর মাল" আল্লায় নিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন ক্রমেই দায়ী থাকিবেন না । উর্মিকে তাহার অবিবেচক পরিবার সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে বুঝিয়া পাইয়া , লইয়া যাইতেছে । বর্নার উন্মত্ত গালাগালি বন্ধ করা যায় না।

ইন্টার্ন'স রুমে ওর অক্ষম চিৎকারও আমাকে সরব করতে পারে না। আমাকে কে কে , কি কি যেন বোঝাতে চেষ্টা করে । " আমাদের কিছু করার ছিলো না । " " এই সব অশিক্ষিত বাপ মা রে কি বোঝানো যায়?" "একটা বাচচা মরছে বলে হাসপাতালটাই অপয়া হয়ে গেল? রাবিশ!" "অন্য বাচচাটা ও তো মরবে , স্রেফ চিকিৎসা না পেয়ে , আরে বাবা , এই সব কেস কি বাড়িতে ম্যানেজ করা যায় !" আমি শুধু একবার জিগেস করি , "ছাড়পত্র দেওয়ার আগে কনসার্ন্ড ডাক্তারের সাইন লাগে । আমারে ডাকেন নাই কেন? আমি তো ক্যান্টিনেই ছিলাম !" "আহা, ইমন বোঝার চেষ্টা করো ।

দে ডিড নট ওয়ান্ট টু ওয়েট । ওদের নাকি লঞ্চ ছেড়ে দিবে । আমাদের কিছু করার ছিলো না। " "একটা মাত্র বাচচা মরেছে বলে মন খারাপ? আরে এই রকম কত মরবে। এই সব ফালতু ইমোশন ভুলে যাও।

" - সকালের রাউন্ডে এসে জ্ঞান দিয়ে গেলেন ডিপার্টমেন্ট হেড ! আমি সব বুঝতে পারি । আমি খুব তুখোড় ছাত্রী বরাবরই । আমি খুব মন দিয়ে ক্লাস করি , সব কটা বই মন দিয়ে পড়ি , প্র্যাকটিকাল ক্লাস গুলাতে মন দিয়ে সব দেখি আর মনে রাখি । তাই আমার সব মনে পড়ে যায় । আমি সব আমার কল্পনার চোখে দেখতে পাই।

কি ভাবে উর্মি নামের একটা মাত্র ৭ বছরের মেয়েদেহ একটু একটু করে পঁচে যাবে । পোড়া জায়গা গুলোতে থাকবে গলিত , বিবমিষা জাগানো মাংস । একটু একটু করে সে গুলো আলগা হয়ে যাবে হাড় থেকে । প্রতিটা উন্মুক্ত নার্ভ এর ছড়ানো ছিটানো মাথা গুলো অকল্পনীয় , অসহ্য ব্যাথায় উর্মিকে প্রতি মুহূর্তে বাধ্য করবে দ্রুত মৃত্যু কামনা করতে। ওর সারা গা পোড়া , কোথাও কোন চামড়া নেই।

শরীর থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে যাবে দেহরস । উর্মি পিপাসায় কাতর হবে । পানি চাইবে । পুড়ে যাওয়া ফুসফুস আর কন্ঠনালী থেকে সেই করুন আকুতির সাথে গমকে গমকে বেরিয়ে আসবে রক্ত । একটি ফোটা পানিও ওর ঝলসে যাওয়া জিহবায় এসিডের মত মনে হবে।

ও মরবে । তবে ধীরে ধীরে , একটু একটু করে , হাবিয়া দোজখের পাপিষ্ঠার মত । পাপীই তো । বাংলাদেশের মত দেশে অত গরীব হওয়াটাই সবচেয়ে বড় পাপ। আমি আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে বার বার একটাই দোয়া করি উর্মির জন্য , আমার হারিয়ে যাওয়া পোড়া মেয়েটার জন্য , যার বিয়ের নাক ফুল আমার কানে লতায় ফাঁসির বৃত্ত হয়ে ঝুলে থাকে , আমি ওই মেয়েটার জন্যই দোয়া করি ----- আল্লাহ , মৃত্যু যেন হয় দ্রুততম।

এক্ষনি । এই মুহূর্তে । ওকে আর একটা সেকেন্ড ও কষ্ট দিও না। ---------------------------------------------- ২০০৩ সালের ঐদিন বর্না আর আমি সিদ্ধান্ত নেই ডাক্তারী ছেড়ে দেব। আমাদের উর্মি-শর্মিরা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারে না।

তার আগেই মরে যায়। জন্মানোর মুহূর্তটাই আসলে ওদের জন্য মৃত্যু সমন। ওরা বাংলাদেশের সেরা হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেও মরে যায় । কি হবে প্রেসক্রিপসন লিখে ? দারিদ্রের কোন ওষুধ বেরিয়েছে ? অথবা অবহেলা নিরোধক কোন সিরাপ? ভালোবাসা নামক কোন ম্যাজিক পোশন? তাহলে আর কাগজ লিখে কি হবে । ওটা করার জন্য হাজার হাজার ডাক্তার আছে ।

বর্না আর আমি ইট কাঠের চত্বর ত্যাগ করে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে , হাট-মাঠ-ঘাটে ঘুরি ফিরি পাবলিক হেলথের নামে । যদি কোথাও , কোন শান্ত জংলায় পেয়ে যাই কোন দিন , আমার হরিনী চোখের উর্মি আর তুলতুলে শর্মিকে ! --------------------------------------------- !@@!582972 !@@!582973 !@@!582974 !@@!582975 !@@!582976

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।