আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি তার ঠিকানা রাখিনি, তার ছবিও অাঁকিনি....

সযতনে খেয়ালী!

দেড়দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আসলে ঠিক বৃষ্টি হচ্ছে না বলে বলা উচিৎ আকাশ কেঁদে চলেছে। কান্নাটা অবশ্যি মেয়েলী হাউমাউ গোছের বন্যা বইয়ে দেয়া অঝোর কান্না না। বরং ডুকরে ডুকরে, ফুঁপিয়ে ওঠা মন খারাপ করে, প্রচন্ড নি:সঙ্গতায় টুপটুপ করে ফেলা চোখের জলের মতোই আকাশের এই কান্না। ঠান্ডাটাও জাঁকিয়ে বসছে ধীরে-সুসতে।

বুঝাই যাচ্ছে বরফপতন খুব বেশি দূরে নেই! আজকের এই অগোছালো সন্ধ্যায়, সময়ের একের পর এক আবরণের পরত খুলে যখন একাকিত্বকে পরম আদরে চুড়ান্ত আলিঙ্গন করতে যাবো, ঠিক তখনই মান্না অনেকটাই কাবাব মে হাড্ডি হয়ে আমার ভাবনায় যতি ফেলে উড়িয়ে নিয়ে গেলো আমাকে শুরুর দিককার জার্মান জীবনে। কবের কথা, খুব সম্ভবত অক্টোবরের শেষ কি নভেমবরের প্রথম দিকে হবে! ট্রিয়ার থেকে কোলনে ফিরছি। জার্মান ভাষার 'জ' ও জানি না। হাউপ্টবানহফ আর বানহফের মধ্যেই তখনো বিশাল প্যাচ লেগে আছে। তার মধ্যে এই অজানা পথ পাড়ি দিতে হবে একলা একলা।

অতি ইশমাট(!) আমার হাতে একখানা টিকেট ধরিয়ে দিয়ে ভাইয়ের বিএমডাবি্লউ হাঁকিয়ে বিদায়ব্যাথা সইতে না সইতেই শেষ ভরসা তার বন্ধুর শুভেচ্ছান্তে বিদেয়টাও গিলে হজম করতে হলো! নিজেকে এতোটা একা অজানা অচেনা সিঙ্গাপুর, তাসকেন্ট এয়ারপোর্ট, কিংবা এথেন্সের আবঝাব গলিতেও মনে হয়নি। প্লাটফরমে পায়চারী করতে গিয়ে অধিক টেনশনেই কিনা, নিজেকে খুব পিপাসার্ত লাগছিলো। খুঁজে পেতে একটা ভেন্ডিং মেশিনে গেলাম কিছু কিনে গলা ভেজানোর অভিপ্রায়ে। কিন্ত ঐযে বলে, "ভাগ্যের লিখন ব্যটা তুই খন্ডাবি ক্যামনে"? মানিব্যাগ খুলে দেখি শালার যা আছে সব নোট, সব ঝেড়ে ঝুড়েও একটা ড্রিংক্স কেনার মতো পর্যাপ্ত কয়েন পাওয়া গেলো না। হাতে পাঁচ ইউরোর নীলাভ নোটটা নিয়ে ঘুরতে লাগলাম, দেখি কারো কাছে ভাংতি পাওয়া যায় কিনা।

সিডনীর টাউনহলে একবার এক মাতালের কাছ থেকে 50 সেন্ট "ভিক্ষা" করেছিলাম বিড়ি ফুঁকবো বলে, সেদিনের অবস্থাটাও ঠিক ভিক্ষা করার মতোই মনে হচ্ছিলো। আশা পারিনা ভাষা পারিনা, ভাষাহীন মূর্খ আমি পা টিপে টিপে হাঁটছি কাকে দেখে মনেহয় "এর কাছে ভাংতি আছে" টাইপের কারো খোঁজে। বুকে সাহস নিয়ে গল্প করা দুই ললনার কাছে গিয়ে একহাতে পাঁচ ইউরোর নোটটা ধরে আরেক হাটে ভেন্ডিং মেশিনের দিকে তর্জনী নিক্ষেপ করে মুখে "হা-হু-হাম" করে হাত-পা খানিক নাড়তেই দেখলাম ললনাদের ব্যাগের চেইন খুলছে। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। "শালার আমি তো প্যান্টোমাইমে পাথর্্ব প্রতিম মজুমদারকেও হার মানিয়ে দেবো দেখি"।

কিন্ত ঐযে "অভাগা যেদিকে চায়, আটলান্টিক শুদ্ধা শুকায়া যায়"। ললনাদ্্বয় মুখ কাচুমাচু করে যা জানালো তার মানে দাড়ায় তাদের কাছেও কোন ভাংতি নেই। এবার একটু সরে এসে খাঁটি বাংলায় ইশটিশন কর্তৃপক্ষের মুন্ডুপাত করলাম। দিল খালি করে কতগুলো বাংলা গালি ঝাড়লাম তাদের মহান অস্তিত্বের উদ্দেশ্যে। ট্রেন এলে এক বুক পিপাসা নিয়েই চড়ে বসলাম।

জানালার পাশে বসে আমার দৃষ্টি তখনো প্লাটফরমের সেই ভেন্ডিং মেশিনটার দিকে। অতিব শক্তিশালী কোন "ভুখা-নাঙা" দৃষ্টির প্রভাবে যদি ভেন্ডিং মেশিনটা ঠাশ ঠাশ শব্দে ভেঙে পড়ে, সেটা দেখার অপেক্ষা! হঠাৎই খেয়াল করলাম ইয়া ভোটকা সাইজের এক লাগেজ টেনে ওঠাচ্ছে একটা মেয়ে। পারছেনা একা একা, শেষে তাকে সী-অফ করতে আসা মেয়েটার সাহায্যে সক্ষম হলো যদিও। আমি একেই টার্গেট করলাম আমার পিপাসা মিটানোর জন্য। যখন বুঝলাম লাগেজটা এখন একটা সেফ পজিশনে আছে মানে আমাকে খুব একটা শ্রম দিতে হবে না যদিও "ভদ্্রতাসূচক সাহায্য" করতে হয়! এগিয়ে গিয়ে খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান এক্সেন্টে এমনভাবে সবাগত জানালাম যেনো ট্রেনটা হলো টাইটানিক আর আমি এই টাইটানিকের ক্যাপ্টেন।

মেয়েটাও আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে ইংরেজীতে অভিবাদনের জবাব দিলো, আমার পাশের সিটে বসার আমন্ত্রন গ্রহন করলো। আমি তখন রাপু খাপাং-নেস বাদ দিয়ে চামে তাকিয়ে আছি কখন তার ব্যাগ গলে কোক বা পানির বোতল দেখবো। বসার পরেই হাত বাড়িয়ে বল্লো, "কাইনম্যান, লিন্ডা কাইনম্যান"। আমার মনে হলো ভানুর মতো চেঁচিয়ে বলি, "পরিচয় পরে হইবো আগে ব্যাগের ভিতর থাইকা বোতল খোলেন"! যাইহোক, হালকা পরিচয়ের পর দেখলাম সে ব্যাগ খুলে একটা বোতল বের করলো। আমি কালবিলমব না করে প্লাটফরমের কাহিনীটা এক নি:শ্বাসে বলে দিলাম।

লিন্ডাও সুমিষ্ট হাসি মুখে টেনে, আমার হাতে একটা "আইস-টে"-এর বোতল ধরিয়ে দিলো। ঈশ, কি যে আরাম করে গিললাম বোতলের সবটুকু তরল, সেটা কেবল পিপাসার্ত কেউই বুঝবেন! এবার শুরু হলো আমাদের ফর্মাল আলাপ। আখেন ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন পড়ছে। ছুটিতে ট্রিয়ারে স্কুলের বান্ধবীর কাছে বেড়াতে এসেছিলো, এখন ডুসেলডর্ফ যাবে মা-বাবার ওখানে। সেখানে দিন পনরো থেকে আবার আখেন।

বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলো, মানুষজন সম্পর্কে জনতে চাইলো, পরিবেশ, আচার, কৃষ্টি কোন কিছুই বাদ গেলো না আমাদের আলোচনা থেকে। তাকে জানালাম বিভিন্ন পার্বণ গুলোর কথা, মজাদার সব খাবারের কথা, নবান্ন উৎসবের কথা। মাঝে মাঝে ওর ঢোঁক গেলা আর উজ্জ্বল দৃষ্টি দেখে বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম, ও ভার্চুয়ালী বাংলাদেশের কোন এক গাঁয়ে, একটা লাল রঙের তাঁতের শাড়ি এক প্যাচে পড়ে, মাথার চুলগুলো বেনী করে, ফিতা বেঁধে, আলতা রাঙা পায়ে নূপুর পড়ে হেঁটে যাচ্ছে এখন! ওর কাছ থেকেও অনেক কিছু জানলাম। জানলাম কোয়েলশ আর আলটের পার্থক্য, কোথাকার ভাইৎসেন প্রসিদ্ধ ইত্যাদি। তিন ঘন্টা ভ্রমনের কখনো হালকা বিরতিতে ট্রেনের জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় বাইরের দৃশ্য দেখতে গিয়ে জানালায় তার মুখের প্রতিবিমব দেখছিলাম, একমনে এদিকে তাকিয়ে আছে...।

হঠাৎ মুখ ঘোরাতেই চোখে চোখ, আর খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েই চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো লিন্ডা কাইনম্যান.....। নানা ধরণের উদ্্বেলতায় ভরা সেই ভ্রমনটা শেষ হয়েছিলো কোলন মেইন স্টেশনে এসে। আমি শহরের রাস্তা ধরবো আর লিন্ডা ধরবে ডুসেলডর্ফগামী ট্রেন। প্লাটফরমে নেমে আমি হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই আমার ওপর মোটামুটি হুমড়ি খেয়েই জড়িয়ে ধরলো আমাকে। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুমি নিজের যত্ন নিও...।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলাম, কী হয়েছে! সব ঠিকাছে! তুমিও অনেক ভালো থেকো! স্টেশন থেকে বের হয়ে কোলনার ডোমের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে শুনছিলাম কেউ একজন সেক্সোফোনে "নাথিংস গনা চেঞ্জ মাই লাভ ফর ইউ..." সহ আরও অনেক গুলো ভালো লাগা গান বাজাচ্ছে। সেদিনো এরকম ঝিরঝিরে বৃষ্টির সন্ধ্যা ছিলো কোলনে, হালকা বাতাস ছিলো, সেক্সোফোনের পাগল করা মূর্ছনা ছিলো, ছিলোনা কেবল লিন্ডা কাইনম্যান...। তার সাথে এরপর আর দেখা হয়নি, হবার কোন সুযোগও নেই যদিনা কোন মির্যাক্ল ঘটে যায়...। কারণ, "আমি তার ঠিকানা রাখিনি, তার ছবিও অাঁকিনি...." মান্না দে'র গানটা যেনো আমাকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।