যদি নির্বাসন দাও.................................................................. আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো আমি বিষ পান করে মরে যাবো! বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ, প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ- এ আমারই সাড়ে তিন হাত তুমি।
হাড়কেপ্পন লোকের কথা এতোদিন শুধু মানুষের মুখে টিপ্পনী কাটার ক্ষেত্রে শুনেছি। চাকুরীতে যোগ দেয়ার পর সাধনবাবুকে দেখে এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারলাম। সাধনবাবু আমাদের অফিসের একাউন্ট্যান্ট। তার দীর্ঘ পঁিচশ বছরের চাকুরী জীবনে কেউ তার পকেট থেকে পাঁচটি টাকা বের করতে পেরেছে এমন ইতিহাস এ পর্যন্ত জানা যায়নি।
উনার চালচলনের দু'একটা উদাহরণ দেয়া নিতান্ত প্রয়োজন বোধ করছি। কোথাও বসতে গেলে তিনি এমন মাইক্রোস্পোপিক দৃষ্টিতে অনুসন্ধান চালাতেন যেটা মেটাল ডিটেক্টরকেও হার মানাতে বাধ্য। কারণ এই- কোথাও খোঁচা লেগে যেন তার শ্বশুর প্রদত্ত সু্যটটা ছিড়ে না যায় তার জন্য সতর্কতা অবলম্বন। হল রুমে যাওয়ার সময় যে সরু প্যাসেজটা পেরুতে হয়, সেটা পেরুনোর সময় তিনি বরাবরই ঠিক মাঝখান দিয়ে হাঁটা শুরু করতেন। এর ফলে বিপরীত দিক থেকে কেউ আসলে উনাকে একপাশে গিয়ে জায়গা করে দিতে হতো।
এর কারণও সেই খোঁচা খাওয়ার ভয়, ঠিক খোঁচা খাওয়ার নয়, সু্যট ছিড়ে যাওয়ার ভয়। এবার আসা যাক মূল ঘটনায়।
আমরা অর্থাৎ অফিসের অন্য কলিগরা (বিশেষত যারা নতুন) সবাই মিলে নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে লাগলাম কি করে সাধনবাবুর পচিঁশ বছরের রেকর্ডটাকে ভাঙ্গা যায়। সেদিন মাসুম ভাই বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, ' এবার দেখো খেল। কতো ঘাঘু লোককে ঘোল খাইয়েছি আর এতো সামান্য একটা মাছি।
' মোর্শেদ ভাই হেসে বলেন, 'হুম, আর জানো তো মাছির মাথার চতর্ুদিকে চোখ থাকে। অতএব সাবধান। ' মাসুম ভাই চিন্তার সাগরে ডুব দিলেন। বেশ খানিক পড়ে বললেন, 'কাল তো শুক্রবার, পরশু থেকে নতুন খেলা শুরু হচ্ছে। ' আমরাও অকূল সমর্থন জানাই, ওকে বস, তো হয়ে যাক শুরু- মিশন ইমপসিবল ফোর।
মাসুম ভাই শনিবার অফিসে এলেন নতুন মোবাইল নিয়ে। বুঝতে পারলাম পুরনো সেটের খোলনলচে পাল্টিয়ে নতুনের তকমা লাগানো হয়েছে। সাধনবাবুর রুমে গেলেন। গল্প করা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে রাজকীয় ভঙ্গিতে হাত নাড়াচাড়া করতে লাগলেন যাতে মোবাইলটা সাধনবাবুর দৃষ্টিগোচর হয়।
এবং একসময় তা হলোও। মাসুম ভাই উৎসাহিত হয়ে এবার মোবাইলের গুনকীর্তন শুরু করলেন। আসল টার্গেট হলো এই পুরনো মোবাইলটা গছিয়ে নতুন মোবাইলের দাম নেয়া সাধন বাবুর কাছ থেকে। এখানে বলে রাখা ভালো সাধনবাবুর কোন মোবাইল ছিলো না। মোবাইলের উচ্চকিত প্রশংসা করতে করতে একসময় বললেন, 'জানেন সাধনবাবু? গতকাল গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি।
হাতে নতুন মোবাইল। সবাই দেখে তো একেবারে হা। এই ব্র্যান্ড তো ওরা চোখেই দেখেনি। আরে দেখবে কোথায়? এতো মাত্র নতুন এসেছে। আমিই বাংলাদেশে প্রথম ইউজার।
ফেরার পথে হলো দারুন ব্যাপার। জানেন তো আমাদের গ্রামে যেতে একটা খাল পড়ে যেটা নৌকাতে করে পার হতে হয়। ওটা পার হওয়ার সময় হঠাৎ হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল পানিতে। সবাই তো হায় হায় করতে লাগলো। মাঝিসহ আরো দু'জন ঝাঁপ দিলো উদ্ধার করতে।
কিন্তু এতো সহজ না। প্রায় দু'ঘন্টা পরে উদ্ধার করলো পানি থেকে। তাও সাথে আমার চাচাত ভাই ছিলো বলে। তার কাছে একটা মোবাইল ছিলো। সে আমার মোবাইলে কল করা শুরু করলো।
আশ্চর্যের বিষয় পানির নীচেই আমার মোবাইল বাজতে শুরু করলো। সেই শব্দ শুনে তবেই না উদ্ধার করা গেলো। তার চেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো হাতে নিয়ে দেখি মোবাইলের কিছুই হয়নি। মানে একদম ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট। ' সাধনবাবু বিস্ময়সূচক শব্দ করলেন।
মোবাইলটি হাতে নিয়ে বেশ উল্টে পাল্টে দেখলেন। তারপর টুক করে টেবিলে রাখা পানিভর্তি গ্লাসের মাঝে ফেলে দিলেন। মাসুম ভাই কন্ঠনালী ছেড়া চিৎকার দিয়ে উঠলেন- 'আরে করেন কি? করেন কি? সাধনবাবু নিরুত্তাপ স্বরে জবাব দেন, আরে মশায়, আপনার মোবাইল গতকাল দু'ঘন্টা পানির নীচে ছিলো, কিছু হয়নি। এখন দু'মিনিট থাকলে ক্ষতি কি? দেখি কেমন ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট আপনার মোবাইলটা?' মাসুম ভাই একেবারে চুপসে গেলেন। বেশি চাপাবাজি করতে গিয়ে শেষে যে এভাবে ধরা খাবেন সেটা ভাবনাতেও ছিলো না তার।
সেদিন থেকে মাসুম ভাই মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন সাধনবাবুকে কুপোকাত করার জন্য।
অবশেষে সে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। প্রায় মাস তিনেক পরের কথা। এর মাঝে মাসুম ভাই সাধনবাবুর কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন। কারণ তিনি চাপাবাজি একদম বন্ধ করে দিয়েছিলেন আর খুব ভালো ভালো পরামর্শও দেয়া শুরু করেছিলেন।
সেদিন সকালে মাসুম ভাই একেবারে সু্যটেড-বুটেড হয়ে অফিসে হাজির। কালো সু্যট সাথে নতুন চকচকে টাই। লাঞ্চ ব্রেকে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। মাসুম ভাইয়ের টাইয়ের কথা উঠলো। মাসুম ভাই বললেন, ওটা উনি দু'মাস আগে জেরল্ড থেকে কিনেছেন।
তখন অফার ছিলো বলে দাম পড়েছে তিনশ টাকা, এমনিতে কিনতে গেলে সাতশ টাকার মতো। আমরা তো একেবারে দশমুখে টাইয়ের প্রশংসা করতে লাগলাম, 'আপনি কিন্তু বড় জেতা জিতেছেন। এই টাই মাত্র তিনশ টাকা দিয়ে। এতো হাজার টাকার জিনিস। ' খেয়াল করে দেখলাম, সাধনবাবুর টাইটা বেশ মনে ধরেছে।
অধিকন্তু তিনি সু্যট ছাড়া টাই পড়তেন বলে টাইয়ের জন্য তার মনে একটা গোপন হাহাকার থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তিনি বললেন, 'মাসুম সাহেব আবার যদি অফারটা পান আমাকে একটু জানাবেন। ' মাসুম ভাই বললেন, 'না সাধনবাবু এটা তো ওদের শতবর্ষপূর্তি উপল্যে দিয়েছিলো। আরেকবার সে অফার আসতে আসতে আমি আর আপনি দুজনেই পটল তুলবো নিশ্চিত। ' সাধনবাবুর দীর্ঘশ্বাসের আঁচ আমাদের কানেও লাগলো।
হঠৎ মাসুম ভাই বললেন, 'তবে আপনার যদি টাইটা বেশি পছন্দ হয় তবে আপনি নিতে পারেন। আমার তো আরো দুটো টাই আছেই। আপনি শুধু দামটা দিলেই চলবে। ' আমরা আপত্তি করলাম- 'না না তিনশ না, পাঁচশ টাকা দেয়া উচিৎ কারণ এখন কোথাও তিনশ টাকা দিয়ে এই অমূল্য বস্তু পাওয়া যাবে না। ' সাধনবাবু টোপ গিললেন।
আমতা আমতা করে বললেন, 'না, সে কি করে হয়? আপনার টাই আমাকে দেবেন কেন?' মাসুম ভাই বাধা দিয়ে বললেন, 'আরে না না, আমি তো আপনাকে এমনি এমনি দিচ্ছি না, টাকা নিচ্ছি। ' অবশেষে তিনশ টাকা দিয়ে সাধনবাবু টাইটা হস্তগত করে গলায় ঝুলিয়ে বিজয়ীর বেশে উনার রুমের দিকে রওনা দিলেন। আমরা সাধনবাবুকে বললাম, 'সাধনবাবু নতুন টাইয়ের আকিকা দিতে হবে কিন্তু। ' উনি যেতে যেতে বললেন, 'আকিকা না দেই, কুলখানি কিন্তু ঠিক দেবো। ' সাধনবাবু নিশ্চিত ছিলেন উনার চাকুরি জীবন শেষ হলেও টাইয়ের আয়ু এতো তাড়াতাড়ি শেষ হবে না, কাজেই কুলখানি আদতে দেয়ার কোন চান্সই নেই।
মাসুম ভাই মুচকি হেসে বললেন- 'ঠিক আছে সাধনবাবুর নতুন টাই কেনার আকিকা আমিই দেবো। ' অফিস শেষে খাবার দাবারের আয়োজন করা হলো। মেনু্য আহামরি কিছু না কারণ বাজেট ছিলো দু'শ আশি টাকা মাত্র। সবাই যখন কাঁটা চামচে কাবাব গেঁেথ মুখে পুরছিলেন তখন মাসুম ভাই আকিকার রহস্য উদঘাটন করলেন, 'আসলে সাধনবাবুর টাইটি আমি দুই দিন আগে ফুটপাতের একটা দোকান থেকে কিনেছিলাম। এটা কিনতে খরচ হয়েছে মাত্র দশ টাকা।
' সাধনবাবুর যেন বাকশক্তি রহিত হয়ে গেলো। তিনি কাঁটা চামচে গেঁথে থাকা মাংসের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। যেন ওটা মাংসপিন্ড নয়, তারই হৃদপিন্ড। আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম, এই 280 টাকার শোকে সাধনবাবু আবার সেই টাই দিয়ে আত্মহত্যা না করে বসেন।
সুখের খবর হলো সেসরকম কিছু ঘটেনি।
তবে মাস ছয়েক পড়ে টাইয়ের মাঝখানে দুটো ফুটো দেখা দিয়েছিলো। একসময় সাধনবাবু উনার সেই টাইহীন পূর্বাবস্থায় ফিরে এলেও টাইয়ের কুলখানি খাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।
** লেখাটি হাজারদুয়ারীতে প্রকাশিত [23-02-07]।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।