অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
রাজাকার বাহিনী ও রাজাকারদের সংগঠন করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের জুন মাসে রাজাকার অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। পূর্বতন আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে এ দল গঠিত হয়। কিন্তু পরে বিভিন্ন শ্রেণীর পাকিস্তানপন্থীরা এই বাহিনীতে যোগ দেয়। এরা ছিল সশস্ত্র।
হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবেই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। জেনারেল নিয়াজী এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন যে, রাজাকার বাহিনীর তিনিই স্রষ্টা। তারা যথেষ্ট খেদমত করেছে পাকিস্তানী বাহিনীকে, যে কারণে তার বইটি তিনি তাদের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করেছেন।
রাজাকারের শুদ্ধ উচ্চারণ 'রেজাকার'- ফারসি শব্দ। 'রেজা' হল স্বেচ্ছাসেবী, 'কার' অর্থ কর্মী।
এক কথায় স্বেচ্ছাসেবী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় হায়দরাবাদের নিজাম অনিচ্ছুক ছিলেন ভারতের সঙ্গে মিলনে। আত্মরক্ষার জন্য তিনি গঠন করেছিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যার নাম দেওয়া হয়েছিল রেজাকার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত নেতা এ.কে.এম ইউসুফ শব্দটি ধার করেন এবং খুলনায় রেজাকার বাহিনীর সূত্রপাত করেন। 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে এই বাহিনীর সূত্রপাত যা পরে পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পরে।
পুর্বোক্ত গ্রন্থ অনুযায়ী- 'প্রশাসনিকভাবে এই বাহিনীতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর লোক অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদেরকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, যারা 'পাকিস্তান' ও ইসলামকে রক্ষার জন্য বাঙালীর হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করাকে কর্তব্য মনে করেছিল; দ্বিতীয়ত, যারা লুটপাট, প্রতিশোধ গ্রহণ, নারী নির্যাতন করার একটি সুযোগ গ্রহণ করতে চেয়েছিল এবং তৃতীয়ত, গ্রামের দরিদ্র অশিক্ষিত জনগণ যারা সীমান্তের ওপারে চলে যেতে ব্যর্থ হয়- এ ধরণের লোককে প্রলুব্ধকরণ, বল প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। '
রাজাকার বাহিনী যাদের নিয়েই গঠিত করা হোক না কেন, এই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করত জামায়াতে ইসলামী। আবু সাইয়িদ তার 'সাধারণ ঘোষণার প্রেক্ষিত ও গোলাম আজম' গ্রন্থে জনৈক রাজাকারের পরিচয় পত্র তুলে দিয়েছেন যেখানে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে-
" this is to certify that Mr. Haroon-ur-Rashid Khan, S/o Abdul Azim Khan, 36 Purana Paltan Lane, Dacca-2 is our active worker. He is true pakistani and dependable. He is trained Razaker. He has been issued a Rifle No-776... with ten round ammunition for self-protection.
Sd/-illegible
IN CHARGE
RAZAKAR AND MUZAHID
JAMAT-E-ISLAM
91/92 Siddique Bazar, Dacca"
রাজাকারদের বিভিন্ন স্থাপনা পাহারা দেওয়া, মুক্তিবাহিনীর খোঁজ করা প্রভৃতি কাজে ব্যবহার করা হতো। বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এরাই ছড়িয়ে পড়েছিল।
সে কারণে, বাঙালীদের কাছে রাজাকার শব্দটি বেশি পরিচিত হয়ে ওঠে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোটাদাগে স্বাধীনতাবিরোধীদেরই রাজাকার নামে অভিহীত করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যারা ছিলেন তারা রাজকার ও তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে সবাই পরিচিত। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'ঘাতক দালাল নির্মূল' আন্দোলন শুরু হলে রাজাকার নামটি আরো পরিচিত হয়ে সাধারণ ভাষ্যে চলে আসে। হুমায়ুন আহমেদের একটি নাটকের সংলাপ ছিল 'তুই রাজাকার'।
এসব কারণে স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি, সে আলবদরই হোক বা দালালই হোক, পরিচিত হয়ে ওঠে রাজাকার হিসেবে। জামায়াত ইসলাম, বাংলাদেশের প্রাক্তন আমীর গোলাম আযম বলেছেন, তারা 'রাজাকার' ছিলেন না, ছিলেন 'রেজাকার'। হতে পারে রেজাকার শুদ্ধ, কিন্তু মানুষের কাছে অশুদ্ধ রাজাকারই পরিচিত।
সূত্র : ডঃ মুনতাসীর মামুন (মুক্তিযুদ্ধ কোষ চতুর্থ খণ্ড)
!@@!383012 !@@!383013
এ.এস.এম সামছুল আরেফিন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বই থেকে যোগ করছি :
১৯৭১ সালের মে মাসে মওলানা এ.কে.এম ইউসুফের নেতৃত্বে ৯৬ জন জামাত কর্মী নিয়ে খুলনায় আনসার ক্যাম্পে প্রথম এই বাহিনী গঠিত হয়। মওলানা একেএম ইউসুফ এই বাহিনীর নামকরণ করেন রাজাকার।
জুন মাসের সরকারী অধ্যাদেশে এই নাম রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়। ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মোঃ ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেওয়া হয়। অ্যাডজুটেন্ট বা কোম্পানি কমান্ডার থেকে নিচের স্তরের সকলেই রাজাকার কমান্ডারদের নেতৃত্বে পরিচালিত হত। কিন্তু ওপরের স্তরের সকলেই ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য।
শান্তি কমিটির মাধ্যমে রাজাকারদের রিক্রুট করা হত। এই বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই ছিল মাদ্রাসার মোহাদ্দেস ও মোদাচ্ছের। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্য ছাড়াও বহু গ্রামের যুবককেও এই বাহিনীতে ভর্তি করা হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ পরিচালিত হত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মাঠ ও ফিজিক্যাল কলেজের মাঠে মূলত রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হত।
এই বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল দেড় সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহ। প্রশিক্ষণ শেষে রাজাকারদের হাতে ৩০৩ রাইফেল তুলে দেওয়া হত। শুধু উচ্চ স্তরের কমান্ডারদের জন্য বরাদ্দ ছিল স্টেনগান।
ছবি পরিচিতি : রাজাকারদের ট্রেনিং, রাজাকারদের শপথ নামা, রাজাকার কমাণ্ডারদের তালিকা ১, ২, ৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।