আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক বিপ্লবীর শেষকথা এবং একটি নিরুত্তর মূহূর্ত



শেষ সূর্যাস্তের আলোটা তখন দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। - কি ভাবছ - রক্ত ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সামনে জলের দিকে তাকাই। স্রোতেও শেষ সন্ধ্যার ছায়া। - ধুকে ধুকে মরলে রক্তের ছোপ পড়ে না হাতে - না? আমি কোন কথা বলি না। একটা পাখি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়।

মাঝে মাঝে চুপ থাকাটাই সবচেয়ে বড় উত্তর হয়ে ঝুলে থাকে। - ওরা খুব সরলভাবে হিসেব করে। আমি সেটা জানি। এ নিয়ে কথা বলার কোন মানে হয় না। ওরা কি বোঝে না এভাবে কিছু হয় না।

মাস্টার মনের কথাটা যেন পড়ে ফেলেন। আসলে এ ব্যাপারটা নিয়ে এত কথা হয়ে গেছে যে বলার কিছু নেই। আমি জানি তিনি হাল ছাড়বেন না। হালছাড়া মানুষের দলে তিনি কখনই ছিলেন না। - কিন্তু ওরা খুব সরল আর আর সরল মানুষেরাতো সহজভাবে শত্রুকে চিনে নেয়।

কিন্তু পৃথিবীটা মাটেই সরল নয়। একজন মানুষের অন্দরে কি ধূমায়িত জটিলতা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো লকলক করে এরা এর কোন খবর রাখে না। না সত্যিই কোন আশা নেই। সন্ধ্যার আলো এখন পুরোটাই নিভে এসেছে। ছাইরঙা রঙ এখন জলের।

নদীর ঠিক মধ্যিখানে সন্ধ্যাতারা ফুটেছে। আমি জলে তার ছায়া খুজি। কিন্তু বিপুলায়তন এই জলরাশির মধ্যে তার কোন ঠাহর খুজে পাওয়া যায় না। হটাৎ করে আমার ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। শীত তাহলে আসছে।

- ক্লোজ আপ ওয়ান এর রেজাল্ট দেখেছো? আমি চমকে যাই। বিপননের এইসব ঝলমলে আসরের কথা তার কাছে আশা করিনি। আমি আড়চোখে তার দিকে তাকাই। রাতের আধারে তাকে আরো অন্ধকার দেখায়। দুরে একটা আলো কেবল দুলতে থাকে।

দলছুট কোন জেলে নৌকা আগেভাগে জাল নামিয়েছে। তার সেই টিমটিমি বাতির দিকে আমি চেয়ে থাকি আর এরপরের শব্দের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু মাস্টার এইবার যেন একটু বেশি সময় নিচ্ছেন। দুজনের মধ্যে অখন্ড একটা নিরবতা ঝুলে থাকে। - এই যে নোলক জিতল তোমার কি মনে হয় শুধু গানের জন্য সে জিতেছে ? এইবার আমি বুঝে যাই তিনি কি বলবেন।

- গরীব বলে তাকে লোকে এত ভোট দিয়েছে। হয়তো এর খানিকটা সত্য। পুরোটা না। সাধারন মানুষের আবেগকে নিয়ে পণ্য- পসারের এই খেলাটায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এরহাত থেকে মুক্তির রাস্তাটা এই অন্ধকারের মতোই।

এরা পারবে না। মনের ভেতর পুরনো কথাটা আবার জেগে ওঠে। একটু খারাপ লাগে মানুষগুলোর জন্য। কিন্তু আমার আর কি করার আছে ওদের জন্য আমি ভেবে পাড় খুজে পাই না। - মানুষ এখনও বড়লোকদের ঘৃণা করে।

হয়তোবা! হয়তোবা কেন - সত্যিই তাই। না পাওয়ার যন্ত্রণায় ঈর্ষাতো খড়িকাঠ জোগাবেই। কিন্তু এ দিয়েই সব পাল্টে ফেলা যাবে আমি তা বিশ্বাস করি না। চোখে ভাসে রঞ্জু মুখ। কি স্বপ্নময় চোখদুটো ছিল ওর।

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল ঢাকায়। আমি ও কে বলেছিলাম এসবে কোন লাভ হবে না। ও বলছিল ু তাহলে এসব কি চলতে থাকবে ? দশজন মানুষের জন্য বাকি নব্বইটা মানুষ। এর উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু এ প্রশ্নটার চেয়ে বড় মনে হয় রঞ্জুর কথা।

ওর উপর রাগ হয়। এ জীবনে যদি পাই বাড়াবি তো ঐ ছোট্ট মেয়েটাকে বিয়ে করার কি দরকার ছিল? রঞ্জুর স্বপ্নালু চোখের পাশেই শঙ্কাতুর লাভলীর চোখ মনে পারে। রঞ্জু এর তিন দিন পরে ধরা পড়ে। পুলিশের ভয়ে আমি আর লাভলীর সাথে যোগাযোগ করিনি। কেমন আছে মেয়েটি? এলোমেলো ভাবনার তোড়ে মাস্টার যে কখন কথা বলতে শুরু করেছেন খেয়ালই করিনি।

- এখনও এখানের লোক শক্ত লোক পছন্দ করে। গ্রামে আদর্শ প্রেসিডেন্ট বলতে আইয়ুবকে বোঝে, ডেমোক্রেটিক লিডাররা মোড়লের মতো কাজ করে সেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া কিভাবে কিভাবে হবে? আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়। দুই তিনজন অশিক্ষিত জোতদার আর গরীব পুলিশ মেরে কি হবে? পারলে দুই একটা কেউকেটা সাবাড় করে দেখাক না। কিন্তু আমি কিছুই বলি না। কিন্তু মাষ্টার কেমন জানি অদ্ভুত মানুষ।

মাঝে মধ্যে লোকটাকে আমার মানুষ কি না সন্দেহ হয়। কিভাবে যে মনের কথা বঝে ফেলেন। আমি ভুলে যাই তিনি সত্তরটা জি্বন ভূত ছাড়িয়েছেন মানুষের ঘাড় থেকে। শুধু ঘাড় থেকে নয়, মন থেকে। কেবল মানুষের মধ্যেকার ক্থপমুন্ডকতা দুর করার জন্য জীবনের বড় একটা সময় দিয়েছেন, বাবার জমি বেচে স্কুল, কলেজ গড়েছেন...এলাকার লোকে তাকে মাস্টার ডাকে একটা তার গলায় গাম্ভীর্য্যতা আসন্ন শীতের কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায় - তোমরা না এলে আমি শক্ত হয়ে যাই।

তোমরা মানে ... আমি, তুমি, আর আমাদের কথা। নদীতে তখন অনেক নৌকায় আলো জ্বলে উঠেছে। সারি সারি আলোর মুকুট পরে পদ্মা যেন কনের বাড়ি সেজেছে। আমি কিস্যূ শুনতে চাই না। তবু অন্ধকাওে মাষ্টারের গলা শিঙ্গার মত তীব্র মনে হয়।

- ওরা তো ওদের নিয়মে ওদের শত্রু খুজে। তোমরা যারা চিন্তা কর, পড়াশোনা করেছো তারা যদি পলেটিঙ্ েনা আসো তাহলে তো এটা ঠেকানো যাবে না। শিক্ষিত লিডার লাগবে। তোমরা যদি সেই দায়িত্ব না নাও তাহলে এটা যারা বোঝে না তাদের হাতে চলে গেলে যেটুকু আশা সেটাও যাবে। খুব বাতাস উঠেছে নদীতে।

হাত পকেটে ঢুকিয়ে শরীরটাকে কুকড়ে নিয়ে আসি নিজের ভেতরে। পূর্ণিমার চাদেও লাল ছোপ। স্বপ্ন, রঞ্জু, মাস্টার, মাঝি, পদ্মার স্রোত, পূর্ণিমার চাঁদ, শীতে কুকড়ে যাওয়া শরীর একাকার হয়ে যায়...চারপাশের নিরুত্তর ধ্বনি ভেসে আসে- মাস্টার বুঝে নেন... টকটকে কালো অন্ধকার মনে হয় আমার কাছে, গলার কাছে কেমন নোনতা লাগে , আমি ঢোক গিলি, হটাৎ খেয়াল করি মাস্টার অন্ধকার তীর ধরে হাটতে শুরু করেছেন... আমি মাস্টারকে চিৎকার করে ডাকি তিনি যেন থমকে দাড়িয়েও থেমে যান না.... আমিও মাটিতে আঙ্গুল গেড়ে দাড়িয়ে থাকি... তার পেছনে ছুটতে পারি না। ওটাই তাকে ছুড়ে দেয়া আমার শেষ ডাক। ডাকটাতে কি বিশ্বাসের অস্বীকার ছিল কিংবা অপারগতা.. কিংবা সেটাও ছিল কেবলই এক নিরুত্তর মূহূর্ত।

এর ঠিক ছয়দিন পর মাস্টারকে ধরে নিয়ে যায় কালো পোষাক পরা ধাতব মানুষেরা। খবরটা শোনা মাত্র আমার আবার মনে হয় স্রোত, চাদ, মাস্টার, অন্ধকার... একটা ছবি ভেসে উঠল চোখে.. মাস্টার হেটে যাচ্ছেন সেই পোষ্ট অফিসের পথ ধরে যেখানে রবিবাবু লিখেছিলেন পোস্টমাষ্টার গল্পটি। পোষ্ট অফিসটি এখন আর আগের মতো নেই তবু তার শীতল মেঝে স্পর্শ করে মাস্টার বলে উঠছেন - আমার রবীন্দ্রনাথ। আমার শুধু জানতে উচ্ছে করে যেই চকচকে নলের সামনে মাস্টরকে ঠেলে দিয়ে একটা বিবৃতি আর ছবি পত্রিকায় পাঠিয়েছিল তারা কি কখনও রবীন্দ্রনাথ পড়েছিল? একবার জীবনে অন্তত একবার রবীন্দ্রনাথ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।