'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'
ছোটবেলায়, যেসময়ের স্মৃতি আসলে আমার খুব বেশি মনেও নেই, আমরা থাকতাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে। বাবা সরকারি চাকুরে। সরকারি কোয়ার্টারে থাকা। ওই সময়ের যে টুকরো স্মৃতিগুলো মনে আছে সেগুলোর মধ্যে একটি স্মৃতি ছবির মতো এখনো দেখতে পাই। সেই ছবিটি একটি বড় গাছের নিচে এক ট্রাক শ্রমিককে নির্মমভাবে পেটানোর দৃশ্য।
যারা পেটাচ্ছিলেন তাদের শরীরে ছিলো জলপাই রঙের পোশাক। জানি না, ট্রাক শ্রমিকটা বোধহয় মহা অপরাধ করেছিলো!
একটু বড় হবার পর, যখনকার স্মৃতি হাতড়ে অনেককিছুই বের করা যায়, বাবা বদলি হলেন নওগাঁর পোরশায়। আবারো সরকারি কোয়ার্টারে থাকা। পার্ক ছিলো, খেলতাম। তবে আমার নিজের একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিলো নদীর প্রতি।
কারণও আছে। পোরশায় যাবার পর পারিবারি বন্ধুতা গড়ে ওঠে স্বর্ণা আপুদের সঙ্গে। এক সকালে বদলি নিয়ে স্বর্ণা আপুরা তল্পিতল্পা সমেত নাটোরের লালপুরে চলে গেলেন। আমরা বিদায় দিতে নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম। আমার খেলার সঙ্গী হারানোর বেদনায় কেঁদেছিলামও।
আমার কান্নাকে থোড়াই কেয়ার করে নদীর বুকে লঞ্চটি ভেপু বাজিয়ে চলে গেলো। সেই থেকে নদী আমাকে টানতো। কী নদী, নাম মনে নেই। নদীর ওপারেই ভারত সীমান্ত। নদীর পাড়ে বিডিআর ক্যাম্প।
বাবা-মার সঙ্গে একদিন নদী দেখতে গিয়ে পানি খাবার আবদার করলাম। সঙ্গে করে পানি আনা হয়নি। নদীর ঘাটে সেইরকম কোনো ব্যবস্থাও নেই। কাজেই বাবা বিডিআর ক্যাম্পে পানি খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক কর্মকর্তা শুধু পানি নয়, অনেক কিছুই খাওয়ালেন।
তিনি একজন মেজর। বাবা-মা কোনোদিনই বলে দেননি, বড় হয়ে কী হবো। তাই মেজর প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই থতমত খেয়ে জবাব দিলাম, 'মেজর'। খুব আত্মতৃপ্তির সঙ্গে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন কারণটা। আমি শুধু বলেছিলাম মানুষকে পানি খাওয়াতে চাই, তাই মেজর হবো।
মানে মেজরদের কাজ কেবল মানুষ পানি খাইয়ে চলা!
আরেকটু বড় হলাম। তখন মাথা জুড়ে মেজরেরা গিজগিজ করে। খেলনায় তার নমুনা। পোশাক-হাবভাবেও মেজর মেজর গন্ধ! জিয়ার সামরিক শাসনের পর দেশে তখন এরশাদের সামরিক শাসনের পালা চলছে। ওই বয়সে জানার কথা নয় আমার।
কিন্তু সে কারণেই সেনাবাহিনীর গাড়ি নিয়মিত আসতো-যেতো। আমার বাবার অফিসটা কোয়ার্টার থেকে কিছু দূরে। মাঝে মাঝে ঝাঁকড়া চুলের বাবাকে দেখতে মন চাইলে চলে যেতাম অফিসে, এক দৌড়ে। বাবা দোকান থেকে চকলেট কিনে দিতেন। নিষিদ্ধ 'টিকটিকির ডিম' (গোল বলের মতো চকলেট) মাকে লুকিয়ে কিনে দিতেন বাবা।
এমনই একদিন বাবা টিকটিকির ডিম আর চকলেট কিনে দিয়ে আমার হাফপ্যান্টের পকেট ভর্তি করে দিয়েছেন। এমন সময় পেছনে খুব হট্টগোলে ফিরে চাইলাম। দেখলাম সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির নিচে সাইকেল দোমড়ানো মোচড়ানো। সারারাস্তা দুধ আর কলার পাতা পড়ে আছে। একজন বয়স্ক মানুষ, একপাশে পড়ে আছেন, হাত দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে।
মানুষ ঘিরে ধরছে তাকে। এমন সময় গাড়ির দরজা খুলে জলপাই রঙের পোশাকে এক কর্মকর্তা নেমে এলেন। ততোদিনে জেনে গেছি, মেজররা এমন ভঙ্গীতে নামেন! ভাবলাম, যাক এবার মেজর লোকটাকে তুলবেন, পানি খাওয়াবেন। কিন্তু হলো উলেটাটা। দূর থেকে কথাগুলো শুনতে পারলাম না।
কিন্তু কর্মকর্তা অসহায় বৃদ্ধটিকে জোরে জোরে কেয়কটা লাথি কষলেন। আমার বাবা সে দৃশ্য থেকে আমাকে আড়াল করে নিয়ে এলেন তার অফিসে। এরপর কতোদিন যে আমি স্বপ্নে সেই দোমড়ানো সাইকেলটি দেখেছি!
এখন আমি বাবা হয়েছি। মেজর হওয়া আমার আর হয়নি। না, হতে পারবো কি না সে যোগ্যতার যাচাইয়েও অংশ নিইনি।
আমার এক বছর 10 মাসের ছেলেটা সারাবাড়ি দৌড়ে বেড়ায়। দু'দিন আগে ওকে নিয়ে ওর মা'র কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম রিকশায়। আমাদের রিকশার সামনেই দু'টো মেশিনগান তাক করা সেনাবাহিনীর গাড়ি পড়লো। আমার ছেলে জানতে চাইলো ওরা কারা। আমি জবাব দিলাম।
আর প্রশ্ন, এগুলো আরমী কেনো? পাশ দিয়ে যাবার সময় সেনা কর্মকর্তা আমার ছেলের গাল টিপে দিলেন সস্নেহে। ছেলেটি আদরে খুশি হয়। আমি দ্রুত রিকশা ছোটাতে বললাম। ভয় হলো, কী জানি, আমার ছেলের না আবার সবাইকে আদরে রাখার জন্য মেজর হবার সাধ হয়! আবার সেই সাধ কয়দিন পরেই চুরমার করে দেয় কোনো দোমড়ানো সাইকেল! সেই দুঃস্বপ্ন দেখার সময় কি খুব কাছে চলে এসেছে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।